রোহিঙ্গা আখ্যান : এক বুলেটে দুই লাশ
৪৪ বছর বয়সী সাদেক আলী হাসান একজন স্কুল শিক্ষক; বসবাস করেন মালয়েশিয়ায়। তিনি একজন রোহিঙ্গা। প্রায় ২৫ বছর ধরে মাতৃভূমি মিয়ানমারের বাইরে বসবাস করে আসছেন সাদেক।
মালয়েশিয়ার অ্যামপাংয়ের কাছের সেলানগরে একটি মাদরাসা পরিচালনা করেন তিনি। তার অতীত, রোহিঙ্গা নিপীড়ন ও তাদের স্বাধিকারের বিষয়ে কথা বলেছেন সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের সঙ্গে।
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের রাখাইনে তার গ্রাম তুং পিও লেট ইয়ার ছেড়ে আসার গল্প জানান তিনি। ‘আমার পরিবার ছিল জমিদার। আমার বাবার ছিল ১৬ একর জমি। আমরা সেখানে ধান, মরিচ, বাঁধাকপি, আলু, টমেটো, তামাক, বেগুন ও কুমড়ার চাষ করতাম। তবে পান আর বাদাম অত্যন্ত লাভজনক ফসল।’
‘এছাড়া নানারকম ফল হয় সেখানে; এর মধ্যে কলা, নারকেল এবং কাঁঠাল অন্যতম। মাছ চাষের জন্য আমাদের পুকুরও ছিল।’
‘আমার জীবন খুব ভালভাবে কেটেছে। আমি স্কুলে যেতে পেরেছি এবং বিকেলে প্রতিবেশি শিশুদের সঙ্গে খেলতে পেরেছি। স্কুল আমার খুবই পছন্দের জায়গা। আমাদের বার্মিজ ভাষায় পড়ানো হতো। তবে আমরা ইংরেজিও শিখতে চাই।’
‘প্রতিদিন সকালে আমরা মসজিদে গিয়ে ধর্মীয় বিষয়াদি শিখতাম এবং তার পরে সরকারি স্কুল থেকে ফিরে আবার মসজিদে যেতাম। ইংরেজি ছিল আমার সবচেয়ে পছন্দের বিষয়।’
‘তখন আমাদের সুখের শেষ ছিল না। তবে ১৯৮৮ সালে এসে গণতন্ত্রপন্থীরা মিয়ানমারে বিক্ষোভ শুরু করে এবং রাখাইন রাজ্যে বিক্ষোভে অংশ নেয়। এক বছরের মধ্যে নতুন সীমান্তরক্ষী বাহিনী আমাদের গ্রামে এসে যায়। তারা গ্রামের লোকদের মধ্য থেকে বাছাই করে তাদের দলে কাজের জন্য বাধ্য করতে শুরু করে।’
‘আমি ছিলাম ছাত্রনেতা, একজন কর্মী; সেকারণে আমি খুব শিগগিরই ধরা পড়লাম। মোটরবাইক ছিল শাস্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম।’
‘এটা এমন এক ধরনের শাস্তি, যেখানে দুই থেকে তিন ঘণ্টা আপনাকে কাল্পনিক বাইকের উপর বসে থাকতে হবে। মোটরসাইকেলের মতো করে শব্দও তৈরি করতে হবে। যদি কোমর সোজা করে দাঁড়ান, তাহলে লাথি দেয়া হবে; যদি শব্দ করা থামিয়ে দেন, তাহলে গুলি করা হবে। আর যদি অস্ত্র ফেলে দিই, তাহলে ঘুষি মারা হবে।’
এমন এক পরিস্থিতিতে সাদেক অনুধাবন করেন, তার মিয়ানমার ছেড়ে চলে যাওয়া দরকার। তিনি বলেন, ‘মারধরের পরও আমি বেশ কয়েক বছর সেখানে ছিলাম। কিন্তু একদিন আমাকে গুলি করা হলো। রমজান মাসে আমি সেখানকার এক বাজারে ছিলাম। একজন লোক আমাকে ইফতারের জন্য বাগুলা (রুটি) খেতে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই একজন বৌদ্ধ সেখানে এসে আমার বাগুলা ছিনিয়ে নেয়। পরে তারা দুজনে রীতিমতো লড়াই শুরু করে।’
‘সেটা ছিল মুসলিমদের গ্রাম। সেকারণে মানুষজন মুসলিমকেই সাহায্য করে। কিছুক্ষণ পর বৌদ্ধরা নিরাপত্তা চৌকিতে চলে অাসে।’
‘এরপর নিরাপত্তা রক্ষীরা এসে ভিড়ের মধ্যেই গুলি চালাতে শুরু করে। আমার চোখের সামনেই একজনের কোমরে গুলি লাগার পর সেটাই আরেকজনের বুকে গিয়ে বিঁধল। দু’জন লোক অথচ একটি বুলেট। পরের দিন আমি সেখান থেকে পালিয়ে যাই। ১৯৯২ সালের ৯ জানুয়ারি; আমার জন্মদিন ছিল সেদিন।’
সেই ভয়াবহ দিনের পর খুব সাবধানে চাষিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে খামারের সবকিছু বিক্রি করে সাত বন্ধু মিলে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন সাদেক। ‘আমি খুবই ভয় পাচ্ছিলাম। তবে বার বার মনে হচ্ছিল, আমি নতুন জীবনে প্রবেশ করছি।’
বাংলাদেশ, ভারত, থাইল্যান্ড ঘুরে ২০০৬ সালে মালয়েশিয়ায় যান সাদেক। দারুল ইসলাহ অ্যাকাডেমি নামে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি।
দেশান্তরী এই রোহিঙ্গা বলেন, ‘এখনও পাঁচ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা অ্যামপাংয়ে আছে। সেখানকার বেশিরভাগ শিশু স্কুলের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। এখানকার শিশুরা অন্তত পড়তে-লিখতে তো পারছে। সকালে তারা মালয়েশিয়ার স্কুলের সিলেবাস অনুযায়ী পড়াশোনা করে বিকেলে ধর্মীয় বিষয় পড়ে।’
‘আমি চাই তাদের ভবিষ্যৎ থাকুক। তাদের নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন রয়েছে; কারণ আমার চারজন শিশু রয়েছে। আমাদের বাচ্চারা চিকিৎসক, প্রকৌশলী এবং বিচারক হতে চায়। তবে সর্বপ্রথম তাদের থাকার জায়গা দরকার।’
‘আমি মালয়েশিয়া সরকারের প্রতি খুবই কৃতজ্ঞ যে, তারা আমাদের বসবাসের সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু নিজেই আমি কারাগারে বসবাসের মতো পরিস্থিতিতে আছি বলে মনে করি।’
‘এখানে আমি খেতে পারছি, ঘুমাতে পারছি। আমি বসবাস করছি ঠিকই; কিন্তু কোথাও যেতে পারছি না। আমরা বন্দি জীবন পার করছি; যেটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। দুই বছর, ১০ বছর নাকি ২০ বছর? আমরা জানি না, কতো বছর এভাবে জীবন পার করতে হবে।’
‘তারপরও আমি বিশ্বাস করি, একদিন ফিরে যাব। কখন? আমি জানি না। সহিংস পরিস্থিতি আরও বাড়ছে, বাড়ছে শরণার্থীর সংখ্যা। সেটা আমার হাতে নেই। সেটা স্রষ্টার হাতে।’
সূত্র : সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট।
কেএ/এসআইএস/আইআই