দুই মেয়েকে নিষিদ্ধপল্লীতে বিক্রি করে দিলেন মা!
ফুটফুটে দুই মেয়ে। তাদের যৌনপল্লিতে বিক্রি করে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে মায়ের বিরুদ্ধে! রীতিমতো দরদাম করে। মায়ের এমন পাশবিক অপকর্ম মেনে নিতে পারেননি ওই দুই মেয়ের নানী। নিজের মেয়ের বিরুদ্ধেই হাইকোর্টের দ্বারস্থ হলেন তিনি।
নাতনিকে খুঁজে দেয়ার আবেদন করেছেন হাইকোর্টে। ঘটনাটি ঘটেছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগনায়। প্রায় প্রায় ১৬ বছর আগে ২৪ পরগনার জয়নগরের বরেন মণ্ডলের (ছদ্মনাম) সঙ্গে বিয়ে হয় স্থানীয় কবিতা হালদারের (ছদ্মনাম)। তাদের দুই মেয়ে হওয়ার পর একদিন নিখোঁজ হয়ে যান বরেন। স্বামী নিখোঁজ হওয়ার পর এলাকার এক যুবকের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে কবিতার।
তার পরে দুই ও তিন বছরের দুই মেয়েকে নিজের মায়ের কাছে রেখে ওই যুবকের সঙ্গে ঘর ছাড়েন কবিতা। দিল্লিতে গিয়ে তাকে বিয়ে করে নাম পরিবর্তন করে তিনি হন তানিয়া খান। তার মা সুমনা হালদার (নাম পরিবর্তিত) গৃহপরিচারিকার কাজ করেন। দিন চলে অতি কষ্টে।
বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করে দুই নাতনিকে ঠাকুরপুকুরের আবাসিক স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করেন। সেই দুই মেয়ে এখন তেরো ও বারো বছরের কিশোরী। অষ্টম ও সপ্তম শ্রেণিতে পড়া দুই বোনের বড়জন খেলাধুলায় বেশ পারদর্শী। বাস্কেটবল খেলে। রাজ্যস্তরে প্রতিনিধিত্ব করেছে। অনূর্ধ্ব ১৪ জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয় সম্প্রতি। কিন্তু তাতে দরকার হয় জন্ম-নিবন্ধন সার্টিফিকেট।
সেই সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে গিয়েই ঘটনা অন্য দিকে মোড় নেয়। আদালতের অভিযোপত্রে বলা হয়, দুই মেয়েকে রেখে গেলেও তাদের জন্মের সার্টিফিকেট নিয়ে যান কবিতা। তাই ফোন করে মেয়ের জন্ম নিবন্ধন সার্টিফিকেট চাইলে তিনি মেয়েদের নিয়ে দিল্লিতে আসতে বলেন। এরপর দুই নাতনিকে নিয়ে গত ২৫ ডিসেম্বর কলকাতা থেকে ট্রেনে ওঠেন নানী। পরের দিন দিল্লি স্টেশন থেকে তাদের নিয়ে যান মেয়ে। একদিন সেই বাড়িতে থাকার পর এক আত্মীয়র বাড়িতে যাওয়ার কথা বলে মা ও দুই মেয়েকে নিয়ে বের হন কবিতা।
দিল্লির ঠিক কোথায় নিয়ে গিয়েছিল তা বলতে না-পারলেও মেয়ে তাদের একটি ছয় তলা বাড়িতে নিয়ে যায় বলে অভিযোগপত্রে জানিয়েছেন নানী সুমনা। তার বয়ান অনুযায়ী, ‘সেই বাড়ির একেবারে উপরের তলার একটি ঘরে নিয়ে আমাদের বসানো হয়। তার পর মেয়ে বেরিয়ে যায়। এরই মধ্যে ছয়-সাতজন বিভিন্ন বয়সের লোক ওই ঘরে এসে বসে। তারা দুই নাতনির সঙ্গে কথা বলতে থাকে। তাদেরকে অযাচিতভাবে স্পর্শ করার চেষ্টা করে। তারা জানায়, দুই মেয়েকে বিক্রি করে দিয়েছেন তাদের মা।’
