অাইএসের যৌনদাসী ছিলাম, এটাই আমার শ্রেষ্ঠ অস্ত্র
>> ইরাকে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের হাতে বন্দী থাকাকালীন কীভাবে যৌন দাসী হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিলেন; সে ব্যাপারে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী নাদিয়া মুরাদ তার জীবনী দ্য লাস্ট গার্ল বইয়ে।
>> নৃশংস নিপীড়নের শিকার এই তরুণী এবছরের নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন। যৌনদাসী থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকারের কণ্ঠস্বরে পরিণত হওয়ার গল্প বলেছেন তার বইয়ে। সেখান থেকে একটি অধ্যায় তুলে ধরা হলো-
দাসীদের বাজার রাতের বেলা শুরু হয়। আমরা সিঁড়িতে শব্দ শুনতে পাই, যেখানে জঙ্গিরা সংগঠিত হয় এবং নিবন্ধন করে। প্রথম জন যখন ঘরের ভেতর প্রবেশ করে; তখন সব মেয়েরাই আর্ত-চিৎকার করতে শুরু করেন। এই সময় যে দৃশ্যের অবতারণা হয়, সেটি কিছুটা বিস্ফোরণের মতো। আমরা আহত অবস্থায় কান্নাকাটি করছি, মেঝেতে বমি করছি; কিন্তু এসবের কোনো কিছুই জঙ্গিদের মন গলাতে পারতো না।
‘আমরা যখন কান্নাকাটি, চিৎকার করছি, ভিক্ষা চেয়েছি তখন তারা ঘরে দাঁড়িয়ে আছে, আমাদের দিকে চেয়ে আছে। তারা প্রথমে সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েদের দিকে এগিয়ে যেত। জিজ্ঞাসা করতো, তোমার বয়স কত? মেয়েদের চুল ও মুখ পরীক্ষা করে দেখতো।’
আরও পড়ুন : আইএসের যৌনদাসী থেকে শান্তির নোবেলজয়ী নাদিয়া
একজন নিরাপত্তারক্ষীর কাছে জানতে চাইতো, ‘তারা কুমারী, তাই না? তখন সে বলতো, নিশ্চয়! এটা এমন ছিল যে, মনে হতো কোনো দোকানে গিয়ে পছন্দের পণ্য বাছাই করছে। ইচ্ছে মতো আমাদের শরীর স্পর্শ করতো, আমাদের বুক ও পা কোনো জায়গা বাদ যেতো না তাদের হাতের স্পর্শ থেকে। তারা এমনভাবে এসব করতো, যেন মনে হতো আমরা কোনো প্রাণী।’
জঙ্গিরা রুমে প্রবেশ করার পর বিশৃঙ্খলা তৈরি হতো। মেয়েদের তল্লাশির পাশাপাশি আরবি অথবা তুর্কি ভাষায় বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করতো।
‘‘জঙ্গিরা চিৎকার করে আমাদের শান্ত হওয়ার হুমকি দিতো। ‘শান্ত হও!’ কিন্তু তাদের এই নির্দেশ আমাদের আর্ত-চিৎকার বাড়াতো। একজন জঙ্গির কাছে আমাকে যেতে হচ্ছে; এটা অনিবার্য ছিল। আমি কখনই স্বাভাবিক হতে পারতাম না। আমি কান্নাকাটির পাশাপাশি চিৎকার করে হাত ছোড়াছুড়ি করতাম।’’
অন্য মেয়েরাও একই কাজ করতো, শরীর মুড়িয়ে বলের মতো হতো। জঙ্গিদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মেঝেতে বসে থাকা অন্য বোন অথবা বন্ধুদের মাঝে লুকানোর চেষ্টা করতো।
আরও পড়ুন : ‘ধর্ষণের আগে প্রার্থনা করাতো আইএস জঙ্গিরা’
আমি যখন শুয়ে থাকতাম, তখন অন্য আরেক জঙ্গি এসে আমাদের সামনে দাঁড়াতো। সে ছিল উচ্চপদস্থ জঙ্গি, তার নাম সালওয়ান। সে হার্দানের অন্য এক ইয়াজিদি তরুণীকে নিয়ে এসেছিল। সেখান থেকে তাকে কিনে বাড়িতে নেয়ার পরিকল্পনা করেছিল সে। একদিন সে বললো, দাঁড়াও। আমি তার কথা না শোনায়, আমাকে লাথি মারলো। সে বলল, তোমাকে, গোলাপী জ্যাকেট পরিহিত তোমাকে বলছি, দাঁড়াও।
