পরিত্যক্ত পণ্য কিনে ডিএনসিসির ডেঙ্গু প্রতিরোধ কার্যক্রম বন্ধ
• অর্থছাড় না করেই পণ্য কেনার ঘোষণা দেন সাবেক মেয়র
• ৫ আগস্টের পর থেকে মেয়র-কাউন্সিলররা আত্মগোপনে
• প্লাস্টিক পণ্য কেনা বন্ধ
চলতি বছর বর্ষা মৌসুমে এডিস মশার বংশ বিস্তার নিয়ন্ত্রণে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। এরই অংশ হিসেবে ওয়ার্ডভিত্তিক পরিত্যক্ত প্লাস্টিক পণ্য, চিপসের প্যাকেট, ডাবের খোসা ও টায়ার কেনার উদ্যোগ নেয় সংস্থাটি। কিন্তু করপোরেশন থেকে অর্থছাড় না করায় বন্ধ এ কার্যক্রম।
যে কয়েকটি ওয়ার্ডে আগে কাউন্সিলররা নিজ উদ্যোগে পরিত্যক্ত প্লাস্টিক পণ্য কিনেছেন, তাদের বিল এখনো বকেয়া। আবার যারা কাউন্সিলর অফিসে পরিত্যক্ত পণ্য জমা দিয়েছেন, তাদের অনেকে টাকা পাননি। এর মধ্যে গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ডিএনসিসির অধিকাংশ কাউন্সিলর আত্মগোপনে চলে গেছেন। পরে ডিএনসিসির মেয়রসহ সব কাউন্সিলরকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
নাগরিকদের অভিযোগ, ডিএনসিসির ঘোষণা অনুযায়ী পরিত্যক্ত পণ্য বিক্রি করতে নিয়ে গেলে আগ্রহ দেখায়নি কাউন্সিলর অফিসের লোকজন। আবার কয়েকটি ওয়ার্ডে পণ্য কিনলেও টাকা দেওয়া হয়নি। তহবিলে অর্থ বরাদ্দ নেই জানিয়ে বিক্রেতাদের নাম-ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর লিখে রাখা হয়েছিল। ফলে ডিএনসিসির এ উদ্যোগ শুরুর আগেই মুখ থুবড়ে পড়ে।
এডিস নিধনে পরিত্যক্ত প্লাস্টিক পণ্য কেনার ঘোষণা দেওয়ার পরপরই শহরের মানুষের অনেক সাড়া পেয়েছি। তবে দ্বিতীয় মাসে রেসপন্স কম ছিল। গত জুলাইয়ের পর থেকে এই কার্যক্রম থমকে আছে। এখন তো কাউন্সিলর নেই, অনেক জায়গায় কাউন্সিলর কার্যালয়ই বন্ধ।- ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী
তবে ডিএনসিসির দাবি, নগর কর্তৃপক্ষের (মেয়র আতিকের সময়) কর্মপন্থা পুরোপুরি ঠিক ছিল না। সব কাজেই তড়িঘড়ি করা হয়েছিল। তহবিল গঠন বা অর্থছাড় না করেই পরিত্যক্ত প্লাস্টিক পণ্য কেনার ঘোষণা দিয়েছিলেন আতিকুল ইসলাম। তখন নিজ পকেটের টাকা খরচ করে পণ্য কিনে পরে কেনার আগ্রহ হারিয়েছেন কাউন্সিলররা। এখন বিষয়টি নিয়ে ডিএনসিসিরও কোনো আগ্রহ নেই।
জানতে চাইলে ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘এডিস নিধনে পরিত্যক্ত প্লাস্টিক পণ্য কেনার ঘোষণা দেওয়ার পরপরই শহরের মানুষের অনেক সাড়া পেয়েছি। তবে দ্বিতীয় মাসে রেসপন্স কম ছিল। গত জুলাইয়ের পর থেকে এই কার্যক্রম থমকে আছে। এখন তো কাউন্সিলর নেই, অনেক জায়গায় কাউন্সিলর কার্যালয়ই বন্ধ। আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে পণ্য কেনা বন্ধের ঘোষণা দেইনি। তবে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ডিএনসিসি নিরলসভাবে কাজ করছে।’
যে কারণে পরিত্যক্ত পণ্য কেনার উদ্যোগ
কীটতত্ত্ববিদের তথ্যমতে, খাল ও ড্রেনের ময়লা পানিতে এডিস মশা জন্মায় নয়। পরিত্যক্ত ডাবের খোসা, পলিথিন, চিপসের প্যাকেট, আইসক্রিমের কাপ, দইয়ের কাপ, টায়ার, কমোড, রঙের কৌটায় জমে থাকা স্বচ্ছ পানিতে এডিস মশা জন্মায়। তাই এসব পরিত্যক্ত দ্রব্য কিনে নিতে উদ্যোগ নিয়েছিল ডিএনসিসি।
- আরও পড়ুন
- ডিএনসিসির পরিত্যক্ত পণ্য কেনায় ‘গোড়ায় গলদ’
- ডাবের খোসা ২ ও চিপসের প্যাকেট ১ টাকায় কিনছে ডিএনসিসি
- ডেঙ্গু জ্বর সারানোর ঘরোয়া উপায় কী?
