রাখাইনের সচ্ছল পরিবার এখন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে উদ্বাস্তু
দীন মুহাম্মদের বয়স এখন ৬৮ বছর। বয়স ৬৮ বছর হলেও শারীরিকভাবে তিনি এখনো বেশ শক্তপোক্ত। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মধ্যেই এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে হেঁটে বেড়ান তিনি। কুতুপালং ক্যাম্পের কমবেশি সবাই দীন মুহাম্মদকে অনেকেই চেনে।
দীন মুহাম্মদ দেখতে অন্য সাধারণ রোহিঙ্গাদের মতো নয়। কথা বলতে পারেনস পরিষ্কার বাংলা ভাষায়। পোশাক-পরিচ্ছদেও অন্য রোহিঙ্গাদের থেকে অনেকটাই ভিন্ন তিনি।
দীন মুহাম্মদ ও তার পরিবারের বসবাস ছিল মিয়ানমারের ফকিরা বাজার নামক একটি এলাকায়। মংডু শহর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে সেই জায়গা। দীন মুহাম্মদের বাবা-দাদা এবং পূর্ব পুরুষের জন্মও সেখানে। অবশ্য ফকিরা বাজার জায়গাটি বাংলাদেশের উখিয়া সীমান্তের কাছেই।
দীন মুহাম্মদ জানান, ফকিরা বাজারে তার কাঠের তৈরি একটি দোতলা বাড়ি ছিল। বাড়িটি আকারে বেশ বড়। তার বর্ণনায় বাড়িটির দৈর্ঘ্য ছিল ৪৫ ফুট এবং প্রস্থ ২৪ ফুট। সাধারণ রোহিঙ্গারা যে ধরনের বাড়িতে বসবাস করেন, দীন মুহাম্মদের বাড়ি ছিল তার চেয়ে অনেক বড়।
মিয়ানমারের সেই বাড়ি ফেলে এসে দীন মুহাম্মদ এখন তার পরিবার নিয়ে কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন। গত সেপ্টেম্বর মাসে তিনি মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন।
মিয়ানমারে বসবাসের সময় তার পারিবারিক রোজগার ছিল বেশ ভাল। মাসে প্রায় দুই-তিন লাখ টাকা আয় ছিল বার্মার টাকায়। বাংলাদেশি টাকায় ২০ থেকে ৩০ হাজার হবে। সেই উপার্জন দিয়ে বেশ ভালো ভাবেই সংসার চলতো বলেও জানান তিনি।
দীন মুহাম্মদের সাত ছেলে এবং এক মেয়ে। যৌথ পরিবারেই ছিল তার বসবাস। ছেলের বউ এবং নাতি-নাতনিসহ সব মিলিয়ে পরিবারের ১৭ জন সদস্য নিয়ে তিনি এখন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে।
মিয়ানমারে থাকার সময় তার ছেলেরা বেশ কয়েকটি দোকান নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করতো। স্বর্ণের দোকান, মোটর পার্টসের দোকান, কম্পিউটার পার্টস এবং মোবাইলের দোকানও ছিল।
গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার পর কুতুপালং-এর লাম্বাশিয়া ক্যাম্পে পাঁচটি ছোট-ছোট অস্থায়ী ঘর পেয়েছেন তিনি। একেকটি ঘরের দৈর্ঘ্য ১০ফুট এবং প্রস্থ আট ফুট।
মিয়ানমারের ফকিরা হাটে তাঁর বাড়ির কী অবস্থা সে সম্পর্কে কিছুই জানেন না দীন মুহাম্মদ। তিনি যখন বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে আসেন তখন সেটি অক্ষতই ছিল।
তাদের এলাকায় দু'জন রোহিঙ্গাকে গুলি করে হত্যার পর অন্য অনেক মানুষের সঙ্গে তিনিও বাড়ি ফেলে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন।
এ ব্যাপারে তিনি বলছেন, কেউ বলছে আমাদের বাড়ি পোড়ায় দিছে, কেউ বলছে আছে। ঠিকভাবে বলতে পারি না। নিজের দেশের লাইফ (জীবন) তো ভালো। বিদেশে তো শরণার্থী হিসেবে রইছি।
২০০৬ সালের আগে তিনি স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের একজন সদস্য ছিলেন বলেও দাবি করেন দীন মুহাম্মদ।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় কক্সবাজার, উখিয়া এবং টেকনাফ অঞ্চলের স্থানীয় অনেক রাজনৈতিক নেতা সীমান্ত পেরিয়ে ফকিরা হাটে তাদের বাড়িতে কিছুদিনের আশ্রয় নিয়েছিল। সেই সূত্রে বাংলাদেশের উখিয়া অঞ্চলের স্থানীয় কিছু মানুষের সঙ্গে তার যোগাযোগ আছে।
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসার পর তাদের অনেকে দীন মুহাম্মদের পরিবারের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এমনটাই বলছেন তিনি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি নিজ বাড়িতে বাংলাদেশিদের আশ্রয় দিয়েছিলেন।
কিন্তু ৪৭ বছর পর তিনি নিজেই উদ্বাস্তু হবেন এমনটা কখনো ভাবতেই পারেননি দীন মুহাম্মদ। বিবিসি বাংলা।
কেএ/পিআর