পরিস্থিতি অন্যরকম দেখে সুমনা মেয়ের খোঁজ করেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পর ওই ঘরে ফিরে আসে মেয়ে। তিনি নাতনিদের নিয়ে ফিরে যেতে চাইলে এবার মুখ খোলেন মেয়ে। তিনি বলেন, ‘দুই মেয়েকে এখানে ওই লোকদের সঙ্গে থাকতে হবে।’ বৃদ্ধার অভিযোগ, হিন্দিতে কথা হলেও ১০ লাখ টাকা দেয়া নিয়ে যে ওই লোকদের সঙ্গে মেয়ের আলোচনা হচ্ছিল তা তিনি বুঝেছিলেন।
তিনি সব বুঝে সেখান থেকে বেরোনোর চেষ্টা করলে ওই ঘরেই তাদের আটকে রাখা হয়। দু’জন পাহারায় থাকে। ঘরে থাকা পাহারাদাররা ঘুমে ঢলে পড়তেই নাতনিদের নিয়ে ভোররাতে বাসা থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় এসে পৌঁছান তিনি। সেখান থেকে পৌঁছান দিল্লি স্টেশনে।
স্টেশনে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই সেই ঘরের দুই পাহারাদার এসে ধরে ফেলে দুই নাতনি-সহ বৃদ্ধাকে। কেড়ে নেয় বৃদ্ধার বড় নাতনিকে। কেউ কিছু বোঝার আগেই চলে যায় দুই পাহারাদার। বৃদ্ধা বলেন, ‘ট্রেন থেকে নেমে যে অভিযোগ করব, সেই সাহস পাইনি। কারণ তখন ছোটটাকে ধরে নিয়ে যায় কি-না, সেই আতঙ্ক ছিল।’
ছোট নাতনিকে আঁকড়ে কলকাতায় ফেরেন সুমনা। জয়নগরে ফেরার পর স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে জয়নগর থানায় গিয়ে সব ঘটনা জানান। কিন্তু এখানে কিছু করা যাবে না বলে দায় এড়ায় পুলিশ। এর মধ্যে গত ৫ জানুয়ারি একটি ফোন আসে সুমনার কাছে।
‘দিল্লি পুলিশ থেকে ফোন করছি’ দাবি করে ফোনের অপর প্রান্ত থেকে বলা হয়, তার নাতনিকে তারা পেয়েছে। এক যুবককেও আটক করা হয়েছে। কিন্তু কয়েকদিন আগে দিল্লির ওই ঘটনায় আতঙ্কিত সুমনা তাদের জয়নগর থানায় ফোন করার পরামর্শ দেন। তার বক্তব্য, ‘আসলে ফোন কে করেছে তাই তো বুঝতে পারছি না। তাই পুলিশের সঙ্গ ছাড়া আর দিল্লি যাওয়ার ভরসা পাইনি।’
তার আইনজীবী ইন্দ্রজিৎ রায় চৌধুরী বলেন, পুলিশের দিক থেকে কোনো সাহায্য না-পাওয়ায় ৭ জানুয়ারি ওই নারী স্থানীয় থানা, পুলিশ সুপার, জেলাশাসক, সিআইডি থেকে শুরু করে স্বরাষ্ট্রসচিব পর্যন্ত সর্বত্র চিঠি দিয়ে পুরো ঘটনা জানিয়ে সাহায্য চান। কিন্তু সাহায্য দূরের কথা, চিঠির প্রাপ্তি স্বীকার পর্যন্ত করা হয়নি। তাই প্রতিকারের আশায় শেষ পর্যন্ত হাইকোর্টে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
আগামী বৃহস্পতিবার বিচারপতি জয়মাল্য বাগচির এজলাসে মামলার শুনানি হবে। জয়নগর থানার এক কর্মকর্তা ভারতীয় একটি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘যেখানকার ঘটনা সেখানেই অভিযোগ জানানো উচিত।’
এসআইএস/এমকেএইচ