রোহিঙ্গা নারীদের মুখে ধর্ষণ ও বীভৎসতা
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর তাণ্ডবে রাখাইন রাজ্য ছেড়ে বাংলাদেশের বালুখালি রোহিঙ্গা আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁয় নিয়েছেন ২০ বছর বয়সী আয়েশা বেগম। বাঁশের চাটাই আর তেরপল দিয়ে কোনো মতে তাঁবু বানিয়ে পরিবারের সঙ্গে মাথা গোঁজার জায়গা করেছেন তিনি।
আয়েশা জানান, মাত্র ১৩ দিন আগে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। সপ্তাহখানেক আগে তিনি বাংলাদেশে এসেছেন। মিয়ানমার সেনাবাহিনী যখন বুথিডং শহরের কাছাকাছি এলাকায় তাদের বাড়িতে হামলা চালায়, তখন চার বোন মিলে রাতের খাবার খাচ্ছিলেন আয়েশারা।
‘সেনাবাহিনী আমাদের বাড়িতে এসে নারীদের একটি কক্ষে প্রবেশ করতে বলে। আমার কোল থেকে ছেলেকে কেড়ে নিয়ে ফুটবলের মতো করে লাথি মারে এক সেনা।’
আয়েশা জানান, সেনারা তাদের নগ্ন করে ফেলে। এতে বাধা দিলে একজন সেনা তাকে ছুরিকাঘাত করে ধর্ষণ করে। পরে ১২ জন মিলে কয়েক ঘণ্টা ধরে তাকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে।
তিনি আরও বলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম তারা আমাকে মেরে ফেলবে। সবচেয়ে ভয় হচ্ছিল, আমার ছেলে মারা গেছে ভেবে।’
আয়েশার সঙ্গে কথা বলার সময় তার স্বামী, মা, ভাই, বোন ছিল; বাঁশের চাটাইয়ের বেড়ার পাশেই ছিল আরেক পরিবার। আয়েশা এক নাগাড়ে বলে চলেন, বাংলাদেশে এসেছেন অাটদিন আগে।
তার সঙ্গে তার ননদেরাও ধর্ষিত হয়েছে। দলগত ধর্ষণ আর নির্যাতনের শিকার হয়ে তারা শারীরিকভাবে অসুস্থ্য হয়ে পড়েছিল। পরে তাদের দুজন মারা গেছে।
একমাসের বেশি সময় ধরে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর তাণ্ডব চালিয়ে আসছে। মিয়ানমার সরকার অবশ্য রোহিঙ্গাদের তাদের দেশের নাগরিক হিসেবে শিকারই করে না। তাদের দাবি, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকে গিয়ে সেখানে বসতি স্থাপন করেছে।
বংশ পরম্পরায় শত শত বছর ধরে রাখাইনে বসবাস করেও রোহিঙ্গারা সেখানকার নাগরিকত্ব পায়নি। দেশটিতে কোনো রকম নাগরিক সুবিধা পায় না রোহিঙ্গারা।
সর্বশেষ গত ২৫ আগস্ট সেনাবাহিনী ও পুলিশের তল্লাশি চৌকিতে হামলার অযুহাতে রোহিঙ্গাদের জাতিগত নিধনযজ্ঞ শুরু করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী।
