যেখানে টাকা দিয়ে বউ কেনা যায়
টাকা বেচাকেনার মাধ্যম। যেকোনো পণ্য কিনতে টাকা লাগবেই। কথায় আছে-টাকায় বাঘের দুধও মেলে। তবে টাকা দিয়ে এবার ভোগ্যপণ্য, প্রসাধন সামগ্রী বা বিলাস বহুল বাড়ি-গাড়ি নয়, নগতে বউ মিলবে। অল্পবয়সী মেয়েদের টাকার বিনিময়ে বিক্রি করার মতো ভয়াবহ ঘটনা নাইজেরিয়ার একটি সম্প্রদায়ের জন্য নিত্যদিনের ব্যাপার।
নাইজেরিয়ার সর্বদক্ষিণের ক্রস রিভার রাজ্যের বেশেরে সম্প্রদায়ে মানি ম্যারেজ বা অর্থের বিনিময়ে অল্পবয়সী মেয়েদের বিয়ের নামে বিক্রি করে দেয়া একটি প্রচলিত প্রথা। মূলত দারিদ্র্যপীড়িত পরিবারের শিশুদের বিয়ের নামে মোটা অঙ্কের বিনিময়ে কিনে নেয় প্রভাবশালীরা।
দেশটির আরও কয়েকটি সম্প্রদায়ের মধ্যে এখনও এ ধরনের বিতর্কিত প্রথার চল রয়েছে। যেখানে বিক্রি হওয়া মেয়েটির না থাকে কোনো স্বাধীনতা বা শিক্ষা/চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ। স্থানীয় ধর্মীয় নেতারা এই প্রথার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালালেও কোনো লাভ হচ্ছে না।
সেই সম্প্রদায়ের তরুণী ডরফি। তার বয়স এখন প্রায় বিশের কোটায় হলেও তাকে যখন বিয়ে দেয়া হয়েছিল তার বয়স ছিল মাত্র ১০-১১ বছর। ওই বয়সে তাকে এমন এক ব্যক্তির হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল যার বয়স কিনা তার নানা-দাদার চাইতেও বেশি।
ডরফির আপন মা ও চাচা টাকার জন্য তাকে ওই বৃদ্ধের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল। বাধ্য করেছিল মানি ম্যারেজ করতে। এখনও সেই দিনগুলোর কথা মনে করে ভয়ে শিউরে ওঠেন ডরফি। তিনি জানান, লোকটি আমার সঙ্গে শুতে চাইলে আমি বলতাম- না, আমি এমনটা হতে দেব না, কারণ আপনি আমার বয়সের না। আপনার ছেলেমেয়েরাও আমার অনেক বড়। যখন আমি মানা করতাম, তখন সে আরও দুইজন লোক ডেকে আমার ওপর জবরদস্তি করত।
এভাবেই অমানুষিক নির্যাতনের এক পর্যায়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন ডরফি। অথচ সন্তান ধারণ করার মতো বয়সও তখন তার হয়নি। মানি ওয়াইফ বা অর্থের বিনিময়ে বিক্রি হওয়া বউ হওয়ায় ডরফির যেন সাহায্য চাওয়ারও কোনো জায়গা ছিল না।
বেশেরে সম্প্রদায়ে মূলত দুই ধরনের বিয়ে রয়েছে। একটি হলো লাভ ম্যারেজ বা ভালোবাসার বিয়ে এবং অপরটি এই মানি ম্যারেজ।
লাভ ম্যারেজে স্ত্রীর জন্য কোনো পণ দিতে হয় না। নববধূ স্বাধীনভাবে বাবার বাড়ি আসতে যেতে পারে এবং তার ঘরে যে সন্তান জন্ম নেবে সেটা মায়ের পরিবারের উত্তরসূরি হিসেবে বিবেচিত হয়।
কিন্তু মানি ম্যারেজে কমবয়সী মেয়েদের বিক্রি করে দেয়ায় তারা তাদের স্বামীর পরিবারের সম্পত্তিতে পরিণত হয়। এমনটাই জানান স্থানীয় মিশনারি ও শিশু অধিকার আন্দোলনকারী পস্তোর রিচার্ড।
তিনি বলেন, ‘একজন মানি ওম্যানের (অর্থের বিনিময়ে বিক্রি নারী) কোনো সম্মান থাকে না। তাদের স্কুলে যাওয়ার অনুমতি নেই, তাদেরকে ঠিকঠাক খেতেও দেয়া হয় না। সে সবার উচ্ছিষ্ট খায়। তারা শিশুশ্রম থেকে শুরু করে অমানবিক যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। অনেকে অন্তঃসত্ত্বা হলেও মায়ের বাড়ি যাওয়ার সুযোগ পায় না।’
