যে আবিষ্কারগুলো বদলে দিতে পারে বিশ্ব অর্থনীতির ভবিষ্যৎ
‘ভিজুয়ালাইজিং চেইঞ্জ : এ ডেটা ড্রিভেন স্ন্যাপশট অব আওয়ার ওয়ার্ল্ড’ নামের নতুন একটি বই - যেখানে চলমান বিশ্বের বিভিন্ন পরিবর্তনের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করা হয়েছে।
বইটির সম্পাদক জেফ ডেসযার্ডিন্স মনে করেন, গত শতাব্দীর ৯০-এর দশকের শুরুতে ইন্টারনেটের আবির্ভাব বিশ্বের অর্থনীতি ও মানুষের চিন্তা-ভাবনাকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করেছে।
তার মতে, পঞ্চদশ শতকে নিকোলাস কোপারনিকাসের বর্ণনা করা সূর্যকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের মডেলের মতো যুগান্তকারী প্রভাব ফেলেছে পৃথিবীতে মানুষের জীবনযাপনে। পৃথিবীই মহাবিশ্বের কেন্দ্র- পঞ্চদশ শতাব্দীতে কোপারনিকাসের তত্ত্ব প্রচার হওয়ার পর এমন সনাতনী ধারণা প্রশ্নের মুখে পড়েছিল।
প্রযুক্তিগত উন্নয়নকে পরিবর্তনের মুখ্য উপাদান মনে করা হলেও, মানুষের ধ্যান-ধারণা ও কাজকর্ম, বাণিজ্যের ধারণা, ভূ-রাজনীতি ও গ্রাহকদের মনোভাবে পরিবর্তনও পৃথিবী বদলাতে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সম্ভব।
জেফ ডেসযার্ডিন্স বলেন, ‘যেকোনো জায়গা থেকে আসতে পারে বড় ধরনের পরিবর্তনের সুযোগ। আগামীকালের ধারণার পরিবর্তন আজই কোথাও না কোথাও শুরু হয়েছে।’
ডেসযার্ডিন্স ও তার গবেষক দলের মতে, কয়েকটি বিষয় হতে পারে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক গতিপথের দিকনির্দেশক।
১. প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর উত্থান :
বহু দশক ধরে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বৃহৎ পরিসরে বাণিজ্যিকভাবে পণ্য উৎপাদন অথবা খনিজ পদার্থ নিষ্কাষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে পণ্য তৈরি করে ব্যবসা পরিচালনা করেছে। ফোর্ড, জেনারেল ইলেকট্রনিক্স এবং এক্সন এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের উদাহরণ। এর পরে এসেছে বিভিন্ন ধরনের আর্থিক সেবা দানকারী সংস্থা, টেলিযোগাযোগ সেবাদানকারী সংস্থা ও খুচরা বিক্রেতা সংস্থাগুলো।
বর্তমানে তথ্য সবচেয়ে মূল্যবান হিসেবে বিবেচিত। আর গত পাঁচ বছরের বৈশ্বিক ব্যবসার হিসেবে স্টক মার্কেটের সবচেয়ে মূল্যবান প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল প্রযুক্তিভিত্তিক সংস্থা। ২০১৮ সালের প্রথম তিন মাসে শীর্ষ পাঁচে ছিল অ্যাপল, গুগল, মাইক্রোসফট, অ্যামাজন আর টেনসেন্ট - পাঁচ বছর আগে শুধু অ্যাপল ছিল শীর্ষ পাঁচের মধ্যে।
২. চীনের ক্রমোন্নতি :
চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এখন আর নতুন কোনো বিষয় নয়। কিন্তু ডেসযার্ডিন্স চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে তাল রেখে তাদের প্রযুক্তিগত উন্নয়নের গতিবৃদ্ধির বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন।
চীনের কিছু শহরের অর্থনৈতিক উৎপাদন বিশ্বের অনেক দেশকেও ছাড়িয়ে যায়। এ মুহূর্তে চীনে একশোর বেশি শহর রয়েছে যেখানে ১০ লাখেরও বেশি মানুষ থাকে। অনুমান করা হয়, পৃথিবীর বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে ২০৩০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে চীন।