জীবন বাঁচাতে এখন পর্যন্ত পাঁচ লাখ এক হাজার আটশ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। মিয়ানমারে চলমান বর্বরতাকে পাঠ্যপুস্তকে উল্লিখিত জাতিগত নিধনযজ্ঞের উদাহরণ হিসেবে বর্ণনা করেছে জাতিসংঘ।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। তাদের সবার জন্যই জরুরি ভিত্তিতে মানবিক সহায়তা প্রয়োজন। আশ্রয়কেন্দ্রের পাশাপাশি খাবার, স্যানিটেশন, কাপড় ও ওষুধের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া বহু নারী শিশু মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছে, তাদের চিকিৎসায় এগিয়ে আসা জরুরি।
২০ বছর বয়সী মহসিনা বেগম জানান, ‘সেনাবাহিনী আমাদের বাড়িতে এসে আমার বোনকে ধরে নিয়ে গেছে। আমাদের এলাকার প্রধান হস্তক্ষেপ করার আগ পর্যন্ত তারা আমার বোনকে ধর্ষণ করেছে।’
তবে ধর্ষণ বন্ধ হলেও বোনকে বাঁচাতে পারেননি মহসিনা। সেনাবাহিনী তার বোনকে পুড়িয়ে মেরে ফেলেছে। মহসিনার কোল থেকে ছেলেকে কেড়ে নিয়ে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে।
তাদের সমবয়সী রজুমা বেগমের গল্পও অভিন্ন। তিনিও নিজের সন্তানকে কোলে করে নিয়ে বসে ছিলেন। কিন্তু সেনাবাহিনী এসে তার সন্তানকে কেড়ে নিয়ে গলা কেটে ফেলেন।
কেড়ে নেয়ার সময়ও ছেলের হাত শক্ত করে ধরে ছিলেন রজুমা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছেলেকে বাঁচাতে পারেননি তিনি। কেবল শুনতে পেয়েছেন ছেলের আর্তনাদ। মা, মা বলে গলা ফাটানো ডাক।
ছেলেকে হত্যার পর আর চারজনের সঙ্গে রজুমাকে নিয়ে যাওয়া হয় একটি ঘরে। সেখানেই মিয়ানমার সেনাবাহিনী তাদের ধর্ষণ করে।
রজুমার দশ বছর বয়সী এক ভাইও ছিল। তাকেও মেরে ফেলেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এখন তার বয়সী তিন নারী, একজন তরুণী এবং ৫০ বছর বয়সী আরেক নারীর সঙ্গে একই ঘরে থাকেন রজুমা। তাদের সবাইকে ধর্ষণ করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী।
রজুমা জানান, তিনজন সেনা তাকে দুই ঘণ্টা ধরে পালাক্রমে ধর্ষণ করেছে। সেই সঙ্গে গাছের ডাল দিয়ে সমানে মারধর করেছে। তারপর সেনারা তাদেরকে একটি ঘরে আটকে রেখে আগুন ধরিয়ে দেয়। তবে দুর্ভাগ্য হোক আর সৌভাগ্যই হোক, তারা বেঁচে গেছেন।
বাঁশের চাটাইয়ের সঙ্গে মাটি দিয়ে লেপা ঘরে তারা সবাই মিলে ধাক্কা দিয়ে বের হতে পেরেছিলেন। তারপরই বাংলাদেশের উদ্দেশে হাঁটা শুরু করেন। তাদের সঙ্গে গ্রামের এক অনাথ শিশুকেও তারা নিয়ে আসেন। সেই শিশু ছিল উলঙ্গ অবস্থায়। তারা তাকে কাপড়ও পরিয়ে দিয়েছেন।
সীমান্তে আসার পর একজন বাংলাদেশি তাদের সাহায্য করেছেন। পরে তিনি প্রাথমিক চিকিৎসাও পেয়েছেন। শরণার্থী শিবিরে এসে তিনি স্বামীর দেখাও পেয়েছেন। তার স্বামী মুহাম্মদ রফিক সহিংসতার মুখে কোনো রকমে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে এসেছেন। তার স্ত্রীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর আর খুঁজে না পেয়ে একাই বাংলাদেশে চলে অাসেন তিনি।
