কাতার সংকট ও মুসলিম ব্রাদারহুড
সৌদি আরবের নেতৃত্বে কাতারের সঙ্গে আটটি দেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নের পর আলোচনায় এসেছে মুসলিম ব্রাদারহুড। চলতি মাসের ৫ তারিখ সৌদি আরবের নেতৃত্বে কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন শুরু হয়। ৭ জুন সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল বিন আহমেদ আল জুবাইর প্যারিস ভ্রমণে গিয়েও কাতারকে হামাস এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতি সমর্থন বন্ধের কথা বলেছেন।
সৌদি আরবের নেতৃত্বে মিসর, সংযুক্ত আরব অমিরাত ও বাহরাইনসহ এখন পর্যন্ত আটটি দেশ কাতারের সঙ্গে তাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। মুসলিম ব্রাদারহুড এবং হামাসের প্রতি সমর্থনের অভিযোগে কাতার এখন একাধারে সৌদি, আমিরাত, ইসরায়েলের শত্রুতে পরিণত হয়েছে।
জঙ্গি গোষ্ঠীদের সঙ্গে কাতারের ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানের সম্পৃক্ততার ব্যাপারে সৌদি আরব এবং উপসাগরীয় দেশগুলো একটি নথি প্রকাশ করেছে। সেখানেও উল্লেখ করা হচ্ছে মুসলিম ব্রাদারহুডকে সমর্থন এবং অর্থায়নের বিষয়টি।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন বলছেন, জঙ্গি সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুড অত্যন্ত বিপজ্জনক। কিন্তু কারা এই মুসলিম ব্রাদারহুড? মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো কেনো তাদের এতো ভয় পাচ্ছে? তারা কি এতোটাই বিপজ্জনক! আসুন মুসলিম ব্রাদারহুড সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক।
কারা এই মুসলিম ব্রাদারহুড
মুসলিম ব্রাদারহুড শব্দ দুটি ইংরেজি। মিসরের লোকজন আরবিতে ইখওয়ানুল মুসলিমিন বলে থাকে। আরববিশ্বে এই মুসলিম ব্রাদারহুড সবচেয়ে পুরাতন ইসলামি সংগঠন। তবে আরববিশ্বের কিছু দেশে সংগঠনটি নিষিদ্ধ।
কখন এবং কোথায় এর উদ্ভব
মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতিষ্ঠাতা হাসানুল বান্না। ১৯২৮ সালে তিনি এ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। মিসরের আল-আজহারের এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন হাসানুল বান্না। সার্বজনীন ইসলামি শাসন ব্যবস্থা কায়েম করার উদ্দেশ্য ছিল তার। সেই দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবায়ন হবে ইসলামি আইন ও নৈতিকতা প্রচারের মাধ্যমে, সমাজ সেবা করার মাধ্যমে, সমাজকে সংগঠিত করার মাধ্যমে বলে মনে করেন তিনি।
ব্রাদারহুডের প্রতি প্রথমদিককার বাধা, প্রতিক্রিয়া ও সমর্থন
১৯৪৮ সালে মিসরের বাদশাহ ফারুক প্রথমবার ব্রাদারহুডকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তারও আগে ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৯ সালে বাদশাহ ফারুকের আদেশে একদিন মসজিদে যাওয়ার সময় হাসানুল বান্নাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ১৯৫৪ সালের পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্য সংখ্যা ৫০ লাখ। সে সময় ফিলিস্তিন, সিরিয়া ইরাক ও লেবাননে ব্রাদারহুডের তিনশ ৫০টি শাখা ছিল।
মিসরের ডিক্টেটর প্রধানমন্ত্রী কর্নেল জামাল আবদুন নাসের মুসলিম ব্রাদারহুডকে পুনরায় বেআইনি ঘোষণা করেন ১৯৫৪ সালে। ব্রাদারহুডের শীর্ষনেতা ড. হাসানুল হোদায়বীকে গ্রেফতার করা হয় সেবছর ৮ অক্টোবর। তিনি ছিলেন বান্নার উত্তরসুরি। কর্নেল নাসের ব্রাদারহুডের কেন্দ্রীয় অফিসসহ চারশ শাখা অফিসে তালা ঝুলিয়ে দেন। ব্রাদারহুড কর্তৃক পরিচালিত স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, হাসপাতাল ও কো-অপারেটিভ প্রতিষ্ঠানগুলোও বন্ধ করে দেয়া হয়।
