পুরুষরাও এখন আয়রন ঘাটতিতে ভুগছে
সুস্থ ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের জন্য সঠিক পুষ্টি গ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিনের খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপনের ধরন কেবল আমাদের শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপরই নয়, মানসিক অবস্থার ওপরও গভীর প্রভাব ফেলে।
এ বিষয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে বিশদ আলোচনা করেন থাইরোকেয়ার বাংলাদেশের ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশনিস্ট মুহাম্মাদ আরিফুল ইসলাম সজল। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল্লাহ আল মিরাজ।
জাগো নিউজ: বাংলাদেশের মানুষের অপুষ্টির কারণ কী কী?
মুহাম্মদ সজল: একটা সময় বাংলাদেশে খাদ্যের অভাব ছিল। ক্যালোরি ঘাটতি ছিল প্রকট। আমরা দিনে ১৭০২ ক্যালরি নিশ্চিত করতে পারতাম না নাগরিকদের জন্য। পরবর্তীসময়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়ে রাষ্ট্রের সক্ষমতা বাড়লো। কিন্তু এই উন্নয়নে দেশের অধিকাংশ মানুষ যুক্ত হতে পারেনি। ফলে ক্যালোরি গ্রহণও সবার একসঙ্গে বাড়েনি।
আয়রনের অভাব সরাসরি স্মৃতিশক্তির ওপর প্রভাব ফেলে। পুরুষরাও এখন আয়রন ঘাটতিতে ভুগছে। এখানে দুটি কারণ। প্রচুর ধূমপান ও অপরিমিত আকারে চা-কফি খাওয়া। এই দুটি হলো আয়রন ব্লকার। সিগারেট ও চা-কফির কারণে রক্তশূন্যতা বাড়ছে।
অনেকে এখনো বেসিক ক্যালোরি রিকয়ারমেন্ট ফুলফিল করতে পারে না। মানুষের পুষ্টি শুধু ক্যালোরি নয়, কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট, প্রোটিনও লাগে। ১৯৭০ সালের দিকে দেশের প্রধান অপুষ্টির ভেতরে ছিল আয়রন, ভিটামিন এ, আয়োডিন ও এনার্জি ঘাটতি। ৫৩ বছর পর আমরা ভিটামিনের ঘাটতি অনেকটা দূর করেছি। কিন্তু বাকিগুলোর ঘাটতি থেকেই গেছে।
খাবার লবণে আয়োডিন যুক্ত করে আয়োডিন ঘাটতি অনেকটা দূর করেছি, কিন্তু এই ঘাটতি পুরোপুরি দূর হয়নি। গলগণ্ড, বুদ্ধির স্বল্পতা, মানসিক বিকাশ, বন্ধ্যাত্ব সমস্যার সঙ্গে আয়োডিনের অভাব জড়িত। পাশাপাশি ভিটামিন ডি-এর অভাব। এ দুটি অপুষ্টির অন্যতম কারণ।
জাগো নিউজ: আয়রনের অভাবে কী সমস্যা হয়? ভিটামিন ডি-এর অভাব কি এখনো খুব বেশি?
- আরও পড়ুন
- স্বাস্থ্য-পুষ্টি উন্নয়নে আসছে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কর্মসূচি
- গুঁড়া দুধ নাকি তরল, কোনটিতে বেশি পুষ্টি?
- ‘রোগ প্রতিরোধে শুধু ওষুধ নয়, পুষ্টির ওপর জোর দিতে হবে’
মুহাম্মদ সজল: আয়রনের ঘাটতির কারণে নারীদের মধ্যে রক্তস্বল্পতাজনিত শারীরিক দুর্বলতা দেখা দেয়। আয়রনের অভাব সরাসরি স্মৃতিশক্তির ওপর প্রভাব ফেলে। পুরুষেরও এখন আয়রন ঘাটতি রয়েছে। এখানে দুটি কারণ। প্রচুর ধূমপান ও অপরিমিত আকারে চা-কফি খাওয়া। এই দুটি হলো আয়রন ব্লকার। সিগারেট ও চা-কফির কারণে রক্তশূন্যতা বাড়ছে।
আমাদের প্লেটে কী কী খাবার থাকা উচিত মানুষ জানে না। ৫০ শতাংশের বেশি কার্বোহাইড্রেট থাকা দরকার নেই, যদি না বেশি হার্ডওয়ার্ক করে। অনেক মানুষ আছে যারা ৮০ শতাংশ কার্বোহাইড্রেট নেয়, কিন্তু পরিশ্রমের সময় নেই।
অন্যদিকে অপুষ্টির নতুন ধরন হলো ভিটামিন ডি-এর ঘাটতি। এটা নিয়ে সারা পৃথিবীর পুষ্টিবিদরা চিন্তিত। বাচ্চারাও এ ঘাটতিতে ভুগছে। গবেষণায় দেখা যায়, কোভিডের পর থেকে বাংলাদেশে স্কুলগামী শিশুদের মধ্যে ঢাকা মেট্রোপলিটনের মধ্যে ঘাটতি ৪৫ শতাংশ। কোনো কোনো গবেষণায় দেখা গেছে, ৯০ শতাংশ পর্যন্ত ভিটামিন ডি-এর অভাবে ভুগছে। এই অভাব কোভিডের আগে থেকে থাকলেও কোভিডের পর থেকে বেশি হচ্ছে।
জাগো নিউজ: বাংলাদেশের পুষ্টি ঘাটতি কমানোর উপায় কী?
