‘এত আগে সে মরতে চায়নি’
অধিকৃত গাজা উপত্যকায় সোমবার প্রাণঘাতী রক্তাক্ত প্রতিরোধের উত্তাল একটি দিন দেখেছেন ফিলিস্তিনিরা। ওইদিন ইসরায়েল থেকে জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস সরিয়ে নেয়ার প্রতিবাদে ফিলিস্তিনিদের বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠে গাজা। ২০১৪ সালের পর গাজায় ওইদিন সর্বোচ্চ ৬০ জনের প্রাণহানি ঘটে।
গত ৩০ মার্চ থেকে শুরু হওয়া ফিলিস্তিনিদের বিক্ষোভ তীব্র আকার ধারণ করে সোমবার। ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ৭০তম বার্ষিকীতে নিজ ভূখণ্ড ফিরে পাওয়ার দাবিতে বিক্ষোভ করে আসছেন ফিলিস্তিনিরা। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সাড়ে ৭ লাখের বেশি ফিলিস্তিনি গৃহহারা হয়ে পড়েন।
নিহতদের দাফন অনুষ্ঠানের দিন মঙ্গলবারও ইসরায়েলি বাহিনী গুলি চালিয়ে দুই ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে; যদিও এদিন কিছুটা শান্ত ছিল গাজা উপত্যকা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিক্ষোভকারীরা আগেরদিনের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের দিকে না গিয়ে শোকে স্তব্ধ হয়ে যান।
আরও পড়ুন : লড়াই করে শহীদ হলেন ফিলিস্তিনি সালাহ
শোকার্ত ফিলিস্তিনিরা উপত্যকায় পদযাত্রা করেন। এ সময় তাদের হাতে ছিল দেশের পতাকা; ন্যায়বিচারের দাবি করেন তারা। পদযাত্রায় অংশ নেয়া অনেকেই বলেন, ‘শহীদগণ, আমরা রক্ত এবং আত্মায় তোমাদের স্মরণ করছি।’
ইসরায়েলি বাহিনীর টিয়ারগ্যাসে নিহত আট মাসের শিশু লাইলা আল-ঘানদৌরের জানায় অংশ নিয়েছিলেন শত শত মানুষ। নিহত এই শিশুর মরদেহ ফিলিস্তিনি পতাকায় ঢেকে দেয়া হয়।
তার মা কান্না করছিলেন। সন্তানের নিথর দেহ বুকে আর্তনাদ করেন তিনি। বলেন, ‘তাকে আমার সঙ্গে থাকতে দাও। এটা তার অসময়ে চলে যাওয়া।’
গাজার পূর্বাঞ্চলে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে নিহত ২২ বছর বয়সী মোস্তফার ভাই মাহমুদ আল মাসরি বলেন, ‘সাত সপ্তাহ আগে শুরু হওয়া বিক্ষোভে প্রত্যেকদিন অংশ নিতো তার ভাই।’
আরও পড়ুন : ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ডাক তুরস্কের
এই গ্রীষ্মে মোস্তাফার স্নাতক পাসের পার্টি হওয়ার কথা ছিল। এছাড়া তার আরো একটি স্বপ্ন ছিল। সে সবসময় জাফায় ফিরতে চাইতো, আমাদের পূর্ব-পুরুষের বসবাস ছিল সেখানে- বলেন ৩৭ বছর বয়সী আল-মাসরি।
‘ইসরায়েলি গুলি যখন ধেয়ে আসছিল, তখন সে অন্যদের সঙ্গে দৌড়ে পালাচ্ছিল। পরে মাটিতে শুয়ে পড়ে সে। এ সময় ইসরায়েলি স্নাইপারের একটি গুলি আঘাত হানে তাকে।’
মাসরি আরো বলেন, ‘ইসরায়েলি বাহিনীর গোলাবর্ষণ তীব্র আকার ধারণ করায় মোস্তফার বন্ধুরা তাকে ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করতে পারেনি। বিক্ষোভে অংশ নেয়া আমার মাকে খুঁজে পাইনি। ভাইয়ের দাফনের আগে যাতে তিনি ফিরে আসেন সেজন্য আমরা একটা মেগাফোন ব্যবহার করেছিলাম।’
তিনি বলেন, ‘শুধুমাত্র আমার ভাইয়ের প্রাণ যায়নি। সেখানে ব্যাপক গোলাবর্ষণে আরো কয়েক ডজন বিক্ষোভকারী মারা গেছেন।’
গাজা উপত্যকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আশরাফ আল কিদরা বলেছেন, ‘সোমবারের বিক্ষোভে ৬০ ফিলিস্তিনি মারা গেছেন। এদের মধ্যে ৮ শিশুও রয়েছে।’
