ইরানের উত্তাল বিক্ষোভের নেপথ্যে কী?
সরকারের অর্থনৈতিক নীতিমালার জেরে ক্ষুব্ধ হাজার হাজার মানুষের বিক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে ইরানের বেশ কয়েকটি শহর। দেশটির আধা-সরকারি সংবাদসংস্থা ফার্স বলছে, শুক্রবার পশ্চিমাঞ্চলের শহর কারমানশাহতে কয়েকশ মানুষ বিক্ষোভ করেছেন। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ জল কামান ও টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করেছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীরা বলছেন, বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে রাজধানী তেহরানেও। ২০০৯ সালে সংস্কারপন্থী মিত্রজোট ক্ষমতায় আসার পর ইরানের এই বিক্ষোভকে এ যাবৎকালের সর্ববৃহৎ হিসেবে বলা হচ্ছে।
মানুষের প্রতিবাদের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে ইরান সরকারকে সতর্ক করে দিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০১৫ সালে ছয় বিশ্বশক্তির সঙ্গে ইরানের পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকেই তেহরানের সঙ্গে ওয়াশিংটনের সম্পর্কে ব্যাপক উত্তেজনা দেখা দেয়। ইরানের বিক্ষোভে তাৎক্ষণিক মার্কিন প্রতিক্রিয়াকে দৃষ্টিকটু হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।
ইরানে সরকারবিরোধী চলমান বিক্ষোভের নেপথ্যের কারণ জানতে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ মারান্ডির সঙ্গে কথা বলেছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা।
কেন ইরানের জনগণ বিক্ষোভ করছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে মারান্ডি বলেছেন, দেশটিতে অর্থনৈতিক সঙ্কট রয়েছে। চূড়ান্ত পরমাণু সমঝোতার (জেসিপিও) পর ইরানের জনগণের প্রত্যাশা ছিল যে, দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। কিন্তু আমরা দেখেছি উভয়ই (সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট) বারাক ওবামা ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের বিরুদ্ধে ভিসা নিষিদ্ধসহ নিষেধাজ্ঞা আরোপে নতুন নতুন আইন পাস করে জেসিপিও বারবার লঙ্ঘন করেছেন।
ইরানের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির জেরে দেশটিতে ছোট পরিসরে প্রতিবাদ হয়েছে। কিন্তু বিশেষ কি এমন ঘটল যে, যার কারণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বেশ কিছু শহরে এটি ছড়িয়ে পড়লো। কোনো আন্দোলনের সূত্রপাত হচ্ছে কী? জবাবে মারান্ডি বলেন, এটা বলা কঠিন, কারণ অর্থনৈতিক সঙ্কট এখানে একটি ব্যাপার; যা দেশজুড়েই বিরাজমান।
‘আমি মনে করি ইরানিরা যেসব অব্যবস্থাপনা নিয়ে ক্ষুব্ধ এবং তারা যা করতে চাচ্ছেন তাতে বাধার মুখে পড়ছেন; এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞাও একটি কারণ। এছাড়া অবশ্যই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মানুষের প্রতিবাদকে আরো সহজ করেছে। তারা এখন সহজেই তথ্য পাচ্ছেন।’
‘তবে যখন বেশ কিছু মানুষ অর্থনৈতিক সমস্যার প্রতিবাদ করছে তখন আরো একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে। আমরা বিদেশি সরকারগুলোর স্বতঃস্ফুর্ত প্রতিক্রিয়া দেখতে পাচ্ছি।’
অধ্যাপক মোহাম্মদ মারান্ডি বলেন, ‘বিবিসির ফার্সি ভাষার সম্প্রচারমাধ্যম ব্রিটিশ সরকার ও ভয়েস অব অামেরিকা মার্কিন সরকার সংশ্লিষ্ট। এসব মিডিয়া প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে পশ্চিমা সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত- তারাই এই বিক্ষোভকে বড় পরিসরে দেখানোর চেষ্টা করছে। তারা রাজনৈতিক কারণে এটিকে তীব্র করার চেষ্টা করছে।’
ইরান সরকার বলছে, দেশের অর্থনীতি নয়, ভিন্ন উদ্দেশ্যে এই বিক্ষোভ করছে বিরোধীরা। আমরা সরকারবিরোধী স্লোগান শুনতে পেয়েছি। ‘রুহানির মৃত্যু’, ‘ফিলিস্তিন ভুলে যাও’, ‘গাজায় না’, ‘লেবাননে না’সহ ইরানের পররাষ্ট্র নীতির বিরোধী স্লোগানও শোনা গেছে বিক্ষোভে। সরকার এটা নিয়ে কতটা উদ্বিগ্ন?
মারান্ডি বলেন, ‘বিক্ষোভকারীরা সংখ্যায় অল্প। আপনাকে মনে রাখতে হবে যে, এই বিক্ষোভকারীদের সবাই একই ধরনের স্লোগান দেয়নি। এদের মধ্যে কেউ কেউ সরকারবিরোধী অথবা ইরানের পররাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়েছে।’
‘কিন্তু আপনি যখন ভিডিও ফুটেজগুলোতে চোখ রাখবেন, তখন দেখবেন, অনেকেই ঐক্যবদ্ধভাবে স্লোগান দিচ্ছেন। আবার অনেকের মৌলবাদী কণ্ঠও শোনা যাচ্ছে। এরপর আপনি দেখবেন অনেকেই স্লোগানের পুনরাবৃত্তি করছেন না। সুতরাং এটা অত্যন্ত সহজ বিষয় নয়।’
এই বিক্ষোভে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের দ্রুত প্রতিক্রিয়ার বিষয়টিও বেশ কৌতূহলের। বিক্ষোভকারীদের কঠোর হাতে দমন না করতে ইরানি প্রশাসনকে সতর্ক করে দিয়েছেন ট্রাম্প। মারান্ডি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে যখন বিক্ষোভ-পাল্টা বিক্ষোভ হচ্ছে তখন ট্রাম্পের এ ধরনের চেহারা বেশ মজার।
‘একদিকে শার্লোটভিলেতে একজন খুন হয়েছেন। অন্যদিকে, আমরা দেখছি দুর্ভিক্ষের মাধ্যমে ধ্বংসপ্রাপ্ত ইয়েমেনের ব্যাপক গণহত্যায় সৌদি আরবকে সমর্থন দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। আমরা দেখছি, ওবামা এবং ট্রাম্প উভয়ের আমলেই যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় চরমপন্থীদের সমর্থন দিয়েছেন। সুতরাং ইরানের মানবাধিকারের ব্যাপারে কথা বলাটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বেমানান।’
এসআইএস/জেআইএম