রজুমা বলেন, ‘আমাদের পরিবারের সবাই মারা গেছে। এখানে আমি আর আমার স্বামী কেবল জীবিত আছি। আমি চাই আমাদের সঙ্গে যা ঘটেছে তা বিশ্বের সবাই জানুক।’
‘সেনাবাহিনী আমাদের পরিবারের সাত জনকে মেরে ফেলেছে। আমার মা সুফিয়া খাতুন (৫০), আমার বোন রোকেয়া বেগম (১৮), রুবিনা বেগমকে (১৫) ধর্ষণ করেছে; আমার ভাই মুসা, ননদ খালেদা, তার ছেলে রাজ্জাক, আমার ছেলে মুহাম্মদ সিদ্দিককে তারা হত্যা করেছে।’
‘সবার এটা জানা দরকার যে, সেনাবাহিনী আমাদের সঙ্গে কী নির্মম আচরণটাই না করেছে।’ রজুমার সঙ্গে যা কিছু ঘটেছে সেটা তার স্বামী জানে। তবে স্বামী রজুমাকে সমর্থন দিয়ে যচ্ছেন।
এবার বলতে শুরু করেন ইয়াসমিন বেগম। তবে স্বামীর অনুমতি সাপেক্ষে কথা বলা শুরু করেন তিনি। এখানে আসার আগে রাখাইনে তাদের বিলাসবহুল বাড়ি ছিল। সেখানে স্বাচ্ছন্দে দিন পার হতো তাদের।
বাংলাদেশে এসেছেন এক ছেলে আর তার স্বামীকে নিয়ে। তবে তার আরও তিন ছেলে ছিল।
তিনি জানান, ‘সেনাবাহিনী আমাদের গ্রামে এসে সবাইকে অস্ত্র জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়। গ্রামবাসী জানাই কারও কাছেই অস্ত্র নাই। তারপরই ঘুষি, লাথি, লাঠির বাড়ি, গুলি করে, গলা কেটে হত্যা শুরু করে সেনাবাহিনী।’
‘একদিন দুপুরে আমি বাচ্চাকে দুধ খাওয়াচ্ছিলাম। এরকম সময় সেনাবাহিনী আমাদের বাড়িতে আসে। আটজন সেনা এসেছিল আমাদের বাড়িতে। তারা আমার চার, ছয় এবং আট বছর বয়সী ছেলেকে লাথি মেরে ফেলে দিল।’
‘তার পর পাঁচজন সেনা আমাকে ধর্ষণ করে। তারা বিভিন্ন বয়সী ছিল। বাকি তিনজন বাইরে অপেক্ষা করতে থাকে। আর বাকিটা আমি বলতে পারবো না।’
‘সেসময় এতো কষ্ট হচ্ছিল যে, আমি মারা যাবো ভেবেছিলাম। মিয়ানমারে থাকতে আমি ঘুমাতেই পারিনি। সেই তুলনায় এখানে ভাল অাছি।’
রাখাইন ছেড়ে এসে তিন দিন ধরে শিক্ষক স্বামী আসাদুল্লাহ (২৫) কে খুঁজেছেন তার স্ত্রী আয়েশা। পরিচিত যার সঙ্গেই দেখা হয়েছে, স্বামীর কথা জানতে চেয়েছেন। উদ্বেগ নিয়ে হন্যে হয়ে খুঁজে অবশেষে স্বামীর দেখা পেয়েছেন তিনি।
আয়েশা বেগম জানান, ‘সেনাবাহিনী আমাকে ধর্ষণ করেছে। আমি শরীরে নয়, ব্যথা পেয়েছি মনে।’
তার স্বামী আসাদুল্লাহ বলেন, ‘আমি এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে অাছি যে, আমার স্ত্রীর সঙ্গে এমন কিছু ঘটেছে যাতে আমার গা জ্বলে যাচ্ছে অথচ কিছুই করতে পারছি না। কারও কাছে যে বিচার দেবো, সে পথও নেই আমাদের। আমার স্ত্রীর সঙ্গে যা ঘটেছে তার জন্য তাকে আমি কখনোই দোষ দিইনি; কারণ ওকে আমি ভীষণ ভালবাসি।’
সূত্র : আল জাজিরা
কেএ/আরআইপি