ভিডিও EN
  1. Home/
  2. আন্তর্জাতিক

‘শুধু আনন্দের জন্য’ যৌনমিলনের বিরোধী ছিলেন গান্ধী

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | প্রকাশিত: ০৩:২৬ এএম, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী চাইতেন - শুধু আনন্দের জন্য যৌনমিলন করাকে নারীরা যেন প্রতিরোধ করে। তার মতে নর-নারীর যৌনসম্পর্ক হবে শুধু সন্তান উৎপাদনের জন্য যতটুকু দরকার - ততটুকুই।

একজন আমেরিকান জন্মনিয়ন্ত্রণকর্মী এবং যৌন শিক্ষাবিদ মার্গারেট স্যাঙ্গারের সঙ্গে ১৯৩৫ সালে গান্ধীর যে কথোপকথন হয়েছিল - তার সম্প্রতি-প্রকাশিত বিবরণ থেকে এসব জানা গেছে।

শুধু তা-ই নয়, গান্ধী নিজেই আত্মজীবনীতে লিখেছেন, তার পিতা যখন মারা যান - তখন তিনি তার স্ত্রীর সাথে যৌনমিলন করছিলেন বলে পিতার পাশে থাকতে পারেন নি - এই অপরাধবোধ তাকে তাড়া করেছিল বহু দিন।

সম্প্রতি গান্ধীর এক নতুন জীবনীগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে যা লিখেছেন ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ। এ বইতে নারী অধিকার, যৌনতা এবং কৌমার্য বিষয়ে গান্ধীর ভাবনা উঠে এসেছে। মার্গারেট স্যাঙ্গারের সঙ্গে গান্ধীর কথোপকথনের বিস্তারিত নোট নিয়েছিলেন গান্ধীর সচিব মহাদেব দেশাই।

তিনি লিখছেন-মনে হচ্ছিল দুজনই একমত যে নারীর মুক্তি হওয়া উচিত - তার নিজের ভাগ্যের নিয়ন্তা হওয়া উচিত - কিন্তু খুব দ্রুতই তাদের মধ্যে মতভেদ দেখা গেল।

স্যাঙ্গার ১৯১৬ সালের নিউইয়র্কে খুলেছিলেন আমেরিকার প্রথম পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র। তিনি মনে করতেন, জন্মনিরোধকই হচ্ছে নারীর মুক্তির সবচেয়ে নিরাপদ পথ। কিন্তু গান্ধী বলেছিলেন, পুরুষদের উচিত তার জান্তব কামনাকে সংযত করা, আর নারীদের উচিত তাদের স্বামীদের বাধা দেয়া। তিনি স্যাঙ্গারকে বললেন, যৌনক্রিয়া করা উচিত শুধু সন্তান উৎপাদনের জন্যই।

সেবছর ভারতের ১৮টি শহরে সফর করেছিলেন স্যাঙ্গার, কথা বলেছিলেন ডাক্তার ও কর্মীদের সাথে। কথাবার্তার বিষয়বস্তু ছিল - জন্ম নিয়ন্ত্রণ এবং নারীমুক্তি। তিনি মহারাষ্ট্র রাজ্যে গান্ধীর আশ্রমেও গিয়েছিলেন এবং সেখানেই তার সঙ্গে স্যাঙ্গারের এই কৌতুহলোদ্দীপক আলোচনা হয়। তবে গান্ধীর মতামত শুনেও স্যাঙ্গার দমে যাননি না। তিনি বিতর্ক চালিয়ে গিয়েছিলেন।

‘কিন্তু নারীরও তো গভীর যৌন অনুভুতি আছে, তারা পুরুষের মতোই গভীর এবং তীব্র। এমন সময় আছে যখন নারীরাও ঠিক তাদের স্বামীদের মতোই শারীরিক মিলন চায়। আপনি কি মনে করেন যে যখন একজন নারী ও পুরুষ পরস্পরের প্রেমে আবদ্ধ এবং সুখী, তখন তারা শুধু বছরে দু’একবার যখন সন্তান চাইবে তখনই যৌনমিলন করবে - এটা কি সম্ভব?’ প্রশ্ন করেন স্যাঙ্গার।

গান্ধী যুক্তি দিলেন - ঠিক এই ক্ষেত্রেই জন্মনিয়ন্ত্রণ খুবই সুবিধাজনক যা নারীকে অবাঞ্ছিত গর্ভধারণ থেকে রক্ষা করবে এবং তার দেহের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে।

জানা যায়, স্যাঙ্গারের একের পর যুক্তির বাণে গান্ধী একগুঁয়েভাবে তার বিরোধিতা করতে থাকেন। তিনি স্যাঙ্গারকে বলেন, তিনি সব যৌনতাকেই ‘কামনা’ বলে মনে করেন।

গান্ধী স্যাঙ্গারকে বলেছিলেন-তার স্ত্রী কস্তুরবার সাথে তার সম্পর্ক তখনই ‘আধ্যাত্মিক’ হয়ে উঠেছিল যখন তিনি ‘শারীরিক কামনার জীবনকে বিদায় দিয়েছিলেন।’

১১১৯ পাতার এই বইয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত শান্তিবাদী নেতার ১৯১৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে প্রত্যাবর্তন থেকে শুরু করে ১৯৪৮ সাথে তার নিহত হওয়া পর্যন্ত সময়কালকে তুলে ধরা হয়েছে।

গান্ধী বিয়ে করেছিলেন মাত্র ১৩ বছর বয়েসে। এরপর ৩৮ বছর বয়সে যখন তিনি চার সন্তানের পিতা, তখন তিনি ‘ব্রহ্মচর্য বা যৌনসম্পর্কবিরহিত জীবনযাপন শুরু করেন।

