প্যারিসের সেই ‘স্পাইডারম্যানের’ সঙ্গে পরে কী ঘটল?
গত ২৬শে মে বিকেলের ঘটনা। মামদু গাসামা নামের এক ব্যক্তি উত্তর প্যারিসের এক জায়গা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। রু মার্কস-ডর্ময় রাস্তায় ঢুকেই তিনি থমকে দাঁড়ালেন। সেখানে প্রচণ্ড ভিড়। সবাই তাকিয়ে রয়েছে একটা ফ্ল্যাটবাড়ির ওপরের দিকে। সেখানে পাঁচ তলার ব্যালকনিতে ঝুলে আছে একটি শিশু। আর পাশের বাড়ি থেকে প্রতিবেশীরা ছেলেটিকে টেনে তোলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে।
গাসামা পরে বলেছিলেন, চিন্তা করার মতো কোন সময় তার কাছে ছিল না। তরতর করে এক কার্নিশ থেকে আরেক কার্নিশ বেয়ে ওপরে উঠে গিয়েছিলেন তিনি। নীচ থেকে দর্শকরা চিৎকার করে তাকে উৎসাহ দিচ্ছিলেন, ‘এগিয়ে যাও, তাড়াতাড়ি করো।’
ওদিকে ছেলেটি যে হাত দিয়ে ব্যালকনি ধরে ছিল তার জোর কমে আসছিল। কিন্তু সে পড়ে যাওয়ার আগেই গাসামা গিয়ে হাজির হন পাঁচ তলার ব্যালকনিতে। এক হাত দিয়ে বাচ্চাটিকে ধরে তিনি নিয়ে এসেছিলেন ব্যালকনির ভেতরে।
তিনি যখন ছেলেটিকে নিরাপদে তুলে আনছিলেন, তখন নীচের লোকজন করতালি দিচ্ছিলেন, আনন্দে শীষ দিচ্ছিলেন, মোবাইল ফোনে পুরো ঘটনাটি ভিডিও করছিলেন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সেই ভিডিও ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বে। এই অসীম সাহসিকতার জন্য ২২ বছর বয়সী মামদু গাসামার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।
আরও পড়ুন>> ঝুলন্ত শিশুকে উদ্ধার, স্পাইডারম্যানের খেতাব পেলেন তিনি (ভিডিও)
যখন জানা গেল মামদু গাসামা আসলে মালি থেকে আসা একজন অবৈধ অভিবাসী, তখন ফরাসী প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ তাকে বীরত্বের জন্য একটি পদক দেন। এরপর তিনি ঘোষণা করেন যে, গাসামাকে ফ্রান্সের নাগরিকত্ব দেয়া হবে। প্যারিসের মেয়রও তাকে পদক দেন। শহরের দমকল বিভাগ তাকে চাকরির জন্য ইন্টার্নশিপ দেয়।
এ ঘটনার পর বছর জুড়ে মামদু গাসামা বেশ কয়েকবার সংবাদমাধ্যমের সামনে আসেন। গত জুন মাসে লস অ্যাঞ্জেলসে ব্ল্যাক এন্টারটেইনমেন্ট টেলিভিশন অ্যাওয়ার্ডে মানবিকতার স্বীকৃতি হিসেবে তাকে বিশেষ পুরস্কার দেয়া হয়। লাজুক স্বভাবের গাসামা খুব কম কথা বলেন। তার একজন বন্ধু বলছিলেন, সংবাদমাধ্যমের নজর তার ওপর পড়ার পর তিনি একটু ঘাবড়েই গেছেন।
কিন্তু প্যারিসের দমকল বিভাগে খণ্ডকালীন চাকরি শুরুর একদিন আগে তিনি লে প্যারিসিয়েন সংবাদপত্রকে একটি সাক্ষাৎকার দেন। এতে সে দিনের সেই ঐতিহাসিক উদ্ধার অভিযান সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘কত তলার ওপরে উঠছি, আমি সেটা নিয়ে মোটেই ভাবছিলাম না। নিজের বিপদেরও কথাও আমার মাথায় ছিল না।’
ঐ উদ্ধার অভিযানের দু'সপ্তাহ পর গাসামা মালির প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণে নিজ দেশে ফিরে যান। রাজধানী বামাকোতে ২০১১ সালের পর প্রথমবারের মতো গাসামা, তার বাবা ও পরিবারের অন্য সদস্যরা একসঙ্গে মিলিত হন। মালি থেকে গাসামা যখন ভাগ্যান্বেষণে উত্তর আফ্রিকা ও ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপে পৌঁছান তখন তার বয়স মাত্র ১৫ বছর। আর তার বাবাও এতদিন পর তাকে দেখার জন্য গ্রাম থেকে প্রথমবারের মতো রাজধানী বামাকোতে আসেন।
বলা হচ্ছে গাসামা খুব ভালভাবেই তার চাকরি করছে। তবে ১০ মাসের চুক্তি শেষ হওয়ার পর তার ভাগ্যে কী রয়েছে, সে সম্পর্কে এখনই কোন ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না। তার ইন্টার্নশিপে ৯৬ ঘণ্টা কাজ করে গাসামা এখন পাচ্ছেন ৫৩৪ ডলার।
বাচ্চাটিকে উদ্ধারের সময় সবাই ধারণা করেছিল যে লোকটি পাশের ফ্ল্যাট থেকে শিশুটিকে টেনে তোলার চেষ্টা করছিল সে শিশুটির বাবা। কিন্তু পরে জানা গেল, না ছেলেটির বাবা তখন ঘরেই ছিলেন না। তিনি শিশুটিকে একা বাসায় রেখে বাজার করতে বেরিয়েছিলেন।
আর তার মা সেসময় বাড়িতে ছিলেন না। তিনি ফরাসি দ্বীপ রি-ইউনিয়নে বেড়াতে গিয়েছিলেন। বাবা হিসেবে দায়িত্বে অবহেলার জন্য গত সেপ্টেম্বর মাসে ঐ শিশুর বাবা আদালতে দোষী প্রমাণিত হন। তবে তার কিংবা তার সন্তানের পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি।
ঐ নাটকীয় উদ্ধার অভিযানের মামদু গাসামা এখন আর প্যারিসের পূর্বাঞ্চলে তার ফ্ল্যাটে থাকেন না। নাগরিকত্ব ও বৈধ কাগজপত্র পাওয়ার পর তিনি সরে গেছেন শহরের কেন্দ্রস্থলে যেখানে তিনি নিজের জন্য একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করেছেন।
সূত্র: বিবিসি
এসএ/পিআর