হোদায়বীর সঙ্গে মুসলিম ব্রাদারহুডের আরও ৬ জন নেতা, মাহমুদ আবদুল লতিফ, ইউসুফ তালাত, আবদুল কাদের ওদা, হিন্দওয়ে দিওয়ার, ইব্রাহিম আল তৈয়ব ও মুহম্মদ ফারাগ আলীকে গ্রেফতার করে সামরিক আইনে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। কর্নেল জামাল আবদুন নাসেরের সরকার উচ্ছেদের চেষ্টার অভিযোগ এনে তাদের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়া হয়েছিল।
তবে মুসলিম বিশ্বের চাপের মুখে হোদায়বীর দণ্ড কার্যকর না করে বাকি ৬ জনকে ৭ ডিসেম্বর ১৯৫৪ সালে সকাল ৮টা থেকে ১১টার মধ্যে আধাঘণ্টা পরপর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারা হয়। সেসময় সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান, সৌদি আরব, ইরাক, ইরান, সুদান পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়াসহ প্রায় সব মুসলিম রাষ্ট্র ব্রাদারহুড নেতাদের মুক্তির দাবিতে মিসরের সরকারের কাছে তারবার্তা পাঠিয়েছিল। কিন্তু কোনো অনুরোধই নাসেরের মন গলাতে পারেনি।
তাদের মতাদর্শ
আরব বিশ্বে বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা সংস্কারের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করাই হল মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রধান লক্ষ। কুরআনের বিশ্লেষণ ও আজকের বৈজ্ঞানিক জগতে তার প্রয়োগ করা; ঘনিষ্ঠতর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ইসলামি আইন-কানুনসমূহের সঠিক ব্যাখ্যা নিরূপণের জন্য ইসলামি রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সহযোগিতা করা; ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থনৈতিক সম্পদের সঠিক ব্যবহার ও সামাজিক শ্রেণিসমূহের পুনর্বিন্যাস করাই তাদের উদ্দেশ্য। বিশ্বের মুসলিমদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার জন্য দরিদ্র্য, অসহায় ও অজ্ঞতার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা, বিদেশি প্রভুত্ব বা শোষণ থেকে মুসলিম দেশগুলোকে মুক্ত করা এবং পৃথিবীর সর্বত্র মুসলমান সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষা করতে চান তারা।
তাদের মতাদর্শ কি পরিবর্তন হয়েছে?
এতো বছরে মুসলিম ব্রাদারহুডের অনেক মতাদর্শ বদলে গেছে। বদলে গেছে অনেক নেতা। তবে সবসময় তারা ইসলামি আইন দিয়ে দেশ পরিচালনা করতে চাই।
যারা মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা
মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডের সর্বোচ্চ নেতা মোহাম্মদ বাদি। বর্তমানে কারাগারে আছেন তিনি। তারা বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ রয়েছে। তবে সাবেক অনেক নেতার কথা জানা যায়। হাসানুল হোদায়বী তাদের মধ্যে অন্যতম। ব্রাদারহুডে যোগদানের আগে মিসর হাইকোর্টের একজন বিচারপতি ছিলেন তিনি। ১৯৫১ সালে তিনি বিচারপতি পদে ইস্তফা দিয়ে মুসলিম ব্রাদারহুডে যোগদান করেন।
আবদুল কাদের ওদা মিসরের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি। ১৯৫০ সালে তিনি বিচারপতি পদে ইস্তাফা দিয়ে ব্রাদারহুডে যোগদান করেন। ইউসুফ তালাত একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ছিলেন।
মুহাম্মদ ফারাগ আলী ছিলেন হাসানুল বান্নার ঘনিষ্ঠ সহযোগী। তিনি ব্রাদারহুডের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন। ইতোপূর্বে প্রথম যখন ব্রাদারহুডকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছিলো, তখনও তিনি ‘শান্তি ভঙ্গকারী’ হিসেবে অভিযুক্ত হন এবং পরে বেকসুর খালাস পান। ১৯৫০ সালে মিসরে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় ফারাগ আলী গেরিলা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক মনোনীত হয়েছিলেন। তাকে নাসের সরকার যখন ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারতে উদ্যত হলে, ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন, বড় সুখের বিষয় যে, আমি আজ শাহাদাত লাভ করতে যাচ্ছি।