নতুন জীবনীতে জানা গেছে, মার্গারেট স্যাঙ্গারের সঙ্গে কথাবার্তার শেষ দিকে গান্ধী তার সাথে কিছুটা একমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, পুরুষের স্বেচ্ছামূলক বন্ধ্যাকরণে তার আপত্তি নেই, কারণ পুরুষই মুখ্য ভুমিকা নেয়। তা ছাড়া গর্ভনিরোধক ব্যবহারের চাইতে প্রতিমাসে নারীর যে ‘নিরাপদ সময়’ থাকে তখন স্বামী-স্ত্রী যৌনমিলন করতে পারে।

তবে স্যাঙ্গারের এসব যুক্তি খুব পছন্দ হয়নি। তার ভাবনাকে গান্ধী যে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন এতে তিনি গভীরভাবে মর্মাহত হয়েছিলেন। তিনি পরে লিখেছিলেন, প্রবৃত্তিকে প্রশ্রয় দেয়া এবং অবাধ যৌনাচার সম্পর্কে গান্ধীর প্রচন্ড ভীতি আছে।

গান্ধী একবার একজন নারী-অধিকার কর্মীকে বলেছিলেন- আপনি কি মনে করেন যে জন্মনিরোধক দিয়ে শরীরের স্বাধীনতা পাওয়া সম্ভব? নারীদের বরং শেখা উচিত কীভাবে তাদের স্বামীদের ঠেকাতে হয়। পশ্চিমা দেশের মতো গর্ভনিরোধক ব্যবহার করলে ভয়াবহ পরিণতি হবে, নারী আর পুরুষ বাঁচবে শুধু যৌনতার জন্য, তাদের মস্তিষ্ক হবে দুর্বল। নীতিবোধ ভেঙে পড়বে।

‘দি ইয়ার্স দ্যাট চেঞ্জড দি ওয়ার্ল্ড’ নামের বইটিতে রামচন্দ্র গুহ বলছেন, গান্ধী মনে করতেন যৌনতা হচ্ছে ‘জান্তব কামনা’ মাত্র, যা বংশবৃদ্ধির জন্য দরকার। আর জন্মনিয়ন্ত্রণ এই জান্তব কামনাকে বৈধতা দিয়ে দিচ্ছে।

তিনি লিখেছেন- অনেক বছর পর বঙ্গ প্রদেশের নোয়াখালীতে ভারত ভাগকে কেন্দ্র করে যখন ভয়াবহ হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা চলছিল - তখন গান্ধীকে এক বিতর্কিত পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়েছিল। তিনি তার নাতনি এবং সর্বক্ষণের সঙ্গী মানু গান্ধীকে বললেন, তার সঙ্গে একই বিছানায় ঘুমাতে। তিনি এটা পরীক্ষা করতে চাইছিলেন যে, তিনি তার যৌন আকাঙ্খাকে সম্পূর্ণ জয় করতে পেরেছেন কিনা।

গুহ লিখছেন- গান্ধী মনে করতেন, তিনি যে পরিপূর্ণ ব্রহ্মচারী হতে ব্যর্থ হয়েছেন তার সাথে ভারতের ধর্মীয় সংঘাতের একটা সম্পর্ক আছে। তবে মানু গান্ধীকে নিয়ে ঘুমানোর পরীক্ষার কথা যখন গান্ধী তার সহযোগীদের বললেন, তখন তারা সতর্ক করেছিলেন যে, তিনি যেন এটা না করেন এবং এতে তার সুনাম ক্ষুণ্ণ হবে।

একজন সহকারী বলেছিলেন, এটা দুর্বোধ্য এবং সমর্থনের অযোগ্য। আরেক জন এর প্রতিবাদে গান্ধীর সঙ্গে কাজ করা ছেড়ে দিয়েছিলেন।

স্পষ্টতই নারীদের সঙ্গে গান্ধীর সম্পর্ক ছিল জটিল। যে নারীরা পুরুষদের কাছে নিজেদের আকর্ষণীয় করার চেষ্টা করে তাদের তিনি দেখতে পারতেন না। আধুনিক চুলের স্টাইল এবং পোশাক সম্পর্কে তার ছিল তীব্র ঘৃণা। তিনি মুসলিম নারীদের বোরকারও বিরোধী ছিলেন।

অন্যদিকে, তিনি আবার নারীদের শিক্ষা, কাজ করার অধিকার এবং নারীপুরুষের সাম্যেরও সমর্থক ছিলেন। তিনি নারীদের সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনে যুক্ত করেছিলেন, সরোজিনী নাইডুকে কংগ্রেসের নেত্রী বানিয়েছিলেন - যখন পশ্চিমা দেশেও নারী রাজনৈতিক নেত্রী ছিলেন খুবই কম।

তবে গান্ধী এটাও মনে করতেন যে, সন্তান লালন-পালন এবং গৃহকর্ম নারীদেরই কাজ। তার একজন সহযোগী বলেছিলেন, তার মানসিকতা ছিল অনেকটা মধ্যযুগের খ্রীষ্টান সন্তদের বা জৈন সাধুদের মতো।

ইতিহাসবিদ প্যাট্রিক ফ্রেঞ্চ বলেছিলেন, গান্ধীর চিন্তাধারা প্রাচীন হিন্দু দর্শনে প্রোথিত মনে হলেও, আসলে তিনি ছিলেন ইংল্যান্ডের ভিক্টোরিয়ান যুগের একজন প্রতিভূ।

রামচন্দ্র গুহ লিখেছেন- আজকের মাপকাঠিতে বিচার করলে গান্ধীকে রক্ষণশীল বলা যায়, তবে তার নিজ সময়ের বিচারে তিনি নিঃসন্দেহে প্রগতিশীল ছিলেন। বিবিসি

এসআর

 

আরও পড়ুন