ভিডিও EN
  1. Home/
  2. স্বাস্থ্য

নিয়ন্ত্রণে নেই উদ্যোগ

সিলেটে ডেঙ্গুতে দুজনের মৃত্যু, জানে না স্বাস্থ্য বিভাগ

আহমেদ জামিল | সিলেট | প্রকাশিত: ০৭:১৭ পিএম, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪

চলতি বছর সিলেটে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। দুজনই হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) মারা গেছেন। কিন্তু তাদের মৃত্যুর কোনো তথ্য নেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগের কাছে।

এ কারণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে চলতি বছর দেশের অন্য বিভাগগুলোতে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর তথ্য থাকলেও সিলেট বিভাগে কোনো মৃত্যু নেই। এতে প্রকৃত তথ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশবাসী।

গত নভেম্বর মাসে আশঙ্কাজনকহারে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে। এমনকি শীতের সময়ও ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হচ্ছে। তবু এটি নিয়ন্ত্রণে নেই কোনো উদ্যোগ। বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু কর্নার নামে কিছু শয্যা প্রস্তুত করা ছাড়া স্বাস্থ্য বিভাগের দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি।

আরও পড়ুন

এমনকি যারা ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন তাদের প্রতিও নেই আলাদা যত্ন। হাসপাতালে ভর্তি অন্য সাধারণ রোগীদের মতো তাদেরও চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ডেঙ্গু রোগীরাও সাধারণ রোগীদের সঙ্গে মিলেমিশে সময় কাটাচ্ছেন। এতে হাসপাতাল থেকেই ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ার ঝুঁকি রয়েছে।

ডেঙ্গুতে দুজনের মৃত্যুর তথ্য জানে না স্বাস্থ্য বিভাগ

পরিবার সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের মার্চ মাসে জ্বর-শরীর ব্যথা নিয়ে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামের মৃত মীর জাফর মিয়ার ছেলে আম্বির খান। পেশায় গ্রামপুলিশ আম্বির খানের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ডেঙ্গু ধরা পড়ে। মাস খানেক চিকিৎসার পরও কোনো উন্নতি হয়নি তার। পরে ২ মে হাসপাতালের আইসিইউতে আম্বির খানের মৃত্যু হয় বলে হাসপাতালের এক নার্স জাগো নিউজকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

‘চলতি বছর ডেঙ্গুতে সিলেটে কারও মৃত্যু হয়নি। আমাদের কাছে এরকম কোনো তথ্য নেই। তাছাড়া নর্থ ইস্ট হাসপাতাল থেকে ডেঙ্গুর তথ্য আমাদের কাছে পাঠানো হয় না। কেউ তথ্য না দিলে আমাদের জানার কথা নয়।’- সিলেট বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. মো. আনিসুর রহমান

আম্বির খানের মেয়ে প্রীতি আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, তার বাবার প্রথমে জ্বর ছিল। এ অবস্থায় প্রথমে দিরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। পরে সেখান থেকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে নেওয়ার পর পরীক্ষা করে ডেঙ্গু ধরা পড়ে। শেষ পর্যন্ত তাকে আর বাঁচানো যায়নি। আইসিইউতে চিকিৎসার সময় মারা গেছেন।

আরও পড়ুন

একইভাবে প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে চলতি বছরের ৪ জুন সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হয়েছিলেন উপজেলার রাখালগঞ্জ এলাকার যুক্তরাজ্য ফেরত আজিজুর রহমান মামুন (৩৪)। অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় পরদিন তাকে সিলেটের নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে নেওয়ার পর তার অনেকগুলো পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু অবস্থার আরও অবনতি হলে নেওয়া হয় আইসিইউতে। রাতে আইসিইউতেই তার মৃত্যু হয়।

