যে কারণে বিনামূল্যে মুরগি বিতরণ করে ইউরোপের কিছু শহর

ফ্রান্স এবং বেলজিয়ামের শহরগুলো বছরের পর বছর ধরে মুরগি বিতরণ করে চলেছে। তাদের প্রধান উদ্দেশ্য হলো, শহরের বাসিন্দাদের যে খাদ্য বর্জ্য তৈরি হয়, সেগুলোর সুরাহা করা। এরপর আশ্চর্যজনক ফলাফল পাওয়া গেছে।
ফ্রান্সের কোলমারে এই উদ্যোগের সূচনা হয়েছিল ২০১৫ সালে। শহরের খাদ্য বর্জ্যের পরিমাণ কমানোর জন্য সেখানকার বর্জ্য সংগ্রহকারী বিভাগ পরীক্ষামূলকভাবে চালু করেছিল এই উদ্যোগ। তারপর থেকেই সেখানে এই প্রকল্প চলে আসছে।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
কোলমার অ্যাগ্লোমেরেশন (মেয়রের অনুরূপ ভূমিকা)-এর প্রেসিডেন্ট গিলবার্ট মেয়ার ২০১৪ সালে পুনর্নির্বাচিত হয়েছিলেন যে স্লোগানের হাত ধরে সেটি ছিল- ‘একটা পরিবার, একটা মুরগি।’
আরও পড়ুন>>
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
স্লোগানের লক্ষ্য ছিল, স্থানীয় বাসিন্দাদের একটা করে মুরগি দত্তক নিতে উৎসাহিত করা। পরের বছর ওই প্রকল্প বাস্তবায়নও করা হয়। এই উদ্যোগে অংশীদার করা হয় নিকটবর্তী মুরগির খামারগুলোকে।
জনসাধারণকে এটি ভাবতে উৎসাহিত করা হয়েছিল, মুরগি পালন করতে তাদের যে পরিশ্রম করতে হবে, তার ফলও তারা দ্রুত পেতে চলেছেন। কারণ বিনামূল্যে ডিম পাবেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
বিজ্ঞাপন
প্রাথমিকভাবে সেখানকার চারটে পৌরসভার অন্তর্গত ২০০টিরও বেশি বাড়ি এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়। তাদের প্রত্যেককে দুটো করে মুরগি দেওয়া হয়েছিল।
অংশগ্রহণকারী প্রতিটা পরিবার মুরগি পালনের অঙ্গীকার জানিয়ে স্বাক্ষরও করে। সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মীরা যেকোনো সময় বাড়িতে উপস্থিত হয়ে খতিয়ে দেখতে পারেন মুরগিগুলোকে কী অবস্থায় রাখা হচ্ছে- সেটা ভালোভাবেই জানতেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
তবে মুরগিগুলোর জন্য কোনো ‘হেনহাউজ’ সরবরাহ করা হয়নি। বরং বাসিন্দাদের ওপরই এই সিদ্ধান্তটা ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল যে তারা নিজেরাই মুরগির জন্য থাকার জায়গা তৈরি করবেন নাকি বাজার থেকে হেনহাউজ কিনে আনবেন।
বিজ্ঞাপন
প্রকল্প পরিচালনাকারী বিভাগ এই বিষয়টা নিশ্চিত করেছিল যে, প্রত্যেকটা বাড়িতে মুরগির জন্য পর্যাপ্ত জায়গা রয়েছে। এক্ষেত্রে তাদের মানদণ্ড ছিল আনুমানিক আট থেকে দশ বর্গ মিটার জায়গা, যা মুরগি পালনের জন্য যথেষ্ট।
কোলমারে এই প্রকল্প বেশ সাফল্য পায় এবং এখনো তা চলছে।
কোলমার অ্যাগ্লোমেরেশনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট এরিক স্ট্রুমান বলেছেন, গত কয়েক বছরে অন্যান্য পৌরসভাও এই প্রকল্পে যোগ দিয়েছে। ২০২২ সাল থেকে অ্যাগ্লোমেরেশনের ২০টি পৌরসভাই এই প্রকল্পের অংশ।
বিজ্ঞাপন
এখন পর্যন্ত স্থানীয় বাসিন্দাদের ৫ হাজার ২৮২টি মুরগি বিতরণ করা হয়েছে। চলতি বছরের জুন মাসেও মুরগি বিতরণ করা হবে এবং তার জন্য আবেদন জমা নেওয়া হচ্ছে।
বর্জ্য মোকাবিলায় সাফল্য
এই প্রকল্পের হাত ধরে স্থানীয় বাসিন্দারা যে শুধু পরিমাণে ডিম পেয়েছেন এমনটাই নয়, খাদ্য বর্জ্য মোকাবিলাও করতে সক্ষম হয়েছেন।
