কাস্ত্রোকথা
কিউবার বিপ্লবী নেতা এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রোকে নিয়ে তীব্র মতভেদ রয়েছে। কাস্ত্রোর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিই এ মতভেদের প্রধান কারণ।
প্রায় ১৫ লাখ কিউবান-আমেরিকানের অধিকাংশের কাছে কাস্ত্রো অত্যাচারী এক শাসকের নাম। হাজারো মানুষের মৃত্যুর জন্য তাকে দায়ী করা হয়। বহু পরিবারের মধ্যে বিচ্ছেদ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্যও তাকে দায়ী করা হয়।
তবে কিউবার অধিকাংশ মানুষের কাছেই ফিদেল কাস্ত্রো একেবারে উল্টো এক চরিত্রের নাম। দেশের স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং খেলাধুলার ক্ষেত্রে যে উন্নতি হয়েছে তার জন্য কাস্ত্রোর কাছেই কৃতজ্ঞ তারা।
সারা বিশ্বে ব্যাপক জনপ্রিয় এই নেতার মূল্যায়ন নিয়ে কিউবায় দ্বিমত নেই সেটিও নয়। ১৯৫৯ সালে কিউবার ক্ষমতায় আসেন ফিদেল কাস্ত্রো। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর অর্ধশতাব্দী দেশ শাসন করেছেন তিনি। ২০০৬ সালে ভাইয়ের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে অবসরে যান তিনি।
১৯২৬ সালের ১৩ আগস্ট কিউবার পূর্বাঞ্চলীয় বিরান জেলায় স্পেনীয় বংশোদ্ভূত এক অভিবাসী পরিবারে জন্মেছিলেন এই বিপ্লবী নেতা। পুরো নাম ফিদেল আলেজান্দ্রো কাস্ত্রো রুজ হলেও তিনি ফিদেল কাস্ত্রো বা শুধু কাস্ত্রো নামেই পরবর্তীতে পরিচিত হন।
ফিদেলের বাবার নাম অ্যানজেল ও মায়ের নাম লিনা। লিনা প্রথমে অ্যানজেলের পরিবারে রান্নাবান্নার কাজ করতেন। পরে ফিদেলের জন্মের কয়েক বছর পর অ্যানজেল ও লিনার বিয়ে হয়। এই পরিবারের সদস্যদের রাজনৈতিক দর্শনে ভিন্নতা ছিল। কিউবান সমাজে মেরুকরণের পর তাদের কেউ কেউ অন্য কোথাও চলে যান, কেউ আবার কিউবাতেই থেকে যান।
একটি বেসরকারি বোর্ডিং স্কুল থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করেন ফিদেল কাস্ত্রো। পরে ইউনিভার্সিটি অব হাভানা থেকে আইনের ওপর ডক্টরেট ডিগ্রি নেন কাস্ত্রো। সেখানেই আইনজীবী হিসেবে পেশা জীবন শুরু করেন তিনি।
রাজনীতি ছিল তার কাছে নেশার মতো। ১৯৫২ সালে কিউবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার জন্য প্রার্থী হন তিনি। তবে শেষ পর্যন্ত ওই নির্বাচন আর হয়নি। কারণ ওই নির্বাচনের আগে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ফুলগেনসিও বাতিস্তা একটি সামরিক অভুত্থানে নেতৃত্ব দেন।
এরপর বাতিস্তার পতনের লক্ষে বিপ্লবের ডাক দিয়ে ১৯৫৩ সালের ২৬ জুলাই সান্তিয়াগোর গ্যারিসনে হামলা চালান ফিদেল কাস্ত্রো।
অভুত্থান ব্যর্থ হওয়ার পর গ্রেফতার হন ফিদেল কাস্ত্রো। পরে অবশ্য সাধারণ ক্ষমা পেয়ে মেক্সিকো চলে যান তিনি। সেখানে নতুন করে দল গোছান। পরবর্তীকালে অন্যান্য কিউবান সহযোদ্ধা ও আর্জেন্টিনার চে গুয়েভারাকে নিয়ে দেশে ফেরেন তিনি। ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত সামরিক প্রশিক্ষণের পর এই বিপ্লবীরা ১৯৫৯ সালের ১ জানুয়ারি ক্ষমতায় আসেন।
এরপর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কিউবার সম্পর্কে উত্থান-পতন শুরু। ১৯৬০ সালে দেশটির ওপর অবরোধ আরোপ করে ওয়াশিংটন। এরপর ১৯৬১ সালে দেশটির সঙ্গে সব কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে যুক্তরাষ্ট্র।
তবে ২০১৫ সালে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনস্থাপনের মধ্যে দিয়ে দুিই দেশের সম্পর্ক উন্নয়ন হয়।
দীর্ঘ ৫৫ বছর দুই দেশের সম্পর্কে তীব্র টানাপড়েন চলে। এ সময় কাস্ত্রোকে হত্যার একাধিক ষড়যন্ত্র হয়েছে। হত্যার শিকার হয়েছেন প্রায় ৩ হাজার ৪০০ কিউবান নাগরিক।
ওয়াশিংটন কিউবার সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করার পর সৃষ্ট উত্তেজনার কারণে ও কাস্ত্রোর রাজনৈতিক দর্শনের কারণে কিউবা সোভিয়েন ইউনিয়নের দিকে ঝুঁকে পড়ে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ছাড়াও ইউরোপের অন্যান্য সমাজতন্ত্রী দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে তোলে এই দ্বীপ রাষ্ট্র। এ সময়টাতেই কাস্ত্রো নিজেকে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী বলে ঘোষণা করেন।
কাস্ত্রোকে নিয়ে মতভেদ থাকলেও শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নানা কর্মসূচির কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তিনি ভীষণ জনপ্রিয় এক নেতা।
বিশ্বের প্রায় ৬০টি উন্নয়নশীল দেশে কিউবার ৫০ হাজারেরও বেশি স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োজিত। নেলসন ম্যান্ডেলা থেকে বান কি মুন সবাই কিউবার এ বিষয়টির প্রশংসা করেছেন।
যে ফিদেল কাস্ত্রোর নেতৃত্বে কিউবা বিশ্ব দরবারে এই পরিচয় পেয়েছে স্থানীয় সময় শুক্রবার রাতে সেই নেতা পাড়ি জমিয়েছেন পরপারে। আজন্ম যারা সাম্যবাদের স্বপ্ন বুনেছেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি অনন্য ছিলেন তাদের জন্য। মৃত্যুর পরও সাম্যবাদের স্বপ্নে অমর থাকবেন এই নেতা।
আল-জাজিরায় প্রকাশিত দ্য ভিভিড লাইভ অব ফিদের কাস্ত্রো অবলম্বনে।
এনএফ/এমএস