সৌদি অবরোধে চাপা আতঙ্ক দোহায়
হানান। কাতারে বসবাসরত মিসরীয় চিকিৎসক। গত চার বছর ধরে দেশটিতে বসবাস করছেন তিনি। শুক্রবার হঠাৎ করেই স্যুটকেস কিনতে হয় তাকে। ইতোমধ্যেই জমানো অর্থ মিসরের ব্যাংকে স্থানান্তরও করেছেন। বাচ্চাদের স্কুল থেকেও পড়াশোনা সংক্রান্ত কাগজপত্র সংগ্রহ করেছেন। অথচ কয়েকদিন আগেও তিনি ভাবেননি মিসরে ফিরে যাবেন। কিন্তু হঠাৎ করে মিসরে ফিরে যাওয়ার সময় যথাসম্ভব জিনিসপত্র স্যুটকেসে পুরে নিতে হয়েছে তাকে। কারণ তিনি আসলে জানেন না, আর কখনও কাতারে ফিরে আসা হবে কি না।
মিসরের সব নাগরিকই এখানে অস্বস্তিতে থাকার কথা জানান হানান। তিনি আরও বলেন, অামরা জানি না আসলে কী ঘটতে যাচ্ছে। সম্ভবত শেষ পর্যন্ত কাতার আমাদের চলে যেতে বলবে, কিংবা মিসর ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিবে। সংকটের ব্যাপারে মতামত দিলেও নিজের পরিবারের কারও নাম প্রকাশ করতে ভয় পাচ্ছিলেন তিনি।
সৌদি আরবের নেতৃত্বে অাটটি দেশ কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নের এক সপ্তাহ পরে এসে এ ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে। গত ৫ জুন সৌদি আরবের নেতৃত্বে মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। পরে সম্পর্ক ছিন্নের এই তালিকায় যোগ দেয়, লিবিয়া, ইয়েমেন, জর্ডান ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মালদ্বীপ। দেশগুলো কাতারের বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদে সমর্থন ও অর্থায়নের অভিযোগ করেছে। তবে কাতার সেই অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছে।
কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নের পর কাতারের জন্য আকাশ, স্থল ও সমুদ্র সীমা ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলো। একই সঙ্গে কাতার থেকে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন তাদের নাগরিকদের ১৪ দিনের মধ্যে নিজ দেশে ফেরার নির্দেশ দিয়েছে। এছাড়া এসব দেশ থেকে একই সময়ের মধ্যে কাতারি নাগরিকদেরও ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
কাতারে বসবাসরত বিদেশি নাগরিকরা এখন ভয়, অনিশ্চয়তা এবং অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্যে দিন পার করছেন। রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সংকটের মধ্যে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্নভাবে দিন কাটছে তাদের।
কাতারে মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কার বিষয়ে সতর্ক করেছেন মাকির্ন পররাষ্টমন্ত্রী রেক্স টিলারসন। সৌদি আরবের নেতৃত্বে কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার জন্য শুক্রবার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। সংকটের মধ্যে বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারছে না বলে জানিয়েছেন তিনি।
কাতারের সংকটে যুক্তরাষ্ট্রের এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। যদিও মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) এর বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
তবে টিলারসনের ওই বক্তব্যের এক ঘণ্টারও কম সময় পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, কাতার ঐতিহাসিকভাবে জঙ্গি গোষ্ঠীকে বড় অংকের অর্থায়ন করে আসছে।
সৌদি আরবের নেতৃত্বে কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা দেশগুলো ট্রাম্পের বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছে। তবে টিলারসনের মন্তব্যের ব্যাপারে কোনো সাড়া দেননি তারা। জঙ্গিবাদে অর্থায়ন ও সমর্থনের জন্য কাতারকে দায়ী করার জন্য শুক্রবার সংযুক্ত আরব আমিরাতের সরকার এক বিবৃতির মাধ্যমে ট্রাম্পের প্রশংসা করেছেন।
কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নের পর প্রতিবেশি দেশগুলো কাতারের জন্য অাকাশ, স্থল ও সমুদ্রবন্দরে নিষেধাজ্ঞা জারী করেছে। এতে করে ৮০ শতাংশ আমদানিনির্ভর খাদ্যের ওপর নির্ভরশীল কাতার কার্যত অচল হয়ে পড়েছে।
মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল শুক্রবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে উপসাগরীয় অঞ্চলের নাগরিকদের জীবন যাপনে বিঘ্ন সৃষ্টি করা হচ্ছে। এতে করে মানুষজন বড় ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। বাবা-মার কাছ থেকে বাচ্চারা দূরে চলে যাচ্ছে, স্ত্রীর কাছ থেকে স্বামী আলাদা হয়ে যাচ্ছে। অনেকে চাকরি, শিক্ষা হারিয়ে নিজ দেশে ফিরতে বাধ্য হচ্ছে। এতে করে বহু মানুষ সমস্যায় পড়েছে।
ওয়ালা এল কাদি বলছেন, উপসাগরীয় অন্যান্য দেশে হয়তো আমরা যাওয়ার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে পারি। অথচ বহু বছর ধরে কাতারে বসবাস করছেন তিনি।
লেবাননের মুস্তাফা ভীত সন্ত্রস্ত্র হয়ে পড়ার কথা জানিয়েছেন। নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। বিভিন্ন প্রজেক্টে কাজে গড়িমসি হওয়ার কথা বলেন তিনি। তাদের প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সংকটের কারণে স্টকে থাকা জিনিসপত্র দিয়ে কাজ চালিয়ে নিচ্ছে। তবে তিনিও পরিবারে কারও এমনকি নিজের পুরো নাম ঠিকানা জানাতে নারাজ।
কারণ, কাতারকে সমানুভূতি দেখালে বাহরাইন এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত শাস্তি ঘোষণা করেছে। এছাড়া কাতারে আবার ফোনালাপ থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর ওপর নজরদারি চালানো হচ্ছে। এতে করেও অত্যন্ত সতর্কতার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে সেখানকার বাসিন্দাদের।
তবে ভাবষ্যতে খাবার নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন রয়েছেন কাতারের লোকজন। হাইথেম ইলগামাল বলছেন, এখন ১২ কেজি পেঁয়াজ কিনলাম আমি। কিন্তু আমার তো আরও পেঁয়াজ লাগবে। পরে কী করব?
বিভিন্ন দেশ কাতারের সঙ্গে তাদের বিমানের ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছে। এতে করে পরবর্তী সময়ে দেশে ফেরা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন অনেকেই। এটা অত্যন্ত বাজে ব্যাপার বলে মনে করছেন তারা।
কেউ কেউ ভাবছেন যুদ্ধ বোধ হয় নিকটবর্তী। প্রতিবেশি দেশগুলো হয়তো কাতারের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে যেতে পারে। কারণ, কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নের পর অাকাশ, স্থল ও সমুদ্রবন্দরে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পাশাপাশি আনুষাঙ্গিক বিষয়েও কড়াকড়ি করেছে দেশগুলো। সৌদি আরব তাদের দেশে বার্সেলোনার জার্সি পর্যন্ত নিষিদ্ধ করেছে কাতার এয়ারওয়েজের লোগো থাকায় ।
অনেকে ভাবছেন, আমি তো আর সৌদি অারব কিংবা সংযুক্ত আরব আমিরাতের পণ্য কিনতে পারব না।
এতো সংকটের মধ্যেও কাতার ছাড়তে নারাজ অনেকেই। ইলগামাল বলছেন, আমি কখনোই কাতার ছেড়ে মিসরে যাব না। কারণ, মিসরের নাগরিক হলেও তার জন্ম কাতারে।
হানানের বন্ধুরা প্রত্যেকদিন তাকে ফেসবুক, ই-মেইলে বার্তা পাঠিয়ে তার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছে। তার মত অনেকেই ভাবছেন দেশে ফিরে গিয়ে আর কাতারে আসতে পারবেন না। সেকারণেই তিনি সবকিছু নিয়ে যাচ্ছেন মিসরে। সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন হতাশা আর শঙ্কা। এই শঙ্কার শেষ কোথায় তা সময়ই বলে দেবে।
সূত্র : ওয়াশিংটন পোস্ট
কেএ/পিআর