চাঁদে চীনের অভিযানের নেপথ্যে জ্বালানীর সন্ধান?
মহাকাশ জয়ের গল্পে অন্য দেশগুলোর তুলনায় চীন তুলনামূলকভাবে নতুন। কিন্তু অরবিটে প্রথম নভোচারী পাঠানোর মাত্র ১৫ বছরের মধ্যেই চীন বিস্ময় ঘটিয়েছে। সম্প্রতি চাঁদের দূরতম অংশে সফলভাবে ল্যান্ড করিয়েছে চীনের একটি স্পেসক্রাফট।
এখানেই শেষ নয়। আসন্ন দশকে নতুন একটি মহাকাশ স্টেশন স্থাপন করার কথা ভাবছে চীন। পাশাপাশি চাঁদে একটি বেস ক্যাম্প স্থাপন এবং মঙ্গলে অভিযান চালানোর প্রস্তুতিও নিচ্ছে দেশটি।
যুক্তরাজ্যের রয়্যাল অ্যারোনোটিকেল সোসাইটির ফেলো অধ্যাপক কেইথ হেওয়ার্ড বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া যে লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে, চীনেরও একই অভীষ্ট। প্রথমত, দেশটির সেনাবাহিনী এটি চেয়েছিল। কারণ এই কর্মসূচিতে যত অর্থ ব্যয় হয়েছে, তাদের আগ্রহ ছাড়া তার অর্ধেকও পাওয়া সম্ভব হতো না। দ্বিতীয়ত, ক্ষমতা ও সামর্থ্য প্রকাশের জন্য এটি একটি দারুণ উপায়। তৃতীয়ত, সন্ধান মেলেনি এমন অমূল্য বস্তু বা এনার্জি বা জ্বালানীর সন্ধান। মূলত এই তিন কারণেই মহাকাশ গবেষণায় এত মনোযোগ, অর্থ ও সময় ব্যয় করছে চীন।
চীনের এই মহাকাশ গবেষণা কর্ম নিয়ে চাপ বোধ করছে না যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স ২০১৮ সালে অগাস্ট মাসে স্পষ্ট জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইউএস স্পেস ফোর্স’ এর কথা।
চীনের সর্বশেষ সাফল্য ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবার কারণ নেই বলে মনে করেন অধ্যাপক হেওয়ার্ড। কারণ যুক্তরাষ্ট্র এখনও মহাকাশ গবেষণার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করছে। শুধু নাসার মাধ্যমেই যে এই ব্যয় হচ্ছে তা নয়। পেন্টাগন-ও ব্যাপক অর্থ খরচ করছে এই খাতে।
কিন্তু এটি কি আসলেই মহাকাশে মানুষের নতুন প্রতিযোগিতার শুরু? কারণ চাঁদে চীনের স্পেসক্রাফট পৌঁছানোর মাত্র কদিন আগেই নাসার আরেকটি সফল অভিযানের মাধ্যমে বরফ-ঢাকা এক ‘নয়া দুনিয়ার’ খবর এনেছিল।
ঠিক এভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হিসেবে বিষয়টিকে দেখছেন না অধ্যাপক হেওয়ার্ড।
ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির ইন্টারন্যাশনাল লুনার এক্সপ্লোরেশন ওয়ার্কিং গ্রুপ-এর এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর বার্নাড ফোয়িং বলছিলেন, যেকোনো ধরনের অগ্রগতি বৃহদার্থে পৃথিবীবাসী সকলের জন্যই কল্যাণের।
বার্নাড ফোয়িং আরও বলছিলেন, মহাকাশ গবেষণায় চীন অগ্রগতি দেখিয়েছে এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সাথে মিলে-মিশে কাজের আগ্রহ-ও প্রকাশ করেছে।
তবে সব দেশ চীনের সাথে মিলে-মিশে কাজ করতে পারলেও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তা সহজ হবে না বলেই মনে করেন তিনি। কারণ দ্বিপাক্ষিকভাবে কারও সাথে নাসা কাজ করার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে নিষেধ রয়েছে। তাই এক্ষেত্রে কিছু করতে হলে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের অনুমোদন লাগবে।
যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির স্পেস পলিসি ইন্সটিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা জন লগসন বলছিলেন, চীন আসলে কারো সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে মহাকাশ গবেষণা করছে না। বরং নিজেদের নিজস্ব আকাঙ্ক্ষা থেকেই চীন এত কিছু করছে।
চীনের মহাকাশ গবেষণা প্রোগ্রামে চীনা পৌরাণিক কাহিনীর অনেক উপাদান রয়েছে। যেমন ম্যাগপাই ব্রিজ হচ্ছে চীনের রিলে স্যাটেলাইটের নাম।
চীনাদের এইসব নামের পেছনেও রয়েছে দারুণ সব গল্প। যেমন চ্যাঙ-এর কথাই ধরা যাক।
চ্যাঙ :
চীনের চন্দ্রদেবীর নামানুসারে চন্দ্রাভিযানের নামকরণ হয়েছে। পুরাণ অনুযায়ী, চন্দ্রদেবী ছিলেন দারুণ সুন্দরী এক নারী। তিনি প্রখ্যাত তীরন্দাজ হো-ইকে বিয়ে করেছিলেন। হো-ই অমরত্ব লাভের অমৃত অর্জন করেছিলেন। কিন্তু যেহেতেু অমৃত শুধু একজনের জন্য ছিল তাই হো অমৃত না খেয়ে সেটি চ্যাঙের কাছে নিরাপদে সংরক্ষণ করতে দিয়েছিলেন। কিন্তু একদিন হো-এর এক ছাত্র তা চুরি করে নিতে চায়। চ্যাঙ সেই ছাত্রকে কিছুতেই পরাজিত করতে পারছিল না দেখে অবশেষে নিজেই অমৃত খেয়ে নেয় এবং ভেসে-ভেসে চাঁদের দেশে চলে যায়। সেই থেকে বেদনাভারাতুর হো-ই বছরের সবচেয়ে উজ্জ্বল পূর্ণিমায় তার স্ত্রীর প্রিয় সব খাবার তার উদ্দেশে উৎসর্গ করে। আর এটি চীনের একটি অন্যতম জনপ্রিয় উৎসব।
জেডি রেবিট :
চীনের মুন রোভারের নাম দেয়া হয়েছে জেডি রেবিট। চাঁদের দেশে চলে যাওয়া চ্যাঙের একমাত্র সঙ্গী রেবিটের নামানুসারে এই মুন রোভারের নামকরণ।
ম্যাগপাই ব্রিজ :
চীনের রিলে স্যাটেলাইটের এই নামটি নেয়া হয়েছে আরেক দেবীর এক কন্যার ঘটনা থেকে। সেই কন্যা এক দরিদ্র কৃষকের প্রেমে পড়েছিল। তারা বিয়ে করে, সুখী দাম্পত্য ও সন্তান সন্ততি জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু দেবী যখন তার কন্যার এই কাণ্ডের কথা জানতে পারেন তিনি রেগ আগুন হয়ে যান এবং ক্ষেপে গিয়ে মিল্কিওয়ের ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় তাদেরকে নির্বাসন দেন। তবে, সেই বিরহী দম্পতির জন্য বেদনা অনুভব করে ম্যাগপাই সিদ্ধান্ত নেয় যে বছরে একবার তারা একটা সাঁকোর মতন তৈরি করবে। যাতে কর বিরহী দুই প্রেমিক-প্রেমিকা বছরে অন্তত একবার পরস্পরের দেখা পায়। এই দিনটিও চীনে বেশ ঘটা করে উদযাপন করা হয়। আর এটিই হচ্ছে আসলে চীনাদের ভ্যালেন্টাইন্স ডে বা ভালোবাসা দিবস।
তবে এটি অবশ্যই বলা যায় যে, মহাকাশ গবেষণা শুধু রাজনৈতিক লাভা-লাভের ব্যাপার নয়।
চ্যাঙ-৪ এর প্রকৃতই বৈজ্ঞানিক উদ্দেশ্য রয়েছে বলে মনে করেন রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিকেল সোসাইটির গবেষক ড. রবার্ট মেসাই।
ভবিষ্যতের মানুষের জন্য যত এনার্জি বা জ্বালানির প্রয়োজন হবে সেটিরো হয়তো সন্ধান মিলতে পারে মহাকাশে। সুতরাং সেটি খোঁজার জন্যে চীন প্রচেষ্টা চালাবে।
সূত্র : বিবিসি
এমবিআর/এমএস