ভিডিও EN
  1. Home/
  2. আন্তর্জাতিক

দাঙ্গা-সহিংসতার তাণ্ডব কেন বারবার মুম্বাইতেই?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | প্রকাশিত: ০৯:১১ এএম, ২৪ নভেম্বর ২০১৮

২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর রাতে ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাইতে এক নজিরবিহীন জঙ্গী হামলায় নিহত হয়েছিলেন অন্তত ১৬৪ জন দেশী-বিদেশি নাগরিক। সেই যে ঘটনার দশ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। কিন্তু মুম্বাইয়ের ইতিহাসে এর চেয়েও বড় বড় সহিংসতার অনেক নজির আছে। উনিশ শত চুরাশি বা বিরানব্বইয়ের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ওই শহরেই হাজার হাজার লোক প্রাণ হারিয়েছেন। এছাড়া ১৯৯৩ বা ২০০৩ সালেও সিরিজ বোমা বিস্ফোরণে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল শত শত।

কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ একটি শহরে কেন বারবার এভাবে সহিংসতা আঘাত হেনেছে? কোথায় এর উৎস, আর কীভাবেই বা এত বড় বড় ধাক্কা সামলে উঠেছে ভারতের এই ‘ম্যাক্মিমাম সিটি’? সরেজমিনে তারই খোঁজখবর নিতে পাড়ি দিয়েছিলাম আরব সাগরের তীরের এই বর্ণিল শহরে।

২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর গ্লোবাল টেরর ম্যাপ বা বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসের মানচিত্রে মুম্বাইকে নতুন করে চিনিয়েছিল ঠিকই কিন্তু এই শহরে বড় বড় দাঙ্গা-সহিংসতার ইতিহাস আসলে অনেক পুরনো। মুম্বাইয়ের কবি-সাংবাদিক-চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রীতীশ নন্দী কিন্তু বিশ্বাস করেন, এত দাঙ্গা-হাঙ্গামার পরেও শহরটার ডিএনএ কিন্তু কখনওই বদলায়নি।

তার কথায়, ‘আমার ধারণা বোম্বের মতো শহরে যতটা ভায়োলেন্স হতে পারত ততটা কিন্তু হয়নি। এটা অনেকেটা নিউ ইয়র্কের মতো। নিউ ইয়র্কেও বম্বিং হয়েছে, টেররিস্ট অ্যাটাক হয়েছে। কিন্তু তাতে কি নিউ ইয়র্কের কালচার বদলে গেছে? একেবারেই না।’

‘বোম্বেরও তাই। এখানে যা ঘটেছে, সেগুলো অ্যাবারেশন বা অ্যাকসিডেন্ট বলাই ভাল। কিন্তু বোম্বের সাঙ্ঘাতিক লিবারেল কালচারটায় তা কোনও প্রভাবই ফেলতে পারেনি!’

মহারাষ্ট্র পুলিশের মহাপরিচালক থেকে অবসর নিয়েছেন মীরন বোরওয়ানকার। যার কর্মজীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে মুম্বাইতে। সাবেক এই ডাকসাইটে পুলিশকর্তা বলছেন, ‘মুম্বাই একটা ‘জিও আউর জিনে দো’, অর্থাৎ চুটিয়ে বাঁচো আর বাঁচতে দাও মার্কা সংস্কৃতিকে বিশ্বাস করে ঠিকই কিন্তু এই শহরেই এমন দুটো এলিমেন্ট রয়েছে, যারা সব সময় অশান্তির বাহানা খোঁজে। তার একটা হল স্বার্থপর কিছু রাজনীতিবিদ আর অন্যটা সমাজবিরোধী চক্র।’

‘ফলে যখনই বাবরি মসজিদ ভাঙা কিংবা মারাঠা নায়ক শিবাজী মহারাজকে নিয়ে কোনও বিতর্কিত গবেষণার মতো কোনও ট্রিগার থাকে এরা সেগুলোকে উসকে দিয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাঁধাতে এক মুহুর্তও দ্বিধা করে না!’ কিন্তু কেন ব্যাঙ্গালোর-কলকাতা-চেন্নাই নয়, বরং মুম্বাই-ই বারবার এই ধরনের হামলার নিশানায়?

শহরের কর্পোরেট দুনিয়ার হঞ্চো অনুপম ভট্টাচার্য বলছেন, আসলে মুম্বাইতে হামলা চালিয়ে যে ধরনের ইমপ্যাক্ট বা অভিঘাত পাওয়া যাবে, এমন কী দিল্লিতেও সেটা সম্ভব নয়। তিনি বলছিলেন, ‘তিরানব্বই থেকে শুরু করে ২০০৮, মুম্বাইকে যে বারবার টার্গেট করা হয়েছে তার মূল কারণ হল ভিজিবিলিটি বা অ্যাটেনশন।’

‘একটা বোমা দিয়ে ... সাতটা ট্রেনে সাতটা বোমা পেতে রেখে প্রতিটায় অন্তত একশো মানুষকে মারা সম্ভব! এই ধরনের অ্যাটেনশন তো দিল্লিতেও মিলবে না!’ দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যাঙ্কার থেকে রাজনীতিবিদ হওয়া মীরা সান্যালও অনেকটা একই মতামতের শরিক।

