যেভাবে রাখাইনে রোহিঙ্গা নির্যাতনের তদন্ত করেছে জাতিসংঘ
জাতিসংঘের তদন্তকারী জানিয়েছেন মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সেনাবহিনীর অপরাধের মাত্রা এতটাই বেশি যে তাদের বিরুদ্ধে গণহত্যার তদন্ত হওয়া উচিত।
এ সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদনে তারা উল্লেখ করেছেন সেখানে রোহিঙ্গা মুসলিমদেরকে নির্বিচারে হত্যা, গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া, শিশু নির্যাতন, গণধর্ষণ সবই হয়েছে। যা ‘আন্তর্জাতিক আইনে সবচাইতে গুরুতর অপরাধ। তবে মিয়ানমার সরকার এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
বিবিসি জানিয়েছে জাতিসংঘের তদন্ত মিশন রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর কী ঘটছে - তা জানার জন্য সেখানে প্রবেশের অনুমতি পেতে মিয়ানমার সরকারকে তিনবার চিঠি দিয়েছিল তারা। কিন্তু তার কোনো জবাব দেয়নি মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ।
জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের তদন্ত মিশন জানিয়েছে মিয়ানমারে সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সাম্প্রতিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা জানতে ফ্যাক্টফাইন্ডিং মিশন গঠনের মধ্যে দিয়ে শুরু হয়েছিল তদন্ত প্রক্রিয়া। কিন্তু সেই মিশন গঠনের পাঁচ মাস পরই রাখাইনে একাধিক পুলিশ ফাঁড়িতে সশস্ত্র রোহিঙ্গাদের আক্রমণের অভিযোগে ওই রাজ্যে ব্যাপক নিষ্ঠুর অভিযান শুরু করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এর পর জাতিসংঘের তদন্তের মূল কেন্দ্রবিন্দুই হয়ে দাঁড়ায় এই ঘটনা।
গত বছরের আগস্টে শুরু হওয়া ওই অভিযানের কারণে এ পর্যন্ত ১২ মাসে কমপক্ষে ৭ লাখ ২৫ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন।
ফলে মিয়ানমারে ঢুকতে না পারলেও সেখানে কী ঘটেছে তা জানতে ভুক্তভোগিদের পাওয়া কঠিন হয়নি তদন্তকারীদের জন্য।
মিয়ানমার ছেড়ে পালানোর আগে সেখানকার সহিংসতা নিজে দেখেছেন এমন অসংখ্য লোকের কাছ থেকে বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া গেছে।
তদন্তকারীরা বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া এবং যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত মোট ৮৭৫ জনের সঙ্গে কথা বলেছেন।
তারা সিদ্ধান্ত নেন, যারা তাদের কাহিনি এর আগে আর কাউকেই বলেন নি - তাদের বিবরণকেই সবচেয়ে মূল্যবান বলে গণ্য করা হবে।
রাখাইনে পুড়িয়ে দেয়া একটি রোহিঙ্গা গ্রাম।
অস্ট্রেলিয়ার মানবাধিকার আইন বিশেষজ্ঞ ক্রিস্টোফার সিদোতি জানান, ‘যারা ইতোমধ্যেই অন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলেছেন, তাদের সাক্ষাতকার আমরা নিতে চাইনি। তা ছাড়া আমরা শুধুমাত্র একটি বর্ণনাকে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করিনি’।
তিনি জানান, প্রত্যক্ষদর্শীরা যা বলেছেন - তার সঙ্গে একই সময়কার ঘটনা বর্ণনাকারী অন্য শরণার্থীদের দেয়া তথ্য মিলিয়ে দেখেছেন তারা।
আরও প্রমাণ হিসেবে যেসব সূত্র ব্যবহার করা হয়েছে তার মধ্যে আছে ভিডিও, আলোকচিত্র, দলিলপত্র, উপগ্রহ চিত্র ইত্যাদি। এগুলোর ঘটনাস্থল ও সময় প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়েছে।
উপগ্রহ চিত্রে দেখা গেছে উত্তর রাখাইন রাজ্যে ৩৯২টি গ্রাম আংশিক বা সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। ওই এলাকার ৩৭ হাজার বাড়ি - যা মোট বাড়ির প্রায় ৪০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরমধ্যে ৮০ শতাংশই পুড়িয়ে দেয়া হয় সামরিক অভিযানের প্রথম তিন সপ্তাহের মধ্যেই।
তবে এই বর্বরতার ছবি বা ভিডিও প্রমাণ পাওয়াটা ছিল বেশ কঠিন। কারণ রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে যাওয়াদের পথে তল্লাশি করে টাকা পয়সা, স্বর্ণালংকার, মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়া হয়।
মি. সিদোতি বলেন, এর উদ্দেশ্য ছিল যাতে লোকে কোনো ভিডিও বা ছবি যেন নিয়ে যেতে না পারে।
রাখাইনে মিয়ানমারের সেনাদের অভিযান
রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে এজন্য দেশটির কমান্ডার ইন-চিফ মিন অং লাইং ও তার ডেপুটিসহ ছয় ঊর্ধতন সেনা কর্মকর্তার বিচার হওয়া উচিত।
সিদোতির দাবি, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এতই কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে যে কমান্ডার ইন-চিফ এবং তার অধস্তনদের অজ্ঞাতসারে কিছুই ঘটতে পারে না।
তিনি জানান, যারা এই নৃশংসতার আদেশ দিয়েছেন এবং যেসব সেনা সদস্য এতে অংশ নিয়েছে - তাদের অনেকের নামই পাওয়া গেছে, তবে তা এখনই প্রকাশ করা হচ্ছে না।
এমএমজেড/জেআইএম