৩. মেগাসিটির আবির্ভাব :
চীনই কিন্তু একমাত্র দেশ নয় যাদের শহরগুলো উত্তরোত্তর উন্নত হচ্ছে। আগামী কয়েক দশকে পৃথিবীর শহরগুলোতে বাড়তে থাকা মানুষের কারণেও বৈশ্বিক অর্থনীতি রূপান্তরিত হবে ব্যাপকভাবে।
জাতিসংঘের ধারণা অনুযায়ী, চীন ও অনেক পশ্চিমা দেশে জন্মহার স্থিতিশীল থাকবে; অন্যদিকে আফ্রিকা আর এশিয়ার অনেক দেশে হওয়া জনসংখ্যা বিস্ফোরণের ফলে নগরায়ন বৃদ্ধি পাবে।
এই শতকের আগে আফ্রিকা মহাদেশে নিউ ইয়র্কের চেয়ে বড় অন্তত ১৩টি মেগাসিটি থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
৪. বৈশ্বিক ঋণ :
জেফ ডেসযার্ডিন্সের প্রতিষ্ঠা করা মিডিয়া কোম্পানি ভিসুয়াল ক্যাপিটালিস্টের হিসেব অনুযায়ী, মোট বৈশ্বিক ঋণের পরিমাণ বর্তমানে ২৪০ ট্রিলিয়ন ডলার, যার ৬৩ ট্রিলিয়ন সরকারগুলোর হাতে। মোট দেশজ উৎপাদনের সাথে তুলনা করলে, জাপানের ঋণ ২৫৩% এবং যুক্তরাষ্ট্রের ১০৫%। মোট ঋণের হিসেব করলে জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র যৌথভাবে বিশ্বের মোট ঋণের ৫৮ শতাংশর জন্য দায়ী।
৫. প্রযুক্তিগত পরিবর্তন :
গত শতকে গৃহস্থালীতে ব্যবহারের জন্য বিদ্যুত সরবরাহ, টেলিফোন, মোটরগাড়ি বা বিমানের মতো যুগান্তকারী কিছু প্রযুক্তিগত আবিষ্কার হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই ধরনের পণ্য সবার জন্য সহজলভ্য করতে বছরের পর বছর সময় লেগেছে।
যেমন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে, ৯০ শতাংশ মানুষের কাছে অটোমোবাইল বা মোটরযান সহজলভ্য করতে ৮০ বছর লেগেছে।
তবে একই পরিমাণ সহজলভ্যতা পেতে ২৩ বছর সময় লেগেছে ইন্টারনেটের। অন্যদিকে ট্যাবলেটের মালিকানা পাওয়া ২০১০ সালে যেখানে ৩% মানুষের জন্য সহজলভ্য ছিল, তা ২০১৬ তে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫১ শতাংশতে।
ডেসযার্ডিন্স মনে করেন, কোনো একটি প্রযুক্তিগত আবিষ্কারের পর সেটি মানুষের কাছে সহজলভ্য হওয়ার অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের ব্যবধান কয়েক মাসে নেমে দাঁড়াবে।
৬. বাণিজ্যে প্রতিবন্ধকতা :
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিভিন্ন দেশের সরকার প্রগতিশীল মনোভাব নিয়ে এক দেশ থেকে আরেক দেশের মধ্যে থাকা বাণিজ্য নীতিমালা ব্যবসা বান্ধব করে দিয়েছিল। কিন্তু বর্তমান বিশ্বে কিছুটা পরিবর্তিত ধারা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
এ বছর ওয়াশিংটন বিবিধ চীনা পণ্যে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে চীনের সাথে একরকম বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করার ইঙ্গিত দেয়।
ডেসযার্ডিন্সের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বিশ্ব আবারও মুক্তবাজার বাণিজ্যের দিকেও অগ্রসর হতে পারে, আবার নতুন ধরনের বাণিজ্য নীতি তৈরিতেও কাজ করতে পারে।
৭. সুবজ বিপ্লব :
প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস যেমন বেড়েছে, তেমনি এর উৎপাদন খরচও দিনদিন কমেছে। আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ জ্বালানির উৎস হবে সৌরশক্তি।
সূত্র : বিবিসি
এমবিআর/এমএস