চওড়া মুখের মাংসের গভীর কোঠরে ছিল তার চোখ। যা প্রায় সম্পূর্ণরূপে চুলে ঢাকা থাকতো। তাকে কখনোই মানুষ মনে হতো না- তাকে দৈত্যের মতো মনে হতো।
উত্তর ইরাকের সিনজারে হামলা চালিয়ে মেয়েদের অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে যৌনদাসী হিসেবে লোভী সৈনিকদের ব্যবহারের সিদ্ধান্ত স্বতঃস্ফূর্ত ছিল না।
তারা কীভাবে অামাদের বাড়িতে আসবে সে ব্যাপারে ইসলামিক স্টেট (আইএস) সব পরিকল্পনা করেছিল। তারা আমাদের বাড়িতে এসে মেয়েদের ধরে নিয়ে যেতো। যুদ্ধক্ষেত্রে আইএস জঙ্গিদের পুরস্কার হিসেবে মেয়েদের যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহারের জন্য ধরে নিয়ে যাওয়া হতো। এমনকি নতুন সদস্যদের নিয়োগে মনযোগ কাড়তে তাদের প্রচারণা ম্যাগাজিন দাবিকে এ ব্যাপারে আলোচনা করতো।
আরও পড়ুন : আইএসের যৌনদাসী থেকে জাতিসংঘের শুভেচ্ছা দূত
কিন্তু সদস্যরা আইএসের ব্যাপারে যে চিন্তা-ভাবনা করে; মূলত তারা সেরকম নয়। ধর্ষণকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে তারা। এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার আগে আমি কখনোই চিন্তা করিনি যে, রুয়ান্ডার নারীরা একই ধরনের নিপীড়নের শিকার হয়েছে। এমনকি আমি জানতামও না যে, রুয়ান্ডা নামে একটি দেশ আছে। কিন্তু এখন সবচেয়ে খারাপভাবে আমি তাদের সঙ্গে মিলে যাচ্ছি। সিনজারে আইএস আসার আগে যুদ্ধাপরাধের একজন ভিক্টিম হিসেবে আমার পক্ষে এটা বলা কঠিন ছিল যে, বিশ্বে মাত্র ১৬ বছর বয়সের আগে এ ধরনের অপরাধের শিকার হননি কেউই।
নিচ তলায়, এক জঙ্গি বসতো। সে একটি খাতায় আমাদের নাম তালিকাভুক্ত করতো; পাশাপাশি কোন জঙ্গি আমাদের নিয়ে যাচ্ছে তার নামও লিখে রাখতো। সালওয়ান আমাকে নিয়ে যেতো। আর আমি ভাবতাম, তার মতো শক্তিশালী এক জঙ্গি শূন্য হাতে কীভাবে আমার সর্বনাশ করতো। সে যাই করুক না কেন, আমি বারবার প্রতিরোধের চেষ্টা করেছি। কিন্তু অামি তাকে পরাস্ত করতে পারতাম না। তার শরীর থেকে পচা ডিমের মতো গন্ধ বের হতো।
আমি মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আমার আশপাশে চলাচল করা জঙ্গি এবং মেয়েদের পায়ের গোড়ালি দেখতাম। জনতার ভিড়ে আমি পুরুষের এক জোড়া জুতা ও পায়ের গোড়ালি দেখতে পেতাম; যা প্রায় হাড্ডিশার এবং নারীসূলভ। কি করতে যাচ্ছি সে ব্যাপারে কোনো চিন্তা-ভাবনা না করেই আমি সেই পায়ে নিজেকে সোপর্দ করতাম। তার কাছে ভিক্ষা চাইতাম।
আমি বলতাম, ‘দয়া করে, আমাকে তোমার সঙ্গে নিয়ে যাও। তোমার যা ইচ্ছা করিও, তবুও আমি এই দৈত্যের সঙ্গে যেতে চাই না। আমি জানি না কেন এই হ্যাংলা পাতলা লোকটি রাজি হয়েছিল। কিন্তু অনুরোধ জানানোর পর সে আমাকে একনজর দেখে নিতো। পরে সে সালওয়ানের কাছে গিয়ে বলতো, এই মেয়েটি আমার। সালওয়ান কোনো তর্ক-বিতর্ক করতো না। হাড্ডিসার এই লোকটি ছিল মসুলের বিচারক; কেউ তার অবাধ্য হতো না। আমি পিছু পিছু তার ডেস্ক পর্যন্ত যাইতাম।
