বিপ্লব, বন্ধুত্ব আর আবেগঘন এক চিঠি
১৯২৬ সালের ১৩ আগস্ট কিউবার পূর্বাঞ্চলীয় বিরান জেলায় স্পেনীয় বংশোদ্ভূত এক অভিবাসী পরিবারে জন্মেছিলেন বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো। পুরো নাম ফিদেল আলেজান্দ্রো কাস্ত্রো রুজ হলেও তিনি ফিদেল কাস্ত্রো বা শুধু কাস্ত্রো নামেই পরিচিত।
আইন বিষয়ে স্নাতক শেষ করার পরপরই হাভানায় একজন আইনজীবী হিসেবে পেশা জীবন শুরু করেন ফিদেল। দরিদ্র মক্কেলদের পক্ষে লড়ে অল্প সময়ের মধ্যেই সুনাম ও খ্যাতি অর্জন করেন তিনি। এরপরই সক্রিয় দলীয় রাজনীতিতে যোগ দেন তিনি।
১৯৫৩ সালে মনকাডা ব্যারাকে একটি ব্যর্থ আক্রমণ চালান তিনি এবং তারপর কারারুদ্ধ হলেও পরে ছাড়া পান। এরপর তিনি বাতিস্তা সরকার উৎখাতে সংগঠিত হওয়ার জন্য মেক্সিকো যান। সেখানে আরেক বিপ্লবী চে গুয়েভারার সঙ্গে পরিচয় হয় কাস্ত্রোর।
১৯৫৬ সালের ২৫ নভেম্বর রাউল কাস্ত্রো, ফিদেল কাস্ত্রো এবং চে গুয়েভারা কিউবায় পা রাখেন। মাত্র ৮২ জনকে নিয়ে শুরু করেন গেরিলা যুদ্ধ। শেষ পর্যন্ত কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করে তৎকালীন সরকারকে উৎখাত করেন তারা। যুদ্ধজয় যেন চে আর কাস্ত্রোর সম্পর্ককে আরো মধুর করেছিল। সারা পৃথিবীর বিপ্লবী মানুষদের কাছে বন্ধুত্বের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত চে আর কাস্ত্রো।
কিউবায় নতুন সরকারে কাস্ত্রো হলেন প্রধানমন্ত্রী আর বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিতে হলো চে গুয়েভারাকেও। সময়টা দু’বন্ধুর ভালোই কাটছিল কিন্তু হঠাৎ করেই কোথায় যেন একটা ভাঙনের সুর শোনা গেলো। কিউবা ছাড়লেন চে গুয়েভারা। এ নিয়ে নানা ধরনের বেশ সমালোচনাও হলো। তবে কাস্ত্রোকে লেখা চে’র একটি চিঠি থেকে দু’বন্ধুর সম্পর্কের গভীরতা খুব সহজেই অনুমান করা যায়। সবুজ কালিতে বন্ধুকে চিঠি লিখেছিলেন চে।
চিঠিতে চে লিখেছিলেন, ‘আমার মৃত্যুটা যদি হয় অন্য কোনো দেশে, তা হলেও আমার শেষ চিন্তাটা থাকবে এই মানুষগুলোকে নিয়ে, বিশেষ করে তোমাকে নিয়েই।’
আসলে কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির কোনো সরকারি পদে থাকতে চাননি চে। ফিদেলকে সেই চিঠিতে সবকিছু ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে চে লিখেছিলেন, ‘আজ তোমার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়ের দিনটির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। মনে পড়ে যাচ্ছে অনেক কিছুই। তোমার সঙ্গে প্রথম আলাপে তুমি বললে, এসো, একসঙ্গে লড়াই করি, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। হাত বাড়িয়ে দিলে আমার দিকে। তারপর আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বটা হয়ে উঠলো গাঢ় থেকে গাঢ়তর। কেউ কাউকে ছেড়ে থাকতে পারি না। যেন আত্মার আত্মীয়!
