ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে এসে বিশ্ব দরবারে
কেবল জাপান নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট কালো অক্ষরে লেখা থাকবে। সেদিন সকালে ‘মানবিক’ যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনী জাপানের হিরোশিমা শহরের ওপর ‘লিটল বয়’ নামের পারমাণবিক বোমা ফেলে। মাত্র তিনদিন পরই নাগাসাকি শহরের ওপর ‘ফ্যাট ম্যান’ নামের আরেকটি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
ধারণা করা হয়, বোমা বিস্ফোরণের ফলে ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই হিরোশিমায় প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার মানুষ মারা যায়। আর নাগাসাকিতে প্রায় ৭৪ হাজার মানুষ মারা যায়।
পরবর্তী সময়ে এই দুই শহরে বোমা হামলার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় আরও দুই লাখ ১৪ হাজার।
হাসপাতালের নথিপত্র অনুযায়ী, হিরোশিমায় দুই লাখ ৩৭ হাজার এবং নাগাসাকিতে এক লাখ ৩৫ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। দুই শহরেই মারা যাওয়া মানুষের অধিকাংশ ছিল বেসামরিক নাগরিক।
হিরোশিমার মতোই নাগাসাকিতে প্রাণে বেঁচে যাওয়া অনেককেই দীর্ঘকাল ধরে সহ্য করতে হয়েছে নানা রকম শারীরিক ও সামাজিক প্রতিকূলতা।
তবে পারমাণবিক বোমা হামলায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া লোকজন একসময় তাদের দুঃখ আর বেদনার কথা প্রকাশ করতে দ্বিধাবোধ করতেন। যুদ্ধের ঠিক পরপর যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি দখলে থাকার সময় পারমাণবিক বোমা সংক্রান্ত সব রকম খবর প্রচারের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা এবং পরবর্তী সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে সামাজিকভাবে করুণার দৃষ্টিতে দেখার প্রবণতা জাপানের নাগরিকদের নিজেকে গুটিয়ে রাখার মনোভাব জাগিয়ে তুলেছিল।
ফলে অন্যদের কাছে নিজেদের দুঃখের কথা বলতে তাদের মধ্যে অনাগ্রহ ছিল। তবে পরবর্তী সময়ে অবশ্য বিশ্বজুড়ে পারমাণবিক অস্ত্রবিরোধী আন্দোলন আরও অনেক বেশি জোরালো হয়ে ওঠার মুখে জাপানেও সেই ঢেউ এসে লাগে। পারমাণবিক বোমা হামলার সরাসরি শিকার যাদের হতে হয়েছিল, তাদের মুখ থেকে সেই মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার কথা শুনে নিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন দেশের অনেকেই।
এত কথা বলার কারণ অবশ্য হিরোশিমা কিংবা নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা ফেলার ইতিহাস কিংবা তার ভয়াবহতা তুলে ধরার জন্য নয়। দুটি কারণে এসব ইতিহাস খুুব গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথমত, সঙ্কটের কারণে জীবন বাঁচাতে বহু মানুষ ঝুঁকি না নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। দ্বিতীয়ত. সেখানে থেকেই প্রতিকূলতাকে জয় করার চেষ্টা করেছেন কেউ কেউ।
‘কাতারিবে’ নামে পরিচিত কথক বা গল্প বলার ক্ষেত্রে বোমা হামলার শিকার মানুষের আবির্ভাবের সুযোগ করে দিয়েছিল, অনেকটা নিয়মিতভাবে তারা এখন বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে তাদের সেই দুর্দশার স্মৃতি তুলে ধরছেন। যেভাবে অনেকের উদ্যোগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধর সময়কার ভয়াবহতা একেবারে নিম্নবর্গের মানুষের কাছ থেকে তুলে নিয়ে আসা হচ্ছে, সেভাবে।
তবে হামলার সময়কার যারা এখনো জীবিত আছে, তাদের সবাই বয়োবৃদ্ধ হয়ে পড়ায় সেই স্মৃতি মানুষের কাছে কথা বলার মধ্য দিয়ে পৌঁছে দেয়ার লোকজন অল্প কয়েক বছর পর আর হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেটা অবশ্য বাংলাদেশ জাপান, দুই দেশেই প্রযোজ্য।
সেই অভাব পূরণ করে নিতে হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরের কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান অবশ্য তরুণদের প্রতি সেই দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছে, হিবাকুশাদের কাছ থেকে তাদের অভিজ্ঞতার বর্ণনা শুনে নিয়ে ঠিক সেভাবে মানুষের কাছে তা বলার চর্চা করছেন। ফলে হিবাকুশাদের চলে যাওয়ার পরও তাদের স্মৃতি অম্লান রাখার কাজ জাপানে ঠিকই এগিয়ে চলেছে।
আবার বিদেশের মাটিতে পাড়ি দিয়েও যে জাপানের মাটির গন্ধ যে অনেকেই ভুলে যাননি, তারও কিন্তু ভুরি ভুরি প্রমাণ আছে। সপরিবারে দেশত্যাগ করলেও অনেক বড় অর্জন করেছেন অনেকেই।