পালন করা মুরগিগুলোকে খাওয়ানোর জন্য তারা কিচেন ওয়েস্ট ব্যবহার করেছেন। এই বর্জ্য তাদের কোথাও না কোথাও ফেলতে হতো, তার পরিবর্তে সেগুলো মুরগিদের খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
স্ট্রুমান ব্যাখ্যা করেন, যেহেতু একটি মুরগির গড় আয়ু চার বছর এবং প্রতিদিন তারা ১৫০ গ্রাম জৈব বর্জ্য গ্রহণ করে, তাই হিসাব করে দেখা গেছে (২০১৫ সাল থেকে) ২৭৩ দশমিক ৩৫ টন জৈব-বর্জ্য আমরা এড়াতে পেরেছি।
প্রসঙ্গত, অন্যান্য বর্জ্য পদার্থের চাইতে খাদ্য বর্জ্য বায়ুমণ্ডলে আরও বেশি পরিমাণে মিথেন নির্গমন করে। যুক্তরাষ্ট্রের হিসাবে, বর্জ্য পদার্থ থেকে বায়ুমণ্ডলে যে পরিমাণ মিথেন নির্গত হয় তার প্রায় ৫৮ শতাংশই আসে খাদ্য বর্জ্য থেকে। কার্বন ডাই অক্সাইডের চেয়ে মিথেন বায়ুমণ্ডলে স্বল্পস্থায়ী হলেও বিশ্বের উষ্ণায়নে এর প্রভাব বেশি।
বিশ্বজুড়ে মানুষের জন্য উৎপাদিত খাদ্যের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অপচয় বা নষ্ট হয়, যার মোট পরিমাণ প্রতি বছর ১৩০ কোটি টন।
বিজ্ঞাপন
স্ট্রুমান বলেন, খাদ্য বর্জ্য কমানোর লক্ষ্যে প্রস্তাবিত এই উদ্যোগের মাধ্যমে একটা ট্র্যাডিশনাল সার্কুলার ইকোনমির (ঐতিহ্যবাহী বৃত্তাকার অর্থনীতি) প্রচার করা সম্ভব যা আজও প্রাসঙ্গিক, বিশেষত গ্রামের ক্ষেত্রে। তবে খাদ্য বর্জ্য মুরগিগুলোকে খাওয়ানো এবং তার বিনিময়ে তাজা ডিম পাওয়ার এই চল এখন শহরাঞ্চলেও দেখা যাচ্ছে।
এই প্রকল্পের একটা বিশেষ দিকের কথাও উল্লেখ করেছেন তিনি। স্ট্রুমান জানান, এর একটি অতিরিক্ত সুবিধা হলো মুরগি পালন থেকে কোলমারের শিশুরা কিন্তু প্রাণী এবং প্রকৃতির সম্ভারকে রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে অনেক কিছু শিখতে পেরেছে।
জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে মুরগি বিতরণ প্রকল্প
কোলমার একমাত্র শহর নয় যেখানে বিনামূল্যে মুরগি বিতরণের এই উদ্যোগ চালু করা হয়েছে। আবার, কোলমারেই যে এই প্রকল্প প্রথম শুরু হয়েছিল, তা-ও নয়।
২০১২ সালে উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত আরেকটা ছোট্ট ফরাসি শহর, পানসিতে জৈব বর্জ্য কমানোর জন্য এই জাতীয় একটা উদ্যোগ শুরু হয়। সেখানকার প্রতিটা পরিবারকে দুটি করে মুরগি দেওয়া হয়েছিল।
সেই সময় পানসির মেয়র লিডি পাস্টিউ সেখানকার স্থানীয় গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, শুরুতে এটা মজার বিষয় ছিল, কিন্তু পরে আমরা বুঝতে পারি যে এই ভাবনাটা বেশ ভালো।
মোট ৩১টি পরিবারকে মুরগি এবং এক ব্যাগ ফিড (মুরগির খাবার) দেওয়া হয়েছিল। এই উদ্যোগের সাফল্য ‘বিস্ময়কর’ ছিল বলে জানিয়েছিলেন মেয়র লিডি পাস্টিউ।
বেলজিয়ামের মুস্ক্রন, অ্যান্টওয়ার্প শহর এবং লিম্বাগ প্রদেশেও মুরগি বিতরণ করা হয়েছিল। সেখানকার বাসিন্দাদের অবশ্য কমপক্ষে দুই বছর মুরগি না খাওয়ার জন্য একটা চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে হয়েছিল।
বার্ড ফ্লুর আতঙ্ক
তত্ত্বগত দিক থেকে এই উদ্যোগ বেশ ভালো বলে মনে করা হচ্ছে, বিশেষত বিশ্বের এমন কিছু অংশে যেখানে ডিমের ঘাটতি রয়েছে বা ডিম ব্যয়বহুল।
