‘এটা ছিল নৃশংস তাণ্ডব’
লন্ডন ব্রিজ ও বোরো মার্কেট হামলার প্রত্যক্ষদর্শীদের কণ্ঠে উঠে এসেছে সন্ত্রাসীদের ভয়াবহ তাণ্ডবের চিত্র; যার শুরু হয়েছিল স্থানীয় সময় শনিবার রাত ১০টার কিছু পর।
হামলায় আক্রান্তদের অনেকেই সেন্ট্রাল লন্ডনে রাতের খাবারের জন্য ছিলেন অথবা চ্যাম্পিয়ন লিগের ফাইনাল ম্যাচ দেখার জন্য বিভিন্ন বারে অবস্থান করেছিলেন। তারা বলেছেন ভয়াবহ ও ভীতিকর এ হামলার ঘটনা।
তারা বলেন, লন্ডন ব্রিজে একটি ভ্যান ঢুকে পড়ে, পথচারীদের ওপর তুলে দেয়া হয়। যখন এটি থেমে যায়, তখন এর পেছনের দরজা খোলা ছিল। বেশ কয়েকজন লোক লাফিয়ে বের হয়। জনপ্রিয় ও ব্যস্ত এই এলাকার বারে তারা প্রবেশ করে। সন্ধ্যা উপভোগের জন্য বের হওয়া লোকজনকে ছুরিকাঘাত করতে থাকে।
হামলাকারীদের ঠেকাতে বোতল ও চেয়ার ছুড়ে মারেন আক্রান্ত ব্যক্তিরা। ব্রিটেনের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানে কাজ করেন বেথানি আতকিন। বোরো বিস্ত্র নামের ছোট্ট একটি রেস্তোরাঁয় ছিলেন তিনি। বোরো হাই স্ট্রিটের ছোট্ট একটি সেতুর নিচে এই রেস্তোরাঁর অবস্থান।
বেথানি আতকিন বলেন, আমরা সেতুর নিচের একটি ছাতার তলায় বসেছিলাম। সেতুর ওপর একটি গাড়ি হুড়মুড় করে আঘাত হানে। এসময় সেতু থেকে আমাদের ছাতার ওপর ধ্বংসাবশেষ আছড়ে পড়ে।
‘আমরা দাঁড়িয়ে যাই, সকলেই দৌড় শুরু করেন। আমি একজনকে দেখতে পাই, যার শরীর থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। আমি জানি না তার আঘাত কতটা গুরুতর। আমরা রেস্তোরাঁর ভেতর ঢুকে নিরাপদ স্থান খোঁজার চেষ্টা করি; কিন্তু সেখানে কোনো নিরাপদ স্থান ছিল না।’
দৌড়ে বেরিয়ে এসে আতকিন অপর এক মর্মান্তিক দৃশ্য দেখতে পান। ‘আমরা সেতু থেকে মাত্র ২০ মিটার দূরে রক্তাক্ত এক নারীকে দেখতে পােই। আমি তাকে রাস্তায় পড়ে যেতে দেখি।’
আতকিন নিরাপদ স্থানের খোঁজে দৌড়ে লন্ডন ব্রিজ হাসপাতালে যান কিন্তু সেখানে তিনি ভয়াবহ ঘটনার মুখোমুখি হন। ‘এক ব্যক্তি চিৎকার করছিলেন এবং তারপর প্রত্যেকেই চিৎকার করেন এবং ওই ব্যক্তির কাছ থেকে সবাই পালানোর চেষ্টা করেন। এটা ছিল খুবই ভয়ানক।’
শনিবার রাত ১০টা ৮ মিনিটে মেট্রোপলিটন পুলিশ লন্ডন ব্রিজের ঘটনা সম্পর্কে জানতে পায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, প্রথম টেলিফোন কল পাওয়ার আট মিনিটের মাথায় সন্দেহভাজন তিন হামলাকারীকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে পুলিশ।
মার্ক নামের এক ব্যক্তি বিবিসিকে বলেন, লন্ডন ব্রিজের পথচারীদের আঘাত হানে একটি ভ্যান; তিনি ওই ভ্যানের ছবি ক্যামেরায় ধারণ করছিলেন। এটা ব্রিজের পাশ ধরে লোকজনের ওপর আঘাত হানে। আমি দেখতে পাই, এটি লোকজনকে আঘাত হানছে। আমার সামনে ২০-৩০ জনের একটি দল ছিল। ভ্যানটি তাদের ওপরও আঘাত হানে। এমন সময় আমি চিন্তা করি; আসলে কোন দিক দিয়ে আমার পালানো উচিত।
উইল হ্যাভেন নামের এক সাংবাদিক হামলার সময় ব্রিজ পার হয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি স্কাই নিউজকে বলেন, এটা ছিল প্রায় রাত ১০টা ১০ মিনিট। আমি উবারের ক্যাবে লন্ডন ব্রিজ হয়ে দক্ষিণের দিকে যাচ্ছিলাম।