ইব্রাহিম আল-তৈয়ব ছিলেন মুসলিম ব্রাদারহুডের এক তরুণ নেতা। আইন বিষয়ে পাস করেছিলেন তিনি। ব্রাদারহুডের হেড অফিসে আইন বিভাগে কাজ করতেন। আধুনিক সমাজকাঠামোতে ইসলামি আইনের প্রয়োগ সম্পর্কে গবেষণারত ছিলেন এই যুবনেতা। রাজা ফারুকের শাসনামলে তিনি ১৯৪৯ সালে ৯ মাস কারাবরণ করেন এবং ১৯৫৪ সালে কর্নেল নাসের তাকে ২ মাস কারাগারে অবরুদ্ধ রেখে নির্যাতন করেছিল।
মুসলিম ব্রাদারহুড কি জঙ্গি সংগঠন
প্রথমদিকে মুসলিম ব্রাদারহুড মিসরে ব্রিটিশ দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। রাজতন্ত্র থেকে মিসরকে মুক্ত করতেও তারা সহযোগিতা করেছে। কিন্তু আবদেল নাসের ধর্ম নিরপক্ষ রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা করলে তারা বেঁকে যায়। তারা ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। এর জেরে ১৯৫০ সালে ব্রাদারহুপের নেতাদের জেলেও পুরে দেন নাসের।
মিসরের রাষ্ট্রপতি আনোয়ার আল-সাদাতের শাসনামলে ১৯৭০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে সহিংসতার ঘোষণা দেয় মুসলিম ব্রাদারহুড। ১৯৯৫ সালে এসে গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করে সংগঠনটি।
সর্বশেষে ২০১১ সালে ব্রাদারহুড মিসরের সাধারণ মানুষের নেতৃত্বের সামনে চলে আসে। ফলে গণবিক্ষোভের মুখে স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের বিদায়ের পর মিসরের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বোচ্চ পরিষদ (স্কাপ) ১৮ মাস সে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নানামুখী কাজ করে। এসব কাজের মধ্যে ছিলো হোসনি মোবারক ও তার সহযোগীদের বিচার, বিভিন্ন অনিয়ম ও অবিচার সম্পর্কে তদন্ত পরিচালনা এবং সর্বোপরি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন পরিচালনা।
গণতান্ত্রিক পদ্ধতির নির্বাচনে ব্রাদারহুড নেতা মুহম্মদ মুরসি ক্ষমতায় এলেও তিনি এমন এক পরিস্থিতিতে হাল ধরেন যখন দেশে কোন পার্লামেন্ট নেই, স্থায়ী কোন সংবিধান নেই, বিধিসংগত ব্যবস্থা নেই। এমতাবস্থায় স্কাপের নিয়মনীতি অনুসরণ করে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে এগোতে থাকেন তিনি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মুসলিম ব্রাদারহুডকে কোনদিনই ভাল চোখে দেখেনি। তাই মার্কিন প্রশাসনের নিকট মুরসি’র গ্রহণযোগ্যতা না পাবারই কথা। ২০১১ সালে দেশটির প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুহম্মদ মুরসি সরকারের পতন ঘটে।
যে দেশে মুসলিম ব্রাদারহুড সক্রিয়
মিসর হল মুসলিম ব্রাদারহুডের জন্মভূমি। এছাড়া আরববিশ্বের অনেক লোক তাদের মতাদর্শে বিশ্বাস করে। ফিলিস্তিনের হামাস, তিউনিসিয়ার ইন্নাহদা পার্টি, কুয়েতের ইসলামি কন্সটিটিউশনাল মুভমেন্ট তাদের সমর্থন করে। জর্ডানে ইসলামি অ্যাকশন ফ্রন্টের প্রতিনিধিত্ব করে মুসলিম ব্রাদারহুড। জর্ডানের পার্লামেন্টের বৃহত্তম ব্লকের রাজনৈতিক দল এই ইসলামি অ্যাকশন ফ্রন্ট। বাহরাইনের রাজনৈতিক দল মিনবার ব্রাদারহুড সমর্থন করে।
যারা বলছে ব্রাদারহুড জঙ্গি সংগঠন
মুসলিম ব্রাদারহুডকে জঙ্গি সংগঠন বলছে বাহরাইন, মিসর, রাশিয়া, সৌদি আরব, সিরিয়া এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত। দেশগুলো বরাবরই মুসলিম ব্রাদারহুডের বিরোধিতা করে আসছে।
ব্রাদারহুডকে অপছন্দের কারণ
২০১৪ সালে মুসলিম ব্রাদারহুডকে জঙ্গি সংগঠন বলে ঘোষণা দেয়। কারণ ব্রাদারহুড সুন্নি মতবাদে বিশ্বাসী। বিশ্লেষকরা বলছেন, তারা সুন্নি হিসেব একটি ভাল ব্র্যান্ড। তারা রাজনীতিতে অংশ নিলে এবং নির্বাচনী বৈধতা পেলে, সৌদি আরব ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে সৌদিও যে নিয়ন্ত্রণ তাতে ভাটা পড়তে পারে। অস্তিত্বগত হুমকি হিসেবে দেখা হয় ব্রাদারহুডকে। কারণ এটি ইসলামি রাজনীতির একটি ভিন্ন মডেলের প্রস্তাব দেয় সৌদি রাষ্ট্রকে। সেকারণে ব্রাদারহুডকে জঙ্গি বানিয়ে দেয় সৌদিসহ অন্যান্য দেশগুলো।
সূত্র : আল-জাজিরা।
কেএ