তিনি বলেন, ‘একজন জঙ্গীর দৃষ্টিভঙ্গীতে যদি দেখি, তাহলে মুম্বাইকে স্তব্ধ করে দিতে পারলে আপনি কিন্তু অনেক বেশি ক্ষতি সাধন করতে পারবেন। তবে এই শহরটাই চরিত্রেই এমন একটা প্র্যাগম্যাটিজম বা বাস্তববাদ আছে যে বড় বড় বিপর্যয় থেকেও গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে সেটা এক মুহুর্তও সময় নেয় না। ২৬/১১-র হামলার সময় আমি যে রয়্যাল ব্যাঙ্ক অব স্কটল্যান্ডের দায়িত্বে ছিলাম পরদিন কিন্তু তার একটা ছাড়া শহরের সবগুলো ব্রাঞ্চ চালু ছিল। ভয়ঙ্করতম বিপদেও এই শহরটা এককাট্টা হয়ে নিজের সেরাটা উজাড় করে দিতে পারে।’

মুম্বাইয়ের প্রবীণ সাংবাদিক হরিশ নাম্বিয়ার বলছেন, ‘হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা কিন্তু এ শহরে অনিবার্য ছিল। আশির দশকে বিজেপির উত্থানেরও অনেক আগে এখানে শিবসেনার জন্ম। যারা একটি আঞ্চলিকতাবাদী দল, স্থানীয়দের ভাষা-সংস্কৃতির আবেগকে উসকে দিয়েই তাদের আবির্ভাব। নিজেদের শক্তিবৃদ্ধির জন্য তাদের এই মুম্বাই শহরের স্পেসের ভেতরেই একটা ‘শত্রু’ দরকার ছিল।’

‘প্রথমে তারা বেছে নিয়েছিল দক্ষিণ ভারতীয়দের। সরকারি চাকরিতে মুম্বাইতে যত দক্ষিণ ভারতীয় ছিলেন, টেলিফোন ডিরেক্টরি থেকে তাদের নামের তালিকা হুবুহু তুলে দিয়ে বাল ঠাকরে ছেপে দিতেন নিজের ম্যাগাজিনে।’ এর পরই শুরু হয়েছিল দক্ষিণ ভারতীয়দের কলোনি বা রেস্তোরাঁগুলোয় হামলা।

ভিনরাজ্যের ‘শত্রু’দের এভাবে ঠান্ডা করার পর শিবসেনার নজর পরে ভিনধর্মের শত্রুদের ওপর। আর সেখানেই নিহিত ছিল মুম্বাইয়ে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার বীজ। অনুপম ভট্টাচার্যও বলছিলেন, বাবরি ভাঙা বা গুজরাট রায়তের পর মুম্বাইতে যে সব বিস্ফোরণ বা হামলা হয়েছে তার সব ক্ষেত্রেই কিন্তু নিশানায় ছিলেন খুব সুনির্দিষ্ট লোকজন।

তিনি বলেন, ‘৯৩-র হামলায় নিশানা ছিলেন ধনী ব্যবসায়ী শ্রেণী - যারা বাবরি ভাঙাকে সমর্থন করছিলেন। সেই জন্যই বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল স্টক এক্সচেঞ্জ বা এয়ার ইন্ডিয়া বিল্ডিংয়ে, যেগুলো ছিল সে আমলের ধনীদের প্রতীক। একই ভাবে যে সিরিজ ট্রেন হামলা হয়, সেটা ছিল গোধরা কান্ডের পর - আর টার্গেট ছিলেন গুজরাটি ব্যবসায়ীরা।’

বাবরি-পরবর্তী দাঙ্গা যে মুম্বাইয়ের মতো শহরেও তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়েছিল তা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই প্রীতীশ নন্দীরও। ‘হ্যাঁ, সেইবার কিন্তু ইমপ্যাক্ট হয়েছিল। কারণ মানুষ ভীষণ ভয় পেয়েছিল। তারা জানত না কীভাবে সেই বিপদে বন্ধু-বান্ধব পরিবারকে রক্ষা করতে হবে। হিন্দুরা তখন ভাঙচুর-লুঠপাটে নেমে পড়ল। একই জিনিস করল মুসলিমরাও।’

মুম্বাইয়ের অন্ধকার মাফিয়া জগত বা আন্ডারওয়ার্ল্ডের রমরমা নিয়ে যে এত কথা শোনা যায়, শহরের বড় বড় সহিংসতার পেছনে তাদেরও কি কোনও ভূমিকা নেই। প্রীতিশ নন্দীর কথায়, ‘আমি বলব এটা হচ্ছে শহরের একটা মিথিক আন্ডারবেলি। দাউদ ইব্রাহিম আসার অনেক আগে থেকেই এ শহরের আন্ডারওয়ার্ল্ডে হাজি মস্তান, করিম লালা, আলংজেব-দের দাপট ছিল। তাদের মধ্যে মারামারি, স্ট্রীট ফাইটিং, খুনোখুনি সবই হত। কিন্তু গ্যাংলর্ডসদের এই দ্বন্দ্বে শহরের ওপর কখনও কোনও প্রভাব পড়েনি, কোনও দিন না!’

সূত্র: বিবিসি

এসএ/এমএস

আরও পড়ুন