সিলেটে ডেঙ্গুতে দুজনের মৃত্যু, জানে না স্বাস্থ্য বিভাগ

হাসপাতালের আইসিইউর রেজিস্ট্রার শহীদুল ইসলাম মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে ৬ জুন জাগো নিউজকে জানান, রোগীর রক্ত পরীক্ষাগুলোর মধ্যে ডেঙ্গু পরীক্ষাও দেওয়া হয়েছিল। ডেঙ্গু পরীক্ষার রিপোর্ট পজিটিভ এসেছিল। আইসিইউতে নেওয়ার পর রোগীর অবস্থা আরও অবনতি হতে থাকে। একইসঙ্গে রক্তের প্লাটিলেটের পরিমাণ কমে গিয়েছিল। এছাড়া রক্তচাপও ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছিল। পরে রাত ১০টার দিকে তার মৃত্যু হয়।

আজিজুর রহমান মামুনের স্বজনরা জানান, মামুন যুক্তরাজ্যে থাকতেন। তার দুই মেয়ে শিশু রয়েছে। হঠাৎ জ্বর হলে প্রথমে দক্ষিণ সুরমা উপজেলা হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে নর্থ ইস্টে ভর্তি করার পর অবস্থার আরও অবনতি হয়। পরে আইসিইউতে মারা যান। তার পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ডেঙ্গু ধরা পড়েছে।

আরও পড়ুন

তখন ডেপুটি সিভিল সার্জন জন্মেজয় দত্ত জাগো নিউজকে বলেন, ‘মৃত্যুর বিষয়ে আমাদের কেউ অবহিত করেননি। তবে তিনি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়ে থাকলে সেটি সিলেটে এ মৌসুমে প্রথম ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হবে। গত বছর সিলেটে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে একজন মারা গিয়েছিলেন।’

এ নিয়ে গত ৬ জুন ‘সিলেটে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে যুবকের মৃত্যু’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করে জাগো নিউজ। কিন্তু স্বাস্থ্য বিভাগ আর বিষয়টির অনুসন্ধান করেনি এবং ডেঙ্গুর তথ্য আপডেট করেনি। এজন্য ডেঙ্গুর রিপোর্টে এখন পর্যন্ত সিলেটে মৃত্যু নেই বলে উল্লেখ করা হচ্ছে।

ডেঙ্গুতে গ্রামপুলিশ সদস্য আম্বির খানের মৃত্যুর বিষয়ে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. সৌমিত্র চক্রবর্ত্তী জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ বছর ওসমানী হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা যায়নি। এখন পর্যন্ত কোনো রোগীকে আইসিইউতে নিতে হয়নি। ডেঙ্গু আক্রান্ত যারা হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন, তাদের কারও অবস্থা আশঙ্কাজনক নয়। সবাই অনেকটা সুস্থ। আক্রান্তদের গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। একজন অধ্যাপকের নেতৃত্বে মেডিকেল বোর্ডের অধীনে ডেঙ্গু রোগীরা চিকিৎসা নিচ্ছেন।’

আরও পড়ুন

ডেঙ্গুতে মৃত্যুর বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. মো. আনিসুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘চলতি বছর ডেঙ্গুতে সিলেটে কারও মৃত্যু হয়নি। আমাদের কাছে এরকম কোনো তথ্য নেই। তাছাড়া নর্থ ইস্ট হাসপাতাল থেকে ডেঙ্গুর তথ্য আমাদের কাছে পাঠানো হয় না। কেউ আমাদের তথ্য না দিলে আমাদের জানার কথা নয়।’

তিনি বলেন, সিলেটে যারা ডেঙ্গু আক্রান্ত তারা ঢাকা থেকে আক্রান্ত হয়ে এসেছে। সিলেটের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হবিগঞ্জে। সেখানকার মানুষজনের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ বেশি। যারাই আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের বেশিরভাগই ঢাকায় আক্রান্ত হয়ে সিলেটে এসেছেন।

এখন শীত চলে এলেও কমেনি ডেঙ্গুর প্রকোপ। গত ১ থেকে ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত সিলেট বিভাগে আক্রান্ত হয়েছে ২৫ জন। প্রতিদিন গড়ে আক্রান্ত হচ্ছে তিন দশমিক ১৩ জন।

