ভিডিও EN
  1. Home/
  2. আন্তর্জাতিক

রোহিঙ্গা নয় সাগরে ভাসছে মানবতা

সাইফুজ্জামান সুমন | প্রকাশিত: ০১:৩২ পিএম, ২৩ নভেম্বর ২০১৬

বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে মিয়ানমারের পুলিশ চেকপোস্টে গত অক্টোবরের শুরুতে সশস্ত্র দুর্বৃত্তদের হামলার পর রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান শুরু করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। অভিযানে এখন পর্যন্ত শতাধিক রোহিঙ্গা মুসলিমের প্রাণহানি ঘটেছে।

রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে ভূমি উদ্ধারের এই অভিযানে মিয়ানমার সেনাবাহিনী হেলিকপ্টার থেকেও নির্বিচারে গুলি নিক্ষেপ করেছে। সংঘাতপূর্ণ এলাকায় প্রবেশে ব্যাপক কড়াকড়ি আরোপ করা হলেও প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, রোহিঙ্গা মুসলিম নারীরা গণধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। শুধু তাই নয়, নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যার পাশাপাশি মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী রোহিঙ্গা গ্রামগুলো গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। তবে এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে সেনাবাহিনী।

রোহিঙ্গাদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতনের ইতিহাসে এটি একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা মুসলিমকে দেশটিতে অবৈধ অভিবাসী হিসেবে দেখা হয়। এ ছাড়া এসব রোহিঙ্গা মুসলিমকে দেশটির নাগরিকত্বও দেয়া হয়নি।

রোহিঙ্গারা কারা?

রোহিঙ্গারা রাষ্ট্রহীন মুসলিম জাতিগোষ্ঠী বলে উল্লেখ করেছে জাতিসংঘ। সংস্থাটি বলছে, বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘসময় ধরে নির্যাতিত সংখ্যালঘু একটি গোষ্ঠী হচ্ছে এই রোহিঙ্গা। বাংলাদেশের চট্টগ্রামের স্থানীয় ভাষার সঙ্গে রোহিঙ্গাদের ভাষার মিল থাকায় সংখ্যালঘু সুন্নিপন্থী এই গোষ্ঠীকে ঘৃণা করেন মিয়ানমারের বৌদ্ধরা। মিয়ানমারের এই বৌদ্ধরা এসব রোহিঙ্গাকে অবৈধ অভিবাসী মনে করে। এমনকি মিয়ানমারে কয়েক প্রজন্ম ধরে বসবাস করে এলেও তাদের বাঙালি হিসেবে ডাকে স্থানীয়রা।

রোহিঙ্গাদের অধিকাংশই দেশটির পশ্চিমাঞ্চলের দারিদ্র্যপীড়িত রাখাইন রাজ্যে বসবাস করলেও সে দেশের নাগরিকত্ব নেই তাদের। এছাড়া রোহিঙ্গাদের চলাচল ও কাজের ওপরও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর বলছে, ২০১২ সালে দেশটিতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পর রাখাইন প্রদেশ থেকে এক লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম পালিয়েছে। সমুদ্রপথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা পালাচ্ছে; এখনো তা অব্যাহত রয়েছে।

গত বছর থাইল্যান্ডের ভেতর দিয়ে মানবপাচারের বিশেষ রুট বন্ধ করে দেয়া হলে হাজার হাজার রোহিঙ্গা সাগরে আটকা পড়ে। মালয়েশিয়ায় বেশ কয়েকটি গণকবরের সন্ধান পাওয়ার পর ওই রুট বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল।

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জেলা কক্সবাজার সীমান্ত সংলগ্ন মিয়ানমারের রাখাইন প্রাদেশে ৩ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করে। কয়েক দশক ধরে অব্যাহত নির্যাতনের মুখে রোহিঙ্গাদের একটি বড় অংশ দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে।

এদিকে বাংলাদেশ এসব রোহিঙ্গাদের ক্ষুদ্র একটি অংশকে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় দিয়েছে। তবে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টাকারী রোহিঙ্গাদের পুশ ব্যাক করছে মিয়ানমারের দিকে।

কী ঘটছে মিয়ানমারে?

