গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বর্বরতা
নুর আয়েশা। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গা মুসলিম নারী। দেশটির সেনাবাহিনীর বর্বর নির্যাতনে সাত সন্তানকে হারিয়েছেন তিনি। একমাত্র বেঁচে থাকা ছোট্ট মেয়েকে শক্ত হাতে ধরে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে ডিঙ্গি নৌকায় চেপে বসেছেন।
৪০ বছর বয়সী এই রোহিঙ্গা নারী ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বর্বর হত্যাযজ্ঞের চিত্র তুলে ধরেছেন। নুর আয়েশা বলেন, অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে তাদের গ্রামে শত শত সেনা হামলা চালায়। এ সময় ২০ জনের একটি দল তাদের বাড়িতে আসে। সরকারি এই সেনারা আমাদের সবাইকে উঠানে আসার নির্দেশ দেয়।
‘আমার পাঁচ সন্তানকে আলাদা করে এবং তাদেরকে একটি কক্ষে যেতে বাধ্য করে। এরপর তারা ওই কক্ষে একটি বোমা নিক্ষেপ করে এবং আগুন ধরিয়ে দেয়।’
তিনি বলেন, ‘সেনারা আমার পাঁচ সন্তানকে পুড়িয়ে মেরেছে। আমার দুই মেয়েকে ধর্ষণের পর হত্যা করেছে ওরা। আমার স্বামীকেও হত্যা এবং আমাকে ধর্ষণ করে।’
তিনি বলেন, এখন তার একমাত্র সন্তান ৫ বছর বয়সী দিলনওয়াজ বেগম বেঁচে আছে; রাখাইনের মংডুর কিয়েত ইয়ো পিন গ্রামে যখন সেনারা আসে তখন সে পাশের বাড়ি লুকিয়ে ছিল।
মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে দেশটির সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও যৌন নিপীড়নের যে অভিযোগ উঠেছে; অায়েশার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা সেই অভিযোগেরই চিত্র। মিয়ানমার সরকার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। জাতিসংঘ বলছে, রাখাইনে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের ঘটনা জাতিগত রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ব্যাপক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সহিংসতার অংশ।
গত ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের রাখাইন সীমান্তে নিরাপত্তা বাহিনীর পোস্টে বিদ্রোহীদের হামলায় ৯ পুলিশ সদস্য নিহত হয়। এরপর কিয়েত ইয়ো পিন গ্রামে হামলা চালায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী। নিরাপত্তা বাহিনীর পোস্টে হামলায় রোহিঙ্গারা জড়িত বলে দাবি করেছে দেশটির সরকার।
নিরাপত্তা বাহিনী বলছে, তারা বিদ্রোহী দমনে অভিযান চালাচ্ছে। এদিকে সেনাবাহিনীর অভিযানের মুখে গত মাসে বাংলাদেশে অন্তত ১৫ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে এসেছে। এদের অধিকাংশের ঠাঁই হয়েছে উপকূলীয় জেলা কক্সবাজারের আশ্রয় শিবিরে। আশ্রয় শিবিরের তিন রোহিঙ্গা নারীর সাক্ষাৎকার নিয়েছে গার্ডিয়ান; আয়েশা তাদেরই একজন।
সায়েদা খাতুন। পাঁচ মাসের গর্ভবতী। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বর্বরতার হাত থেকে রেহাই পাননি তিনিও। ১১ অক্টোবর সকালে কিয়েত ইয়ো পিন গ্রামে আসে সেনাবাহিনীর সদস্যরা। বন্দুকের নলের মুখে তারা আরো ৩০ রোহিঙ্গা নারীর সঙ্গে তাকে একটি লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখে।
‘আমাদের মধ্যে থেকে দেখতে সুন্দর ১৫ জন তরুণীকে আলাদা করে সেনা সদস্যরা। পরে তাদের অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। আমি বয়স্ক ১৫ নারীর দলে ছিলাম; যাদের প্রত্যেকেই বাড়ির উঠানে ধর্ষিত হয়েছেন। মৃত্যুর ভয়ে সেনাবাহিনীর নির্দেশে সবাই উলঙ্গ হয়।’
পরিবারের কোনো সদস্যকে হারাতে হয়নি। স্বামী অলি মোহাম্মদসহ পালিয়ে এসেছেন কক্সবাজারে; নিজেকে সৌভাগ্যবতী ভাবছেন সায়েদা। কিন্তু রাখাইনের সহিংসতায় ঘর ভেঙেছে সায়েদার; অলির ধারণা, যারা তার স্ত্রীকে ধর্ষণ করেছেন তারাও আংশিকভাবে স্ত্রীর গর্ভের সন্তানের বাবা।
সায়েদা গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘ওই শিশুটি বৈধ নয় এবং তাকে গর্ভপাত করানো উচিত। আমি শুরু থেকেই তার এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে এসেছি। বাংলাদেশের কিছু মানুষ আমার স্বামীকে বুঝিয়েছেন যে, একমাত্র তিনিই আমার সন্তানের প্রকৃত বাবা। কিন্তু অলির বিশ্বাস, তার এই সন্তানের বাবা তিনিসহ অনেকেই... এবং তিনি আমার কাছ থেকে দূরে রয়েছেন।’
সায়েদার পাশের গ্রামের বাসিন্দা নুর হোসাইন টেলিফোনে গার্ডিয়ানকে বলেন, ১১ অক্টোবরের পরের দুদিনে অন্তত ৮৫০টি বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এছাড়া ২৬৫ রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন তিনি।
হোসাইন বলেন, কারিপ্রাং গ্রামে হামলা চালিয়ে কমপক্ষে ১০০ নারীকে ধর্ষণ ও ২৫ জনকে হত্যা করেছে তারা। ওই গ্রামে ৪০ রোহিঙ্গা নারীকে গুলি ও পুড়িয়ে হত্যা করেছে। এছাড়া গ্রামের অন্তত ১৫০ জন রোহিঙ্গা পুরুষকে ধরে নিয়ে গেছে সেনা সদস্যরা; যারা এখনো নিখোঁজ।
সম্প্রতি জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইন সফর করেছেন। রাখাইনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিবেদন নিয়ে তার নেতৃত্বাধীন কমিটির উদ্বেগের কথা জানান কফি আনান। ইয়াঙ্গুনে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে নিরাপত্তা বাহিনীকে আইন মেনে কাজ করার আহ্বান জানান।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক রোহিঙ্গা সংগঠনের নেতা নুরুল ইসলাম বলেছেন, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিবের সঙ্গে রাখাইনে সাক্ষাতের অভিযোগে দুই রোহিঙ্গা মুসলিমকে গ্রেফতার করেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অধ্যাপক পেনি গ্রিন ১২ মাসের অনুসন্ধানের পর বলেছেন, রাখাইনে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালাচ্ছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী।
এসআইএস/আরআইপি