এই সম্প্রদায়েরই আরেকজন সদস্য মনিকা। তিনি থাকেন গাছপালা বেষ্টিত একটি এলাকায় যার চারপাশ উঁচু পাহাড় আর সবুজের গালিচায় ছাওয়া। তবে সেই সুন্দরের ছোঁয়া মনিকার পরিবারে নেই। তিনি তার দুই নাতনিকে খুব ছোট থাকতেই মানি ম্যারেজের জন্য বিক্রি করে দিয়েছেন।
এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘পরিবারকে জুজু নামের অভিশাপ থেকে রক্ষা করতে মোটা অঙ্কের অর্থ দরকার ছিল। আর এজন্যই তিনি নাতনিদের বিক্রি করে দিয়েছিলেন।’
তবে এক বছর পর সেই সিদ্ধান্তের জন্য ভীষণ অপরাধবোধে ভুগছেন মনিকা। তার নাতনি হ্যাপিনেসের এখন বয়স ১৫ বছর। গত বছর সে তার মানি ম্যারেজ থেকে পালিয়ে এসেছে। হ্যাপিনেস জানান, ওই লোকটার এতোই বয়স যে, তার নাতি-নাতনির ঘরেও সন্তান রয়েছে। লোকটা প্রায়ই আমাকে মারত আর বলত- আমাকে যদি সে পিটিয়ে মেরেও ফেলে তাকে কেউ কিছু বলতে পারবে না। আমাকে মেরেও ফেললেও তার কিছু হবে না। কারণ আমি তার মানি ওয়াইফ।
ওই ঘটনার কারণে মনিকার সঙ্গে তার দুই মেয়ে ও দুই নাতনির সম্পর্ক আজও স্বাভাবিক হয়নি। এখনও দাদির প্রতি তীব্র ক্ষোভের কথা জানান হ্যাপিনেস।
‘আমি আমার দাদিকে একটা মেসেজ পাঠিয়েছি। সেখানে আমি লিখেছি- যদি আমি মারা যাই এবং সে যদি আমার শেষকৃত্যে আসে, মোটরসাইকেলে চড়ে। তাহলে একটা দুর্ঘটনায় তার হাত পা ভেঙ্গে যাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যেদিন আমি স্বামীর বাড়ি ছেড়ে এলাম, সেদিন তাকে আমি বলেছি- কোনোদিন আমি এতটাই রেগে যাব যে, আমি একটা ছুরি নিয়ে তাকে খুন করে ফেলতে পারি।’
তবে এই সম্প্রদায়ের প্রধান চিভসামদে চিলে জানান, এখন মানি ওয়াইফ প্রথার কোনো অস্তিত্ব নেই। যাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে তাদের কাউকে মানি ওয়াইফ হিসেবে বিয়ে করা যায় না।
তিনি বলেন, ‘এখনও অনেক মানুষ মনে করে যে বেশেরে সম্প্রদায়ে এখনও মানি ম্যারিজ হয়ে থাকে। কিন্তু এখন আর এসব হয় না। এটা নব্বই দশকের শুরুর দিকেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে।’
তবে বাস্তব চিত্র পুরোই উল্টো। দুর্ভাগ্যবশত বেশেরের বেশিরভাগ গ্রাম প্রধানকেই মানি ওয়াইফ রাখতে দেখা যায়। মানি ম্যারেজের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন পাস্তোর রিচার্ড। তিনি বিদ্রূপের সুরে বলেন, এই মানি ম্যারেজের ঘটনা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেও গ্রাম প্রধানরা বলবে- এই বিয়ে সবশেষ হয়েছিল সেই ১৯৯৯ সালে। অথচ কয়েকদিন আগেই আমরা ১৭ বছর বয়সী একটি মেয়েকে উদ্ধার করেছি।
২০০৯ সালেই নাইজেরিয়া থেকে মানি ম্যারেজ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হলেও দায়ীদের কাউকে শাস্তির আওতায় আনা হয়নি। এ ধরনের প্রথাকে নিশ্চিহ্ন করতে পাস্তর রিচার্ডের মতো আরও অনেক আন্দোলনকারী কাজ করে যাচ্ছে।
তবে এখনও মানি ওয়াইফ রাখা সামাজিক মর্যাদার বিষয় হয়ে দাঁড়ানোয় আর এই প্রথা বিলুপ্তির কোনো আভাস দেখা যাচ্ছে না। হ্যাপিনেসকে যখন বিয়ে দেয়া হয় তখন সে ছিল নিতান্তই শিশু।
দিনে দিনে দাদির প্রতি তার ক্ষোভ অনেকটাই হালকা হয়ে এসেছে। এখন তার দাদিকে দেখলেই করুণা হয়। তিনি বলেন, ‘যখন আমি তাকে দেখি, অনেক খারাপ লাগে। আমি দোয়া করেছি যেন তার দোষ সব মাফ করে দেয়া হয়। কারণ সে সময় তিনি জানতেন না যে তিনি কী করছেন?’
সূত্র: বিবিসি
এসআর/পিআর