উদাহরণ স্বরূপ- ক্যালিফোর্নিয়া বা নিউইয়র্কে এক ডজন ডিমের দাম প্রায় নয় ডলার। কিছু কিছু প্রজাতির মুরগি প্রতি বছর ৩০০টা পর্যন্ত ডিম দিতে পারে। তাই হিসাব করলে দেখা যাবে, একটি মুরগি প্রতি বছর ২২৫ ডলার পর্যন্ত দামের ডিম দিতে পারে।
যদিও খাদ্য ব্যবস্থার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বাস্তব ক্ষেত্রে কিছু বাধা রয়েছে বলে মনে করেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পল বেহরেন্স।
তার কথায়, যুক্তরাজ্যে এটা চালু করা যেতে পারে বলে আমি নিশ্চিত হলেও এই বিষয়ে নিশ্চিত নই যে এই ভাবনাটা ভাল কি না। তিনি বলেন, বার্ড ফ্লু এখন নিত্যদিনের উদ্বেগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান নিয়মে আপনাকে বেড়া দেওয়া অংশে বা বাড়ির ভিতরে পাখি রাখতে হবে। সেটা প্রাণী কল্যাণের দিক থেকে একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে। আবার যদি এমনটা না করা হয়, তাহলে রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে।
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সাসটেইনেবল ফুড প্রোগ্রাম’ বা টেকসই খাদ্য কর্মসূচির পরিচালক মার্ক বোমফোর্ড বলেন, যুক্তরাষ্ট্রেও এই ভাবনা ভালো কাজ করবে না।
যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে বার্ড ফ্লুর কারণে ডিমের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এর ফলে ডিমের দাম ২০২৩ সালের তুলনায় ৩৬ শতাংশ বেড়েছে। তবে এটি মোকাবিলার জন্য বিনামূল্যে মুরগি বিতরণের এই প্রকল্প 'উপযুক্ত' মাধ্যম হবে না বলেই মনে করেন বোমফোর্ড।
তার যুক্তি, অর্থনৈতিক দিক থেকে ডিমের মতো একটা মৌলিক পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ধনীদের চেয়ে দরিদ্ররা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মুরগির যত্ন নেওয়ার জন্য খাদ্য, জল, আবাসন, স্থান এবং অবসর সময় প্রয়োজন।
‘নিম্ন আয়ের বেশিরভাগ মানুষের কাছেই এগুলো নেই। এসব বিষয় হিসাবের আওতায় আনলে এবং এর জন্য খরচ ধরলে, মুরগিকে আর বিনামূল্যে বলা যাবে না। এই পরিস্থিতিতে খুব কম মানুষের কাছে ডিমের জন্য মোট ব্যয়ের সাশ্রয়টা উপলব্ধি করতে পারবেন।’
অপ্রত্যাশিত উপকার
এই উদ্যোগের এমন একটা উপকার কোলমারে লক্ষ্য করা গিয়েছিল যা কেউ প্রত্যাশাও করেনি। না, মুরগি পালনের পরিবর্তে ডিমের যোগান বা খাদ্য বর্জ্য মোকাবিলার সঙ্গেও এর কোনওরকম সম্পর্ক ছিল না।
এই প্রকল্পের মাধ্যমে যে বিষয়টা লক্ষ্য করা গিয়েছিল তাহল, মুরগি পালনকে কেন্দ্র করে স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে যে একাত্মতা।
স্থানীয় মানুষরা মুরগি পালনের বিষয়ে একে অপরকে সাহায্য করতেন। কোনও পরিবার ছুটি কাটাতে অন্যত্র গেলে, তাদের পালিত মুরগির যত্ন নেন প্রতিবেশীরা।
স্ট্রুমানের কথায়, এই উদ্যোগ শুরু হওয়ার সময় থেকেই এখানকার বাসিন্দারা একে স্বাগত জানিয়েছেন। ঠিক সেই কারণেই কোলমারের গোটা পৌরসভা এখনো এই উদ্যোগে শামিল হয়।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
কেএএ/
বিজ্ঞাপন