সে আমাকে জিজ্ঞাসা করতো, তোমার নাম কি? সে নরম করে কথা বলতো, কিন্তু নিষ্ঠুর ভাষায়। আমি প্রশ্নের জবাবে বলতাম, নাদিয়া। সে খাতায় লিখে রাখতো। এই লোকটি অন্যান্য জঙ্গিদের নামে চিনতো। সে অামাদের নাম বলতো এবং খাতায় লিখে রাখতো- নাদিয়া, হাজি সালমান। যখন সে আমাদের জিম্মাদারের নাম বলতো, তখন তার কণ্ঠে কিছুটা দ্বিধা বোঝা যেতো। আমার মনে হতো সে ভীত। আমি বড় ধরনের অপরাধ করেছি কি-না সেটি ভাবতাম আর বিস্মিত হতাম।
নাদিয়া মুরাদ অবশেষে বন্দিদশা থেকে পালিয়ে এসেছিলেন। পরে তিনি ইরাকের বাইরে চলে যান। ২০১৫ সালের শুরুর দিকে জার্মানির একটি শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেন তিনি। ওই বছরের শেষের দিকে তিনি মানবপাচারের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করতে প্রচারণা শুরু করেন।
‘আমার আদি বাসস্থান ইরাকের কোচো শহরে আইএস আসার এক বছর তিন মাস পর ২০১৫ সালের নভেম্বরে আমি জাতিসংঘের এক অধিবেশনে সংখ্যালঘু ইস্যুতে বক্তৃতা করার জন্য জার্মানি থেকে সুইজারল্যান্ডে যাই। এই প্রথম আমি বিশাল দর্শক-শ্রোতার সামনে আমার গল্প বলবো। আমি সব বিষয়ে কথা বলতে চাই- সেসব শিশুদের কথা বলতে চাই, যারা আইএসের হামলা থেকে বাঁচতে পালাতে গিয়ে পানিশূন্যতায় মারা গেছেন। আমি পর্বতে আটকে পরা পরিবার, জিম্মিদশায় থাকা হাজার হাজার নারী ও শিশু এবং সিনজারে নৃশংস গণহত্যার শিকার মানুষের কথা তুলে ধরতে চাই।’
আমি নির্যাতনের শিকার হাজার হাজার ইয়াজিদিদের একজন মাত্র। আমার সম্প্রদায়ের মানুষজন এখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। ইরাক এবং ইরাকের বাইরে তারা শরণার্থী হিসেবে বসবাস করছে। কোচো এখনো আইএসের দখলে রয়েছে। ইয়াজিদিদের সঙ্গে যা ঘটছে সেব্যাপারে বিশ্বের এখনো অনেক কিছু শোনার আছে।
আরও পড়ুন : বিয়ের দিনে কনের সাজে প্রেমিকের কবরে প্রেমিকা
‘‘আমি তাদের বলতে চাই যে, ইয়াজিদিদের জন্য অনেক কিছু করা প্রয়োজন। ইরাকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। তাদের নৃশংসতাকে যারা সমর্থন দিয়েছে; তারা নেতা কিংবা সাধারণ নাগরিক হোক না কেন, গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তাদের বিচার করতে হবে। পুরো সিনজার উপত্যকাকে মুক্ত করতে হবে।’’
আমি দর্শকমণ্ডলীকে হাজি সালমানের ব্যাপারে জানাতে চাই। সে আমাকে ধর্ষণ করেছে এবং আমার ওপর নিপীড়ন চালিয়েছে। সংক্ষেপিত।
— নাদিয়া মুরাদ। ২০১৪ সালের আগস্টে ইরাকের উত্তরাঞ্চলের সিনজার প্রদেশের কোচো গ্রামে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস হামলা চালিয়ে ইয়াজিদি নারীদের অপহরণ করে; এই নারীদের মধ্যে নাদিয়া মুরাদও ছিলেন। আইএস তার ছয় ভাই ও বোনকেও ধরে নিয়ে যায়। পরিবারের সবাইকে হত্যা করে আইএস। কিন্তু নাদিয়া মুরাদ আইএসের যৌন আস্তানা থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হন। কঙ্গোর ধাত্রীবিদ্যাবিশারদ ডেনিস মুকওয়েজির সঙ্গে চলতি বছরের শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জিতেছেন তিনি।
>>ভিরাগোতে প্রকাশিত নাদিয়া মুরাদের জীবনী ‘দ্য লাস্ট গার্ল : মাই স্টোরি ও অব ক্যাপটিভিটি অ্যান্ড মাই ফাইট অ্যাগেইনস্ট দ্য ইসলামিক স্টেট অবলম্বনে সাইফুজ্জামান সুমন।
এসআইএস/জেআইএম