তবে এই ঘটনা অনেক পরের। শুরুর দিকে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোর নিয়ে মুখ খোলা বারণ ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা ও নীতিনির্ধারকেরা বাস্তবিক অর্থেই বিশ্বকে সেই ধারণা দিতে চেয়েছিলেন বলেই হিরোশিমা-নাগাসাকির মর্মান্তিকতার ঘটনা চেপে রাখা তাদের জন্য আবশ্যকীয় হয়ে দেখা দিয়েছিল।
জন হার্সির লেখা হিরোশিমার বোমা হামলা পরবর্তী সময়ের মর্মান্তিক বিবরণ সারা বিশ্বের পাঠক জেনে যাওয়ার পরও নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে জাপানি পাঠকেরা অনেক দিন ধরে বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা সেই বই পাঠ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিলেন।
তবে মার্কিন দখলদারির অবসানের পর থেকে ধীরে সেই নিষিদ্ধ দুয়ার উন্মোচিত হয় এবং এখন অনেকেই আগ্রহ নিয়ে হিবাকুশা এবং তাদের মধ্যে যারা আবার গল্পের আকারে সেই মর্মান্তিক ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরতে পারদর্শী, তাদের মুখ থেকে সরাসরি সেই ইতিহাস জেনে নিতে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।
জাপানি বংশোদ্ভূতরা যে আসলেও ভাল গল্প বলেন, মানে সাহিত্যে বেশ দখল রয়েছে; আজ তার প্রমাণ দিলেন ঔপন্যাসিক কাজুয়ো ইশিগুরো।
চলতি বছর সাহিত্যে নোবেল জয়ী হিসেবে ঔপন্যাসিক কাজুয়ো ইশিগুরোর নাম ঘোষণা করেছে সুইডিশ অ্যাকাডেমি। বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় সকাল ৭ টায় অনুষ্ঠান শুরু হয়ে দুপুর ১ টায় সাহিত্যে নোবেল জয়ী হিসেবে ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক কাজুয়ো ইশিগুরোর নাম ঘোষণা করা হয়।
জাপানি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক কাজুয়ো ইশিগুরো একাধারে চিত্রনাট্যকার, ছোট গল্পকার এবং ঔপন্যাসিক হিসেবেই সমধিক পরিচিত।
নাগাসাকিতেই জন্ম গ্রহণ করেন তিনি; ১৯৫৪ সালের ৮ নভেম্বর। কাজুয়ো ইশিগুরোর যখন মাত্র পাঁচ বছর বয়স, তখনই তার পরিবার জাপান ছেড়ে ইংল্যান্ডে চলে আসে। সেটাও ১৯৬০ সালের কথা।
সমুদ্রবিদ বাবা শিজিও ইশিগুরো চাননি নাগাসাকির অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। সেকারণেই সপরিবারে ইংল্যান্ডে চলে আসেন তিনি। ছাত্রাবস্থায় বাবার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ বেশ কিছু দেশ ঘুরে ফেলেন কাজুয়ো ইশিগুরো। কেবল ঘুরেই দেখেননি তিনি; পাশাপাশি ভ্রমণকাহিনী, ফিচারও লিখেছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়।
১৯৭৪ সালে কেন্ট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে ১৯৭৮ সালে স্নাতক সম্পন্ন করেন। সৃজনশীল লেখার ওপর ১৯৮০ সালে স্নাতকোত্তরও সেরে ফেলেন। আর যুক্তরাজ্যের নাগরিকত্ব লাভ করেন ১৯৮২ সালে।
লেখালেখিতে জাপানের বিষয়াদি উঠে আসায় অনেকেই তাকে সে দেশের লেখক বলে থাকেন। অথচ ১৯৬০ সালে জাপান থেকে সপরিবারে এসে ১৯৮৯ সালের আগ পর্যন্ত একবারও ফিরে যাননি তিনি। মাথা তুলে দাঁড়ানোর সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন বিদেশের মাটিতে। ২২ বছর পর পেয়েছেন যুক্তরাজ্যের নাগরিকত্ব।
বিয়ে করেছেন ১৯৮৬ সালে। লেখালেখির জন্য বেশ কিছু পুরস্কার পেয়েছেন। চিত্রনাট্য লিখেছেন ‘নেভার লেট মি গো’, ‘দ্য রিমেইন্স অব দ্য ডে’, দ্য হোয়াইট কাউন্টিস’সহ বেশ কিছু চলচ্চিত্রের।
সুইডেনের বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেলের ইচ্ছানুসারে নতুন কোনো কিছু উদ্ভাবন, বিশেষ গবেষণা এবং মানব জাতির কল্যাণে অসামান্য অবদান রাখার জন্য প্রতি বছর নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়। পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসা, সাহিত্য, শান্তি ও অর্থনীতিতে দেয়া হয় এ পুরস্কার।
বরাবরই সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার ঘোষণায় অনেক কানাঘুষা শোনা যায়। গত বছর বব ডিলানের হাতে পুরস্কার ওঠায় অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন। গায়ক এবং গীতিকার হিসেবে পরিচিত বব ডিলানের পুরস্কার জেতাটা অনেকেই মেনে নিতে পারছিলেন না।
চলতি বছরও সবাইকে অবাক করে দিয়ে কাজুয়ো ইশিগুরো জিতে নিলেন সাহিত্যে নোবেল। অবাক তো হওয়ারই কথা, ধ্বংসস্তুপ থেকে উঠে এসে তিনি যে বিশ্ব দরবারে ঠাঁই করে নিয়েছেন।
কেএ/জেআইএম