অপহরণের পর নিখোঁজ সৌদির তিন যুবরাজ
সৌদি আরবের ভিন্ন মতাবলম্বী এক যুবরাজকে অপহরণ করে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। কয়েকজন পশ্চিমা সাক্ষী এই বিষয়ে কথা বলেছেন। বিবিসির এক তদন্তে বিষয়টি উঠে এসেছেঅ
তারা গত বছর প্রিন্স সুলতান বিন তুর্কী বিন আব্দুল আজিজের এক সফরের সঙ্গী ছিলেন। বিমানে চড়ে তারা ফ্রান্স থেকে মিসরে যাচ্ছেন বলেই জানতেন। কিন্তু বেসরকারি বিমান অবতরণ করে সৌদি আরবে। এরপর থেকে যুবরাজদের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এই অভিযোগের ব্যাপারে সৌদি সরকার মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
বিবিসির সংবাদদাতা রেদা আল মাওয়ি বলছেন, ইউরোপে বাস করতেন এমন তিনজন সৌদি যুবরাজ গত দু'বছরে নিখোঁজ হয়েছেন। তারা তিনজনই সৌদি সরকারের সমালোচক ছিলেন।
এমন প্রমাণ আছে যে, এই তিন জনকেই অপহরণ করা হয়েছে এবং বিমানে করে সৌদি আরবে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তারপর থেকে তাদের কোনো খোঁজ-খবর পাওয়া যায়নি। জেনেভা শহরের উপকণ্ঠে ২০০৩ সালের ১২ জুন একজন সৌদি প্রিন্সকে গাড়িতে করে একটি প্রাসাদে নিয়ে যাওয়া হয়।
সেই প্রিন্সের নাম সুলতান বিন তুরকি বিন আবদুল আজিজ। প্রাসাদটি হচ্ছে তার চাচা প্রয়াত বাদশাহ ফাহাদের। আর যিনি এই প্রিন্সকে প্রাতরাশের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, তিনি হলেন বাদশাহ ফাহাদের প্রিয় পুত্র প্রিন্স আবদুল আজিজ বিন ফাহাদ।
আবদুল আজিজ সুলতানকে বললেন, সৌদি আরবে ফিরে যেতে; কারণ সুলতান সৌদি নেতৃত্বের যে সমালোচনা করেছেন তা নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে এবং তার নিষ্পত্তি করতে হবে।
কিন্তু সুলতান তা মানলেন না। এরপর প্রিন্স আবদুল আজিজ একটা ফোন করতে ঘরের বাইরে গেলেন। তার সঙ্গেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন সৌদি আরবের ইসলাম বিষয়ক মন্ত্রী শেখ সালেহ আল-শেখ।
কয়েক মুহূর্ত পরেই ঘরে ঢুকল মুখোশধারী কয়েকজন লোক। তারা সুলতানকে মারধর করল, তার হাতে পরিয়ে দিল হাতকড়া। এর পর তার ঘাড়ে ঢুকিয়ে দেয়া হল একটা ইনজেকশনের সুচ।
সুলতান জ্ঞান হারালেন। তাকে দ্রুত নিয়ে যাওয়া হল জেনেভা বিমানবন্দরে। সেখানে অপেক্ষা করছিল একটি বিমান। অনেক বছর পর সুলতান সুইজারল্যান্ডের এক আদালতে এ ঘটনার বর্ণনা দেন। প্রিন্সি সুলতান কি করেছিলেন যে তার পরিবারের লোকেরাই তাকে এভাবে অপহরণ করল?