তখন আমাদের কোনো না কোনো কমরেডকে প্রায় প্রতিদিনই প্রাণ দিতে হচ্ছে। মনে আছে একদিন কে একজন যেন এসে বলল, আমাদের দুজনের মধ্যে কাকে বেছে নেয়া হবে বলির জন্য? আমি আগ বাড়িয়ে বলেছিলাম, আমার নামটাই লিখতে। চেয়েছিলাম, তুমি থাকো। এখন আমাদের সেই আবেগটা একটু কমেছে, কারণ আমরা আরও পরিণত হয়েছি। কিন্তু আবার সেই একইরকম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আমি মনে করি, নিজের ভূখণ্ডে কিউবার বিপ্লবে আমার যতটুকু করণীয় ছিল, আমি করেছি। করতে পেরেছি। এখন তোমার কাছ থেকে আমার বিদায় নেয়ার পালা।’
বন্ধুকে ছেড়ে বিশ্ববিপ্লবের প্রয়োজনে অন্য ভূখণ্ডে পাকাপাকিভাবে চলে যাওয়ার মুখে ফিদেলকে লেখা সেই চিঠিতে চে লিখেছিলেন, ‘আনুষ্ঠানিকভাবে যা যা করার আমি তা করেছি। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে আমার সব পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছি, মন্ত্রিত্ব ছেড়েছি, সেনাবাহিনীর কমান্ডার পদে ইস্তফা দিয়েছি এমনকি কিউবার নাগরিকত্বও ছেড়েছি। কোনো আইনই আর আমাকে কিউবায় বেঁধে রাখতে পারবে না। শুধু অদৃশ্য একটা বন্ধন... তোমার সঙ্গে আমাকে বোধহয় চিরদিনের জন্যই বেঁধে দিয়েছে, যা কখনও ভাঙা যায় না। ভাঙা যাবে না। কোনো দলীয় পদ বা সরকারি নিয়োগ দিয়ে যে বন্ধন টিকিয়ে রাখা কোনো দিনই সম্ভব নয়।’
কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করতে করতে বন্ধু ফিদেল কতটা হৃদয়ের গভীরে পৌঁছে গিয়েছিলেন সহযোদ্ধাদের, তার সম্পর্কে শ্রদ্ধাবোধ পৌঁছে গিয়েছিল কতটা গভীরে, তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার মুখে লেখা চিঠিতে সে কথাও স্বীকার করতে কার্পণ্য করেননি চে। ফিদেলের নেতৃত্ব সম্পর্কে তার যে কিছুটা সন্দেহ, সংশয় বা কিছু মানসিক দ্বিধা-দ্বন্দ্বও ছিল, সে কথাও ওই চিঠিতে অকপটেই বন্ধুকে জানিয়েছিলেন চে। লিখেছিলেন, ‘আমার সবচেয়ে বড় ভুলটা ছিল সিয়েরা মায়েস্ত্রার জঙ্গলে গেরিলা যুদ্ধ চালানোর দিনগুলো থেকেই তোমার ওপর আমি তেমন করে ভরসাটা ধরে রাখতে পারিনি। নেতা ও বিপ্লবী হিসেবে তোমার গুণগুলোও বুঝে উঠতে পারিনি। এখানে আমার কিছু জিনিসের অভাব ছিল। বলতে লজ্জা নেই, তবে আমি সব সময়ই তোমাকে অনুসরণ করেছি। আর সেটা করার জন্য গর্ববোধ করেছি। আমি সেই অর্থে তোমার পথেরই পথিক ছিলাম।’
চে আরো লিখেছিলেন, ‘আমাকে এখন অন্য দেশগুলো চাইছে। সেটা আমি কিউবায় থেকেই করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কিউবার রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তুমি তা মানতে চাইলে না! তাই আজ আমার তোমাকে ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে। একমাত্র তুমিই ভালো করে জানো, তাতে আমার যেমন আনন্দ হচ্ছে, তেমনই দুঃখটাও কম হচ্ছে না। আমি অন্য দেশে বিপ্লব সংগঠনে যাচ্ছি বলে আনন্দ হচ্ছে। কিন্তু এই কিউবার মানুষগুলো ছেড়ে যাচ্ছি বলে আমার দুঃখটাও কম হচ্ছে না। তবে নতুন যে যুদ্ধক্ষেত্রে যাচ্ছি, সেখানেও আমি সেই মতাদর্শকেই কাজে লাগাবো, যা আমাকে তুমি শিখিয়েছিলে। আর সেখানেও আমি তোমার কথাই তুলে ধরবো। তুমি আমাকে যা শিখিয়েছো, তার জন্য আমি তোমার কাছে ঋণী। আর সেটা আমি আমার শেষ সময় পর্যন্ত মনে রাখবো। সেগুলো প্রয়োগ করবো কার্যক্ষেত্রে।’
কাস্ত্রোর বয়স ছিল ৪০ আর চের ২৮। বিত্তশালী পরিবারে জন্ম নিয়ে হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন নিয়ে পড়তে পড়তেই কঠিন লড়াকু রাজনৈতিক জীবনে চলে আসেন কাস্ত্রো। অপরদিকে মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান চে পুরোদস্তুর মেধাবী ডাক্তার হয়েও লোভনীয় জীবনের হাতছানিকে উপেক্ষা করে বেছে নিয়েছিলেন গেরিলা জীবন। সামাজিক স্তরে দুজনের পরিবারের অবস্থানটা এক জায়গায় ছিল না। কিন্তু রণক্ষেত্রে বন্ধুত্বে চিড় ধরাতে পারেনি কোনো কিছুই। কাস্ত্রোর মৃত্যুতে আজ তার সঙ্গে সঙ্গে তাই চে গুয়েভারাকেও স্মরণ করছে বিশ্ব।
টিটিএন/এনএইচ/এমএস
আরও পড়ুন
সর্বশেষ - আন্তর্জাতিক
- ১ রাশিয়ার পক্ষে ছিলেন ম্যারকেল, করেছিলেন ন্যাটোতে ইউক্রেনের বিরোধিতাও
- ২ সংক্ষিপ্ত বিশ্ব সংবাদ: ২৫ নভেম্বর ২০২৪
- ৩ তুরস্কে গুলি চালিয়ে ৭ জনকে হত্যার পর হামলাকারীর আত্মহত্যা
- ৪ কলকাতা পুলিশের বিরুদ্ধে হয়রানির অভিযোগ বাংলাদেশি পর্যটকদের
- ৫ যুক্তরাষ্ট্রের সমন জারির পর এবার ভারতের আদালতে আদানির বিরুদ্ধে মামলা