হঠাৎ আমার বাম দিকে ব্রিজের ওপর কেউ একজন পড়ে যান। এসময় বেশ কিছু উদ্বিগ্ন মানুষ তাকে ঘিরে ধরেন। আমি ভেবেছিলাম কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সেখান থেকে একটু সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে রাস্তার ওপর আরেকজনকে পড়ে থাকতে দেখি। তখন ধরে নিই যে, সেখানে খুবই ভয়ানক কিছু ঘটছে।
‘এ সময় রাস্তায় জ্যাম শুরু হয়। উবার চালক বলেন, এখানে খারাপ কিছু ঘটছে। আমরা সাইরেনের শব্দ শুনতে পাই।’
‘ব্ল্যাক ক্যাবের এক চালক বলেন, সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। তারা রাস্তায় অনেক মানুষকে পড়ে থাকতে দেখেছেন। অপর এক ক্যাবচালক বলেন, সেখানে সিরিজ ছুরি হামলা হয়েছে।
প্রচুর রক্ত এবং মরদেহ
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ২৫ বছর বয়সী এক ব্যক্তি গার্ডিয়ানকে বলেন, তিনি ব্রিজে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় তিনি এক ব্যক্তি ও এক গর্ভবতী নারীকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেছেন।
তিনি বলেন, আমরা ভেবেছিলাম, এটা সড়ক দুর্ঘটনা। কিন্তু এগিয়ে গিয়ে দেখি, রাস্তায় প্রচুর রক্ত ও মরদেহ পড়ে আছে। রাস্তার ডান দিকে গর্ভবতী এক নারী ও বাম দিকে মারাত্মক আহত অবস্থায় এক ব্যক্তিকে দেখেছি। ওই ব্যক্তি নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। তবে ওই নারী বেঁচে ছিলেন কিনা তা আমরা জানতে পারিনি।
১২ ইঞ্চির ছুরি হাতে হত্যা
ছুরি হাতে এক ব্যক্তি দুজনকে হত্যা করেন। হামলা যে শেষ হয়ে যায়নি তা খুব দ্রুতই পরিষ্কার হয়ে উঠে। হামলাকারীরা লন্ডন ব্রিজের বিভিন্ন বার ও দোকানে দৌড়ে গিয়ে লোকজনকে ছুরিকাঘাত করে।
এরিক নামের এক প্রত্যক্ষদর্শী বিবিসিকে বলেন, তিন ব্যক্তি গাড়ি থেকে লাফিয়ে বের হয়ে লোকজনের ওপর ছুরি নিয়ে হামলে পড়ে। তারা সিঁড়ি বেয়ে চিৎকার করতে করতে ওপরে উঠতে থাকে এবং ছুরিকাঘাত করে। তাদেরকে বলতে শোনা যায়, এটা আল্লাহর জন্য।
বোরোর শিপ বারে চ্যাম্পিয়নস লিগের খেলা দেখছিলেন জিরার্ড ভাউলস (৪৭)। তিনি লন্ডন ব্রিজের দক্ষিণের মাথায় ছিলেন। তিনি দেখতে পান, এক নারীকে ঘিরে ধরে ১০ থেকে ১৫ বার ছুরিকাঘাত করে তিন ব্যক্তি।
‘তিনি আমাকে সাহায্য করুন, আমাকে সাহায্য করুন বলে চিৎকার করলেও আমি তার জন্য কিছুই করতে পারিনি। আমি জানতে চাই এই নারী এখনো জীবিত আছেন কিনা। এরপর আমি কাঁদতে কাঁদতে প্রায় দেড় ঘণ্টার পথ হেঁটেছি। আমি জানি না আমার কি করা উচিত।’
ভাউল বলেন, ‘তিনি হামলাকারীদেরকে ঠেকানোর জন্য চেয়ার, গ্লাস ও বোতল ছুড়ে মেরেছিলেন। তারপরও তারা আমার দিকে আসার চেষ্টা করে...তারা সবাইকে ছুরিকাঘাত করে। শয়তান, শয়তান মানুষ। ঘটনাস্থলে সশস্ত্র পুলিশের পৌঁছাতে প্রায় ১০ মিনিট সময় লেগে যায়।’
‘তারা শুরুতেই লোকজনকে কিল-ঘুষি, লাথি মারতে থাকে। পরে ছুরি দিয়ে আঘাত করে। এটা ছিল নৃশংস তাণ্ডব’- অপর এক প্রত্যক্ষদর্শী বিবিসিকে বলেন। হামলাকারীরা সাউথওয়ার্ক ক্যাথেড্রালের দিকে এগিয়ে যায়। এসময় এক নারী হামলাকারীদের দিকে তাকায়; তারা তাকেও ছুরিকাঘাত করে।
সূত্র : দ্য গার্ডিয়ান, বিবিসি, স্কাই নিউজ।
এসআইএস/পিআর