এর আগের বছর ইউরোপে চিকিৎসার জন্য এসে প্রিন্স সুলতান সৌদি সরকারের মানবাধিকার রেকর্ড, যুবরাজ ও কর্মকর্তাদের দুর্নীতির সমালোচনা করে কিছু সাক্ষাৎকার দেন, এবং কিছু সংস্কারের আহ্বান জানান।
সৌদি আরবে ১৯৩২ সালে বাদশাহ আবদুল আজিজ ইবনে সউদ ক্ষমতাসীন হবার পর থেকেই দেশটি একটি রাজতন্ত্র এবং এখানে ভিন্নমত সহ্য করা হয় না। রাজ পরিবারের অভ্যন্তরীণ বিবাদের কারণে প্রভাবশালী প্রিন্স তুরকি বিন বান্দার এর আগে জেল খেটেছেন।
ছাড়া পাওয়ার পর তিনি প্যারিসে পালিয়ে যান এবং সৌদি আরবে সংস্কার দাবি করে ইউটিউবে ভিডিও ছাড়েন। তখন তার ওপর চাপ দেয়া হয় দেশে ফেরার জন্য। তাকে ফোন করেন ডেপুটি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আহমেদ আল-সালেম।
সেই টেলিফোন আলাপ রেকর্ড করে রাখেন প্রিন্স, এবং পরে তা অনলাইনে প্রকাশ করেন। প্রিন্স তুরকি ২০১৫ সালের জুলাই পর্যন্ত ভিডিও পোস্ট করেন। তার কিছুদিন পরই তিনি হঠাৎ উধাও হয়ে যান।
সৌদি ব্লগার ওয়ায়েল আল-খালাফ বলেন, পরে আমি একজন কর্মকর্তার কাছে শুনেছি যে তুরকি বিন বান্দার তাদের সঙ্গেই আছেন। তার মানে তাকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পরে মরক্কোর এক পত্রিকায় দেখেছি তাকে মরক্কোতেই গ্রেফতার করা হয়, এবং সৌদি আরবের অনুরোধে সেখানে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
একই সময় প্রিন্স সৌদ বিন সাইফ আল-নাসর নামের আরেকজন যুবরাজেরও একই পরিণতি হয়। তিনি ইউরোপের ক্যাসিনো এবং ব্যয়বহুল হোটেল পছন্দ করতেন। ২০১৪ সালে তিনি সৌদি রাজতন্ত্রের সমালোচনা করে টুইট করতে শুরু করেন।
তার ভাষায়, যেসব সৌদি কর্মকর্তা মিসরের প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মুরসিকে উৎখাত করায় সমর্থন দিয়েছিলেন; তাদের বিচার দাবি করেন তিনি। এরপর ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি আরও দুঃসাহসিক কাজ করেন।
বাদশাহ সালমানকে উৎখাত করার আহ্বান জানিয়ে দুটি চিঠি লেখেন এক অজ্ঞাত যুবরাজ, এবং প্রিন্স আল-নাসর তাকে প্রকাশ্যে সমর্থন জানান।
রাজপরিবারে কেউ এর আগে এ কাজ করেননি, এবং এটা ছিল রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল। এর কয়েকদিন পরই তার টুইটার অ্যাকাউন্টটি নিরব হয়ে যায়। প্রিন্স খালেদ বিন ফারহান নামে আরেকজন ভিন্ন মতাবলম্বী সৌদি যুবরাজ খালেদ বিন ফারহান ২০১৩ সালে জার্মানি পালিয়ে যান।
কিন্তু সেখান থেকে তাকে কৌশলে রিয়াদে নিয়ে যায় সম্ভবত সৌদি গোয়েন্দারা। ইতোমধ্যে বন্দি অবস্থায় প্রিন্স সুলতান অসুস্থ হয়ে পড়ায় ২০১০ সালে রাজ পরিবার তাকে যুক্তরাষ্ট্রের বস্টন শহরে চিকিৎসার জন্য যাবার অনুমতি দেয়। আর সেখান থেকেই প্রিন্স সুইস কোর্টে এক মামলা ঠুকে দেন।