একই দিনে ২২৫ শিশু ও ৮৬ নারীসহ আহত হয়েছে আরো ২২৭০ জন। গত ৩০ মার্চ থেকে হতাহতের সংখ্যা বেড়ে চলছে। ওই দিন থেকে শুরু হওয়া বিক্ষোভে এখন পর্যন্ত ১০৮ জন নিহত ও আরো ১২ হাজার মানুষ গুরুতর আহত হয়েছেন।
গাজার চলমান সংঘাতে প্রাণ গেছে দুই পা-বিহীন ফাদি হাসান আবু সালাহ নামে এক যুবকের। সৌদি সংবাদমাধ্যম আল-আরাবি বলছে, জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস চালুর বিরুদ্ধে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন পা-বিহীন ফিলিস্তিনি যুবক ফাদি হাসান আবু সালাহ। হুইলচেয়ারে করে গাজা সীমান্তে ইসরায়েলি বাহিনীর বিরুদ্ধে পাথর নিক্ষেপ করছিলেন তিনি। এসময় গুলিতে প্রাণ যায় সালাহর।
আরও পড়ুন : গাজা হত্যাযজ্ঞের নিন্দায় পোপ, চাইলেন ন্যায়বিচার
এর আগে, ২০০৮ সালে গাজায় ইসরায়েলি বোমা হামলার বিরুদ্ধে বিক্ষোভে অংশ নিয়ে মারাত্মক আহত হয়েছিলেন ৩০ বছর বয়সী সালাহ। পরে তার শরীর থেকে দুই পা অপসারণ করেন চিকিৎসকরা। গত ডিসেম্বরে ২৯ বছর বয়সী প্রতিবন্ধী যুবক ইব্রাহীম আবু থারায়াকে গুলি করে হত্যা করে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনী। গাজা উপত্যকায় শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ কর্মসূচিতে হুইল চেয়ারে করে অংশ নিয়েছিলেন ইব্রাহীম।
অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে নিয়োজিত জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষ দূত মাইকেল লিঙ্ক নিরস্ত্র মানুষের ওপর ইসরায়েলের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের নিন্দা জানিয়েছেন। ইসরায়েলি বাহিনী আন্তর্জাতিক আইন ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হলে সামনের দিনগুলোতে হতাহতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তিনি।
বিক্ষোভে নিহতদের একজন হাই স্কুলের শিক্ষার্থী ইব্রাহীম আল-জারকা। গাজা সীমান্তের কাছে ইসরায়েলি স্নাইপারের কয়েক রাউন্ড গুলি তার মাথায় আঘাত হানে। তার ৪৯ বছর বয়সী পিতা আহমেদের সঙ্গে শেষবারের মতো কথা হয় বিক্ষোভে অংশ নেয়ার আগে।
আরও পড়ুন : ট্রাক চালিয়ে ইউরোপের দীর্ঘতম সেতু উদ্বোধন করলেন পুতিন (ভিডিও)
আহমেদ বলেন, আগামী বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করবেন বলে ইব্রাহীম তাকে জানিয়েছিলেন। মানবাধিকারবিষয়ক আইনজীবী হতে চেয়েছিল আল-জারকা।
‘তবে জারকা এবারই যে প্রথম বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন তা নয়। সে এর আগেও তার বন্ধুদের সঙ্গে বিক্ষোভে অংশ নেয়। কিন্তু আমরা কখনো চিন্তাই করিনি সে হামলার লক্ষ্যস্তুতে পরিণত হবে। সে সীমান্ত বেড়া পেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করেনি।’
‘আল-জারকার একটা স্বপ্ন ছিল; সে এত তাড়াতাড়ি মরতে চায়নি। আপনি কি চিন্তা করতে পারেন, এমন কেউ একজন আছে যে হাইস্কুলের পড়াশোনা শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে, সে এভাবে মরার ইচ্ছা পোষণ করতে পারে?’
আহমেদ বলেন, ‘ইসরায়েলি স্নাইপারদের একজন ইচ্ছাকৃতভাবেই আল-জারকাকে কাছে থেকে গুলি করে হত্যা করেছে। সে কোনো ধরনের হুমকি তৈরি না করলেও তার মাথার ডানদিকে গুলি চালায় তারা। এক নিষ্পাপ শিশুকে ইচ্ছাকৃত হত্যা এটি; যে তার বন্ধুদের সঙ্গে শুধুমাত্র বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিল।’
এসআইএস/এমএস