যে বই নিয়ে তোলপাড় ভারত-পাকিস্তান
ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এবং পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ‘আইএসআই’-এর দুই সাবেক প্রধান একসঙ্গে মিলে একটি বই লেখার পর তা নিয়ে দুই দেশেই তীব্র বিতর্ক শুরু হয়েছে। দ্য স্পাই ক্রনিকলস নামে ওই বইটিতে কোনও গোপন তথ্য ফাঁস হয়েছে কিনা, তা নিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ইতোমধ্যেই বইটির অন্যতম লেখক জেনারেল আসাদ দুরানির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে। শুধু তাই নয় তার বিদেশে যাওয়ার ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
বইটির আর এক লেখক ‘র’-এর সাবেক প্রধান এ এস দুলাত জানিয়েছেন, তারা দু’জনেই অনেক বছর আগে অবসর নিয়েছেন। তাই বইটিতে সাম্প্রতিক কোনও গোয়েন্দা তথ্য ফাঁস করার প্রশ্নও নেই। তবে তার পরও অ্যাবোটাবাদে ওসামা বিন লাদেনের বিরুদ্ধে অভিযান থেকে শুরু করে পোখরানে পরমাণু বিস্ফোরণ-এরকম বহু বিষয়ে এই বইয়ের বক্তব্য নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানে তুমুল আলোচনা চলছে।
র এবং আইএসআই-এর দুজন সাবেক প্রধান যে মুখোমুখি বসে বিভিন্ন স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করতে পারেন এবং তাদের সেই কথাবার্তা বইয়ের আকারে প্রকাশিত হতে পারে-এই ভাবনাটাই প্রায় অকল্পনীয়।
কিন্তু দিল্লির সাংবাদিক আদিত্য সিনহা সেটাকেই সম্ভব করেছেন, প্রায় তিন বছর ধরে জেনারেল আসাদ দুরানি ও অমরজিৎ সিং দুলাতকে নিয়ে ব্যাংকক, ইস্তাম্বুল, কাঠমান্ডুর মতো বিভিন্ন তৃতীয় দেশের শহরে তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা বৈঠক করিয়ে সেই আলোচনার নির্যাস প্রকাশ করেছেন দ্য স্পাই ক্রনিকলস বইটিতে।
দুলাত জানিয়েছেন, বৈঠকগুলোর সময়েও তিনি তার চেয়ে সিনিয়র জেনারেল দুরানিকে বস বলে ডাকতেন। কিন্তু বস ঠাট্টা করে বলতেন, এ এতো হারামি-যে আমাকে বস বলে ডাকে কিন্তু তার পর কোনও ব্যাপারেই আমার সঙ্গে একমত হয় না।’
অর্থাৎ বইটা হালকা আড্ডার চালে লেখা হয়েছে বলে তিনি বোঝাতে চাইলেও বিশেষ করে পাকিস্তানে এই বইয়ের বক্তব্য নিয়ে তুমুল প্রতিক্রিয়া হয়েছে। যেমন, বইটিতে জেনারেল দুরানি লিখেছেন সম্ভবত পাকিস্তানি গোয়েন্দারাই বিন লাদেনকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দিয়েছিল-যা পাকিস্তানের সরকারি অবস্থানের ঠিক উল্টো।
ভারতের পোখরান পরমাণু বিস্ফোরণের নির্দিষ্ট খবর পাকিস্তানের কাছে ছিল না বলেও তিনি বইটিতে স্বীকার করেছেন।তিনি একটি ভারতীয় চ্যানেলকে বলেন, বিজেপি যখন প্রথমবার ভারতের ক্ষমতায় আসে তখনই আমি প্রকাশ্যে বলেছিলাম তারা পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটাবে। কারণ ঘটনাপ্রবাহ সেদিকেই এগোচ্ছে। তবে এটাও ঠিক পোখরান অঞ্চলের ওপর আমরা নজর রাখছিলাম না আর তার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামও আমাদের কাছে ছিল না।
গতকালই পাকিস্তান সেনা সদর দফতরে জেনারেল দুরানিকে ডেকে পাঠিয়ে এই বইটির ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। একটি তদন্ত কমিটিও তৈরি করা হয়েছে। আগামী সপ্তাহে দিল্লির একটি থিঙ্কট্যাঙ্কে বইটি নিয়ে আলোচনা করতে তার ভারতে আসার কথাও ছিল, আপাতত সেই সফরও বাতিল করা হয়েছে।
সে দেশের অনেক রাজনীতিকই মনে করছেন তারা এরকম কোনও বই লিখলে এতক্ষণে তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা শুরু হয়ে যেত। সাবেক সেনা কর্মকর্তা আমাদ দুরানি বরং অল্পের মধ্যেই পার পাচ্ছেন।
ভারতে বইটির সহ-লেখক এ এস দুলাত দাবি করছেন এই বইতে গোয়েন্দা তথ্য ফাঁস করার অভিযোগটাই আসলে ভিত্তিহীন। তার কথায়, গোয়েন্দা সংস্থা থেকে আমি অবসর নিয়েছি আঠারো বছর আগে, ফলে আমাকে বলতে পারেন গোয়েন্দার ফসিল।
জেনারেল দুরানি তো আইএসআই প্রধান ছিলেন ছাব্বিশ বছর আগে। তাহলে আমরা আবার কী ফাঁস করব? আমরা আড়াই বছর ধরে, তিরিশ ঘণ্টা কথাবার্তা বলে এই বইটার কাঠামো দাঁড় করিয়েছি, এই পর্যন্তই।
ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক ও বিশ্লেষক মায়া মিরচন্দানি মনে করেন, আসলে দুই শত্রু দেশের এক সময়কার গোয়েন্দা প্রধানরা ঘরোয়া আলোচনায় দু’দেশের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো নিয়ে খোলাখুলি কথাবার্তা বলছেন, এই জিনিসটাই বইটাকে নিয়ে আগ্রহ তৈরি করেছে।
কাশ্মিরের এখন যা পরিস্থিতি, সেটাও তাতে ইন্ধন জোগাচ্ছে-আর অনেকেই মনে করছেন দুই সাবেক গোয়েন্দা হয়তো কিছু গোপন সরকারি তথ্যও ফাঁস করেছেন। বইটি লেখার পেছনে উদ্দেশ্য যাই থাকুক, পাকিস্তানে জেনারেল দুরানিকে প্রায় আশি ছুঁই-ছুঁই বয়সে হেনস্থা হতে হচ্ছে-আর ভারতেও এ এস দুলাতকে চ্যানেলে চ্যানেলে গিয়ে সাফাই দিতে হচ্ছে গোপনীয়তার শর্তভঙ্গ করে এমন কিছুই তারা তাতে লেখেননি।
টিটিএন/এমএস