তাতে তিনি তাকে অপহরণের জন্য প্রিন্স আবদুল আজিজ বিন ফাহাদ, এবং শেখ সালেহ আল-শেখকে দায়ী করেন। তবে সুইস সরকার এ মামলায় তেমন কোনো উৎসাহ দেখায়নি। কীভাবে সুইস বিমানবন্দর থেকে তাকে বিমানে করে তুলে নিয়ে যাওয়া হল তার তেমন কোনো তদন্তও হয়নি।
গত বছর জানুয়ারি মাসে সুলতান ছিলেন প্যারিসের একটি হোটেলে। তিনি কায়রোতে তার পিতাকে দেখতে যাচ্ছিলেন। তখন সৌদি কনস্যুলেট তার যাত্রার জন্য একটি প্রাইভেট জেট বিমান দেয়ার প্রস্তাব দেয়।
২০০৩ সালের ঘটনা সত্ত্বেও প্রিন্স তা গ্রহণ করেন। তার সঙ্গে ছিলেন তার নিজস্ব চিকিৎসক এবং ইউরোপীয় ও মার্কিন দেহরক্ষীসহ অন্তত ১৮ জন।
পরে, নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই দলের দু’জন বর্ণনা করেছেন বিমানে ঘটে যাওয়া ঘটনা। তারা বলেন, আমরা একটি বিশাল বিমানে উঠলাম, তার গায়ে সৌদি আরবের নাম লেখা ছিল। আমরা দেখলাম তাতে প্রচুর ক্রু আছেন, এবং তারা সবাই পুরুষ। আমাদের কেমন যেন লাগল।
বিমানের ভেতরে মনিটরে দেখা যাচ্ছিল আমরা কায়রো যাচ্ছি। কিন্তু আড়াই ঘন্টা পর মনিটরগুলো অন্ধকার হয়ে গেল।" "প্রিন্স সুলতান ঘুমাচ্ছিলেন, তবে অবতরণের এক ঘন্টা আগে তিনি জেগে উঠলেন। জানালা দিয়ে তাকালেন। তাকে উদ্বিগ্ন মনে হল।
আরোহীরা যখন বুঝতে পারলেন যে, তারা সৌদি আরবে অবতরণ করতে যাচ্ছেন, তখন সুলতান ককপিটের দরজায় বার বার করাঘাত করতে লাগলেন, সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে লাগলেন। ক্রুদের একজন প্রিন্সের সঙ্গীদের সিটে বসে থাকতে বলল।
বিমান নামার পর রাইফেলধারী কিছু লোক বিমানটি ঘিরে ফেলল। সৈন্য এবং কেবিন ক্রুরা মিলে সুলতানকে বিমান থেকে টেনে হিঁচড়ে নামাল। তিনি চিৎকার করে তার দলকে বলছিলেন মার্কিন দূতাবাসে ফোন করতে।
প্রিন্স এবং তার চিকিৎসকদের একটি বাড়িতে নিয়ে সশস্ত্র প্রহরায় আটকে রাখা হল। তার সফর সঙ্গীদের তিনদিন হোটেলে আটকে রাখার পর যার যার দেশে ফেরত পাঠান হল। এ ঘটনার পর থেকে প্রিন্স সুলতানের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
অপহরণের অভিযোগের ব্যাপারে সৌদি সরকার মন্তব্য করতেও অস্বীকার করে। প্রিন্স খালেদ যিনি এখনও জার্মানিতে আছেন, আশঙ্কা করছেন তাকেও একদিন জোর করে রিয়াদে নিয়ে যাওয়া হবে।
সৌদি রাজ পরিবারের সমালোচনা করেছে এমন ওই পরিবারের চারজন সদস্য ইউরোপে ছিল। তিনি বলেন, তিন জনকে অপহরণ করে সৌদি আরবে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। শুধু আমিই বাকি। এর পর কি তার পালা?
তিনি বলেন, আমি নিশ্চিত যে, তাই হবে। অনেক দিন ধরেই তা মনে হচ্ছে। তারা যদি পারত এতদিনে কাজটা করেও ফেলত। আমি খুবই সাবধানে থাকি।
সূত্র : খালিজ টাইমস, দ্য ইনডিপেনডেন্ট, বিবিসি
কেএ/পিআর