৯ অক্টোবর সশস্ত্র একদল দুর্বৃত্ত সীমান্ত এলাকার একাধিক পুলিশ চেক পোস্টে হামলা চালিয়ে ৯ জনকে হত্যার পর অস্ত্র নিয়ে পালিয়ে যায়। মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় দৈনিক গ্লোবাল নিউ লাইট বলছে, মুসে ও কুটকাই শহরের সেনা চৌকি, পুলিশ স্টেশন ও একটি ব্যবসা কেন্দ্রে ওই হামলায় ৮ জন নিহত হয়। নিহতদের মধ্যে এক সেনা, তিন পুলিশ, স্থানীয় এক নিরাপত্তা কর্মী ও তিন বেসামরিক নাগরিক ছিল।

পরে হামলার প্রতিশোধ নিতে ওই এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনী পাঠানো হয়। বার্তাসংস্থা রয়টার্স এক প্রতিবেদনে বলছে, রাখাইন প্রদেশে সাম্প্রতিক সেনা অভিযানে অন্তত ১৩০ রোহিঙ্গার প্রাণহানি ঘটেছে। সেনাবাহিনী প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামগুলো খালি করায় এ সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে।

পুলিশ চেকপোস্টে হামলার ঘটনাকে দেশটির সরকার রোহিঙ্গা বিদ্রোহ বলে দাবি করেছে। মিয়ানমার সরকার বলছে, পাকিস্তানি জঙ্গিগোষ্ঠী তালেবানের প্ররোচনায় প্রশিক্ষিত বিদ্রোহীরা ওই হামলা চালিয়েছে। তবে সরকারের এই দাবির সত্যতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত কঠিন। এদিকে, সশস্ত্র হামলাকারীদের একটি ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়ে পড়েছে। নিরাপত্তা অভিযান এখনো অব্যাহত রয়েছে।

রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বৃদ্ধি পাওয়ায় আবারো আলোচনায় এসেছে তাদের নাগরিকত্বের বিষয়টি। মিয়ানমারের একাধিক মানবাধিকার গোষ্ঠী রোহিঙ্গা মুসলিমদেরকে সেদেশের নাগরিকত্ব দেয়ার দাবি জানিয়েছে। একই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধেরও আহ্বান জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো।

কী করছেন সু চি?

রাখাইন প্রদেশের সাম্প্রতিক সহিংসতা নিয়ে দেশটির গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) প্রধান অং সান সু চির নীরবতা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী এই নেত্রী গতমাসে জাপান সফরের সময় রাখাইনে সহিংসতার ঘটনায় তদন্তের আহ্বান জানান। তিনি দেশটির সব নিরাপত্তা বিষয় দেখাশোনা করলেও রাখাইনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। এ ছাড়া মিয়ানমারের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যের কারণেও তিনি এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হচ্ছেন বলে জানান।

এদিকে, কক্সবাজারে অস্থায়ী শিবিরের বাসিন্দা ও বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলছেন, অক্টোবরের ওই হামলার পর এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৫০০ রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। বর্তমানে এই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ সীমান্তের অস্থায়ী ক্যাম্পে অবস্থান করছেন। এ ছাড়া মঙ্গলবার রোহিঙ্গাদের বিশাল একটি বহরকে বাংলাদেশে প্রবেশে বাধা দিয়েছে সীমান্তরক্ষী বাহিনী। সকালের দিকে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে ৪০ নারী ও ২৫ শিশুসহ ৮৬ রোহিঙ্গাকে পুশব্যাক করেছে বিজিবি। বার্তাসংস্থা রয়টার্স বলছে, সহিংসতার আশঙ্কায় এসব রোহিঙ্গা গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন না। তারা এখনো সমুদ্রে থাকতে পারেন।

মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর দীর্ঘদিনের নির্যাতনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোও। জীবন বাঁচাতে অথৈ সাগরে ছোট নৌকায় চেপে বসা রোহিঙ্গারা ভেসে বেড়াচ্ছেন। বাংলাদেশের দিকে এসে পৌঁছালেও ফেরত পাঠানো হচ্ছে মিয়ানমারের দিকে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বেশ কিছু রোহিঙ্গা মুসলিমকে অস্থায়ী শিবিরে আশ্রয় দিয়েছে। মানবিকতার জায়গা থেকে হলেও এই ভাসমান রাষ্ট্রহীন রোহিঙ্গাদের গ্রহণে অন্যান্য দেশকেও এগিয়ে আসা উচিত।

এসআইএস/আরআইপি

আরও পড়ুন