তিন বছরে সিলেটে যত ডেঙ্গু রোগী

সিলেটের স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যমতে, ২০২২ সালে সিলেট বিভাগে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল ১২৬ জন। পরের বছর ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ৪৬৪ জনে। চলতি বছরের প্রথম দিকে অনেকটা নিয়ন্ত্রণে ছিল আক্রান্তের সংখ্যা। কিন্তু গত নভেম্বর মাসে আশঙ্কাজনক হারে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ে। আক্রান্ত হয় ১৩৯ জন। প্রতিদিন গড়ে আক্রান্ত হয় চার দশমিক ৬৩ জন।

আরও পড়ুন

জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় ১৬৯ জন। প্রতিদিন গড়ে আক্রান্ত হয় ‍শূন্য দশমিক ৫৫ জন। এখন শীত চলে এলেও কমেনি ডেঙ্গুর প্রকোপ। গত ১ থেকে ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত সিলেট বিভাগে আক্রান্ত হয়েছে ২৫ জন। প্রতিদিন গড়ে আক্রান্ত হচ্ছে তিন দশমিক ১৩ জন।

সিলেটে ডেঙ্গুতে দুজনের মৃত্যু, জানে না স্বাস্থ্য বিভাগ

এ ব্যাপারে ডা. মো. আনিসুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ডেঙ্গু সংক্রমণের মৌসুম পরিবর্তিত হয়ে জুলাই-আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর হয়েছে। এছাড়া একটা বড় সংখ্যক রোগী নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসেও পাওয়া যায়। এসময় পানির স্বাভাবিক প্রবাহ না থাকায় বিভিন্ন স্থানে পানি জমে এডিস মশার জন্ম হয়। এ কারণে এই সময় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যায়।’

‘২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য মশার ওষুধ কেনা হয়নি। তবে আমি যোগদানের পর প্রথমেই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে মশার ওষুধ কিনেছি। গত সপ্তাহ থেকে বিভিন্ন ওয়ার্ডে শুরু হয়েছে এ কার্যক্রম। তবে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে একসঙ্গে ৪২ ওয়ার্ডে মশক নিধন অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব নয়।’- সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রেজাই রাফিন সরকার

‘অভিভাবকহীন’ নগর, ডেঙ্গু প্রতিরোধে নেই উদ্যোগ

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকে অনেকটা অভিভাবকহীন সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)। নগরের বিভিন্ন ওয়ার্ডে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হলেও কার্যত কোনো কাজে তাদের পাওয়া যাচ্ছে না। বিশেষ করে মশক নিধনে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। এডিস মশা নিধনে বিগত সময়ে নগরীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালানো হলেও সরকার পতনের পর থেকে এসব কার্যক্রম নেই। এমনকি ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজেও গাফিলতি রয়েছে।

আরও পড়ুন

সিসিক সূত্র জানায়, মশক নিধনের কোনো ওষুধই তাদের কাছে নেই। এ কারণে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. মো. আনিসুর রহমান বলেন, ‘ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে এটা সত্য। সে তুলনায় সিসিকের মশক নিধন অভিযান চোখে পড়ছে না। বিষয়টি কয়েকদিন আগে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সভায় আমি তুলে ধরেছি।’

এ ব্যাপারে সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রেজাই রাফিন সরকার জাগো নিউজকে বলেন, ‘২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য মশার ওষুধ কেনা হয়নি। তবে আমি যোগদানের পর প্রথমেই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে মশার ওষুধ কিনেছি। গত সপ্তাহ থেকে বিভিন্ন ওয়ার্ডে শুরু হয়েছে এ কার্যক্রম। তবে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে একসঙ্গে ৪২ ওয়ার্ডে মশক নিধন অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব নয়।’

জেএএইচ/এমএমএআর/এমএস

আরও পড়ুন