মুহাম্মদ সজল: ২০১৫ সালে বাংলাদেশে একটা পুষ্টিনীতি হয়। এই নীতিতে খাদ্যের প্রয়োজনীয়তার পাশাপাশি পুষ্টির প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়। কিন্তু এটি বলা পর্যন্তই শেষ। দেশের প্রতিটি উপজেলায় পুষ্টিবিদ কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়ার কথা ছিল। এটা আর হয়নি। পুষ্টি ঠিক করতে হলে আমাদের কৃষিতে হাত দিতে হবে। মাছের উৎপাদন বাড়াতে হবে। প্রচুর পরিমাণ ডিম ও পোল্ট্রি উৎপাদন হচ্ছে, কিন্তু দাম তো কমছে না। ডিমের কুসুম কমলা কালার থেকে এখন হলুদ হয়ে গেছে। তাই পরিমাণ বাড়ালেই হবে না, প্রোটিনের মানসম্পন্ন উৎপাদন করতে হবে। নতুবা আমাদের খাদ্যের অভাব মিটবে কিন্তু পুষ্টির অভাব থেকে যাবে।
সুতারাং, আমাদের কৃষিনীতি হতে হবে পুষ্টিবান্ধব। পুষ্টির জন্য এটা সবচেয়ে কার্যকরী উপায়। আমাদের দেশে যে পরিমাণ সবজি উৎপাদন হয় তার ২৫ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়, সঠিকভাবে সংরক্ষণ কিংবা গুদামজাত করার অভাবে।
জাগো নিউজ: সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাসে ভুলগুলো কী কী?
মুহাম্মদ সজল: খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তনেই সুস্থ জীবনযাপন সম্ভব। কিন্তু আমাদের দেশে খাদ্যাভ্যাস গুরুত্বহীন। আমাদের দেশের মানুষ খাবারের ধরনের চেয়ে বেশি ভুল করে অসময়ে খাবার গ্রহণ করে। এটা খুবই আন-হেলদি প্রসেস। আমাদের প্লেটে কী কী খাবার থাকা উচিত মানুষ জানে না। ৫০ শতাংশের বেশি কার্বোহাইড্রেট থাকা দরকার নেই, যদি না বেশি হার্ডওয়ার্ক করে। অনেক মানুষ আছে যারা ৮০ শতাংশ কার্বোহাইড্রেট নেয়, কিন্তু পরিশ্রমের সময় নেই।
এখন একটা জিনিস হচ্ছে সস্তায় যত বেশি খাবার পাওয়া যায়, বাচ্চারা তত বেশি খাচ্ছে। সয়াবিন নিয়েও সমস্যা রয়েছে আমাদের। সয়াবিন থেকে সরিষামুখী হতে হবে। মানুষ সব সময় চকচকে খাবার কিনতে চায়। এই প্রবণতাটা খারাপ। বেশি কীটনাশক, বেশি সার, অতিরিক্ত প্রিজারভেটিভের কারণে খাদ্যে অতিমাত্রায় ভেজাল রয়েছে। মানুষ ফুড চয়েসের ক্ষেত্রে এখন ভাজাপোড়া খায়। খাবারের জন্য রেস্টুরেন্টে, স্ট্রিট ফুডে টাকা খরচ করে কিন্তু হাউজহোল্ড ফুড সিলেকশনের ক্ষেত্রে বাজারের টাকা বাঁচায়। এটার মাশুল দেয় তারা মেডিসিনে টাকা খরচ করে।
জাগো নিউজ: আপনি বললেন মানুষ অতিমাত্রায় ফাস্টফুডে আসক্ত, এটা স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। বিকল্প কী?
মুহাম্মদ সজল: ফাস্টফুড পৃথিবীতে এসেছে স্মার্টনেস হিসেবে। এগুলো সব পশ্চিমা থেকে আসছে। ফাস্টফুডের বিপরীতে হেলদি ফুড প্রমোট করতে হবে। দেশে যে পরিমাণ ফাস্টফুডের দোকান আছে, সে তুলনায় হেলদি ফুডের দোকান নেই বললেই চলে। মানুষ যখন কয়েকজন মিলে আউটিং করে, তখন এগুলো খেতে খেতে অভ্যস্ত হয়। অধিকাংশের মধ্যে এসব ফুডের ক্ষতির পরিমাণ সম্পর্কে ধারণা নেই।
এটার বিপরীতে সবচেয়ে বড় উপায় হলো রেস্টুরেন্টে স্বাস্থ্যকর খাবারের ব্যবস্থা করা। স্কুল-কলেজ লেভেল থেকে হেলদি ফুডের প্র্যাকটিস শুরু করা। বায়োলজি বইয়ে পুষ্টির চ্যাপ্টার খোলা হয়েছে, কিন্তু এসব বিদ্যার প্রয়োগ নেই কোথাও। শুধু সায়েন্স নয়, কমার্স এবং আর্টসেও পুষ্টির বিষয় যোগ করা জরুরি।
জাগো নিউজ: দেশের অধিকাংশ মানুষের প্রোটিনের ঘাটতি রয়েছে। কারণ কী বলে মনে করছেন?
মুহাম্মদ সজল: মানুষের প্লেটে প্রোটিন খুব কম থাকে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে কেনার সক্ষমতা নেই। আমরা টোটাল যে ফুড রাখি তার মধ্যে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ প্রোটিন রাখা উচিত। কিন্তু সাধারণ জনগণের অনেকাংশ প্লেটে ১০০ গ্রাম মাংসও রাখতে পারে না দিনে। একইভাবে দিনে দুটি ডিম খাওয়া জরুরি, তাও অনেকে পারছে না। দেশের অসংখ্য মানুষ একটা ডিম ভাজি করে চারজনে খায়। খাদ্য নিয়ে আলোচনা করলে প্রশাসনের প্রসঙ্গ চলে আসে। আমি মনে করি, ফুড ইজ হাইলি পলিটিক্যাল।
এএএম/এএসএ/জিকেএস