আন্তর্জাতিক গণ-আদালতে সু চির বিচারের রায় শুক্রবার
মিয়ানমারের ডি ফ্যাক্টো লিডার অং সান সু চি ও দেশটির সেনাপ্রধানসহ অন্যান্য কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মালয়েশিয়ায় আন্তর্জাতিক গণ-আদালতে বিচার শুরু হয়েছে। শুক্রবার সেই মামলার রায় ঘোষণা করা হবে।
শান্তিতে নোবেল বিজয়ী হয়েও এ ধরনের আদালতে বিচারের সম্মুখীন হচ্ছেন তিনি। এর আগে কোনো নোবেল বিজয়ী এ ধরনের বিড়ম্বনায় পড়েননি।
এদিকে মালয়েশিয়ার পুত্রাওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ৪ দিনব্যাপী শুরু হয়েছে মুসলিম ওয়ার্ল্ড বিজ ২০১৭। সেই সম্মেলনেও সু চি ও দেশটির সেনাপ্রধানসহ অন্যান্য কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ নিয়ে আলোচনা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
সোমবার মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে পার্মানেন্ট পিপলস ট্রাইব্যুনাল (পিপিটি) নামে একটি আদালতে শুনানি শুরু হয়। কুয়ালালামপুরের মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদে অনুষ্ঠিত এ শুনানিতে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশেষজ্ঞদের একটি প্যানেল অংশ নেয়।
এতে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ মাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনোসাইড স্ট্যাডিজ অ্যান্ড প্রিভেনশনের গবেষক অধ্যাপক গ্রেগরি স্ট্যানটন জবানবন্দি দিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার দায়ে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী, পুলিশ, অন্যান্য বৌদ্ধ সন্ত্রাসী এবং দেশটির বর্তমান বেসামরিক সরকার অভিযুক্ত।’
রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘তারা মিয়ানমারের সর্বস্তরে বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার। ওই শুনানিতে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হকও প্রায় ৩০ মিনিট বক্তব্য রাখেন।’
মঙ্গলবার ট্রাইব্যুনালে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিম নিপীড়নের বিষয়ে সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করা হয়। বিকেলে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে সমাপনী বক্তব্য শেষে বিবাদী পক্ষ বক্তব্য রাখেন।
বৃহস্পতিবার দিনভর বিচারকমন্ডলীর সদস্যরা তাদের বক্তব্য পেশ করবেন। আট সদস্যের বিচারক প্যানেলে রয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ তদন্তে যুক্ত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও আইনজীবীরা।
পিপিটি মালয়েশীয় শাখার সাংগঠনিক কমিটির সভাপতি চন্দ্র মোজাফফর বলেন, ‘পাঁচ দিনের অধিবেশনে বিচারকরা প্রসিকিউশনের যুক্তিতর্ক, ভুক্তভোগীদের জবানবন্দি বিচার বিশ্লেষণ করবেন। শুক্রবার স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় রায় ঘোষণা হবে। বিচারকদের এ রায় জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন ও গোষ্ঠীর কাছে পাঠানো হবে।’
ট্রাইব্যুনালে রোহিঙ্গা ও কাচিন সম্প্রদায়ের লোকজন তাদের ওপর চলা নিপীড়নের বর্ণনা দিয়েছেন। বিভিন্ন গণমাধ্যম বলছে, মিয়ানমারে সহিংসতায় পুরুষরা যেমন হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন, তেমনি নারীরা হয়েছেন ধর্ষণের শিকার। অনেক নারী আছেন যাদের ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে।
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থী রোহিঙ্গা নারীদের একটা বড় অংশ দেশটির সেনাবাহিনীর হাতে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।
পালিয়ে আসা পরিবারগুলো বলছে, অনেকে ধর্ষণের পর হত্যার শিকারও হয়েছেন।
মঙ্গলবার বিকেলে কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশনে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রেজুল হক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নির্যাতনের বিষয়ে জানান, ‘রোহিঙ্গা, ধর্ষণ, হত্যা ও অগ্নিসংযোগের এই ধরনের নিষ্ঠুর নিপীড়ন মানবজাতির ইতিহাসে বিরল।’
কমিশন প্রধান উখিয়া উপজেলার কুতুপালং, বালুখালি, টেকনাফের নয়াপাড়া ও লেদা পরিদর্শন করে ক্যাম্পের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন।
তিনি বলেন, একটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ওপর নিপীড়ন, হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের মিয়ানমারকে গণহত্যা থামানোর জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জানানো হয়েছে। এখন রাখাইন রাজ্যে নিপীড়ন বন্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিক কোয়ার্টার মিয়ানমারকে আহ্বান জানাচ্ছে, তবে মিয়ানমার কোনও মনোযোগ দিচ্ছে না।
২৫ আগস্টের পর সেনাবাহিনীর তাণ্ডব থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে চার লাখ ১০ হাজার রোহিঙ্গা। সীমান্তে স্থলমাইন পুঁতে রেখে বর্বরতার আরও চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসার সময় যেন সেই মাইন বিস্ফোরণে উড়ে গেছে অনেকের শরীরের বিভিন্ন অংশ। ইতোমধ্যে মাইন বিস্ফোরণে প্রাণ হারিয়েছে বেশ কিছু মানুষ।
কাজী রেজুল হক আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ এত বিপুল জনগোষ্ঠীর সুবিধা দিতে সক্ষম নয়, তবে আমাদের সরকার তাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য যথেষ্ট সহানুভূতিশীল।’
মালয়েশিয়া রোহিঙ্গা ইয়ূথ ডেভেলপমেন্টের সভাপতি মো. ফারুক বলেন, ‘মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর অত্যাচার চালিয়েছে। আমাদের মা-বাবা, ভাই-বোন ও শিশুদের নির্বিচারে মেরে ফেলছে। বিশ্ব মানবতা আজ এগিয়ে এসেছে।’
ফারুক আরও বলেন, ‘আল্লাহর সৃষ্টি আশরাফুল মাখলুকাতের চেয়ে পশুর মূল্য বেশি আছে। মানব জাতির কোনো মূল্য নেই এ পৃথিবীতে। রোহিঙ্গা মুসলিমরা কী অপরাধ করেছে যে নিজ দেশ থেকে মিয়ানমার সরকার তাদের বিতাড়িত করছে। আমরা এর পরিত্রাণ চাই। আমরা আমাদের দেশে ফিরে যেতে চাই।’
আমাদের বিপদের সময়ে বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। আমরা বাংলাদেশ সরকারের কাছে চির কৃতজ্ঞ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
কেএ/এমএস