গত ২২ এপ্রিল রাজধানীর মিরপুর রূপনগর এলাকায় ডেঙ্গু প্রতিরোধে একযোগে ৫৪টি ওয়ার্ডে মাসব্যাপী জনসচেতনতামূলক প্রচার অভিযানের উদ্বোধনীতে এসব পণ্য কেনার ঘোষণা দেন ডিএনসিসির তৎকালীন মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। তখন এ কাজে প্রত্যেক ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে মাসে প্রাথমিকভাবে ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়ার ঘোষণা দেন তিনি।
ডিএসসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ সূত্র জানায়, মেয়রের ঘোষণা অনুযায়ী চিপসের প্যাকেট বা সমজাতীয় প্যাকেট প্রতি পিস এক টাকা, আইসক্রিম, ডিসপোজেবল কাপ এক টাকা, ডাবের খোসা দুই টাকা, কনডেন্স মিল্কের কৌটা দুই টাকা, মাটি, প্লাস্টিক, সিরামিক, মেলামাইন তিন টাকা, অন্য পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের দ্রব্য প্রতি কেজি ১০ টাকা, পরিত্যক্ত টায়ার প্রতি পিস ৫০ টাকা, পরিত্যক্ত পলিথিন প্রতি কেজি ১০ টাকা, পরিত্যক্ত স্যানিটারি ওয়্যার কমোড, বেসিন প্রতি পিস ১০০ টাকা করে নির্ধারণ করা হয়।
এই মূল্যতালিকা ডিএনসিসির প্রত্যেক ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ে টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং এই মূল্যতালিকা অনুযায়ী পণ্য কিনছিল কাউন্সিলর অফিস। পরে এসব পণ্য সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের বর্জ্য পরিদর্শক আঞ্চলিক কার্যালয়ের মাধ্যমে আমিনবাজার ল্যান্ডফিলে নিয়ে ফেলা হতো।
ভাটারার কুড়িল মিয়াবাড়ি রোড। এ রোডের ক-১৮৫/৫ নম্বর হোল্ডিংয়ে ডিএনসিসির ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কার্যালয়। গত মে মাসে এই কার্যালয়ে পরিত্যক্ত পণ্যের মূল্যতালিকা টাঙানো ছিল। সেখানে স্থানীয় অনেকে পরিত্যক্ত পণ্য নিয়ে বিক্রি করতেন। তবে এখন সেখানে মূল্যতালিকা নেই। কাউকে পরিত্যক্ত চায়ের কাপ, চিপসের প্যাক, পলিথিন কিনতেও দেখা যায়নি।
মেয়রের ঘোষণার পর থেকে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ হাজার টাকার পরিত্যক্ত পণ্য কেনা শুরু করেছিলাম। মহল্লার টোকাইরাই তা বিক্রি করতো। এখন কার্যক্রম বন্ধ, কাউন্সিলরও নেই।- ওয়ার্ড সচিব নুরুল ইসলাম মোল্লা
জানতে চাইলে ওয়ার্ড সচিব নুরুল ইসলাম মোল্লা জাগো নিউজকে বলেন, ‘মেয়রের ঘোষণার পর থেকে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ হাজার টাকার পরিত্যক্ত পণ্য কেনা শুরু করেছিলাম। মহল্লার টোকাইরাই তা বিক্রি করতো। এখন কার্যক্রম বন্ধ, কাউন্সিলরও নেই।’
তিনি বলেন, ‘যে অফিসে বসে কাউন্সিলর দপ্তরের কাজ করি, এটা কাউন্সিলরের নিজস্ব সম্পত্তি। তিনি ২০ আগস্ট আত্মগোপনে চলে যান। এখন এই কার্যালয় ভাড়া দেওয়ার জন্য ‘টু-লেট’ টাঙিয়ে দিয়েছেন কাউন্সিলরের স্ত্রী। আমাদেরও চলে যেতে বলছেন। এ নিয়ে আমরা বিপাকে আছি।’
একাইভাবে সম্প্রতি ডিএনসিসির ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কার্যালয় (বনানী), ২০ নম্বর নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কার্যালয় (মহাখালী), ২২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কার্যালয় (দক্ষিণ বাড্ডা), ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কার্যালয়ে (ফার্মগেট) গিয়ে কোথাও পরিত্যক্ত প্লাস্টিক পণ্য কিনতে দেখা যায়নি। উল্টো এসব কাউন্সিলর কার্যালয়ের সামনের সড়ক, ফুটপাতে প্লাস্টিকের পরিত্যক্ত পণ্য ছড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে।
ডিএনসিসির পরিত্যক্ত পণ্য কেনায় ‘গোড়ায় গলদ’ ছিল
ডিএনসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ সূত্র জানায়, ডিএনসিসিতে মোট ৫৪টি ওয়ার্ড। আট থেকে ১০টি পাড়া বা মহল্লা নিয়ে একেকটি ওয়ার্ড। এসব মহল্লার পরিত্যক্ত বর্জ্য কেনার একটিই জায়গা ছিল, সেটি ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়। কেউ চাইলেই পরিত্যক্ত প্লাস্টিক পণ্য সংগ্রহ করে কাউন্সিলর কার্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। আবার যারা বিক্রি করতে যেতেন, তাদেরও ঠিকমতো টাকা দেওয়া হয়নি। যেহেতু অর্থই ছাড় করা হয়নি। এমন অবস্থায় উদ্যোগটি থমকে যায়।
উত্তরার ফায়দাবাদ, কোটবাড়ী, মৌশাইর ও চালাবন এলাকা নিয়ে ডিএনসিসির ৪৭ নম্বর ওয়ার্ড। গত ২২ এপ্রিল পরিত্যক্ত পণ্য কেনা নিয়ে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে স্থানীয় কাউন্সিলর আনিসুর রহমান নাঈমের কথা হয়েছিল। তখন নাঈম জাগো নিউজকে বলেন, ‘যারা কাউন্সিলর অফিসে পরিত্যক্ত পণ্য জমা দিচ্ছেন, দিন-তারিখ দিয়ে তাদের নাম, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর তালিকা করে রাখা হচ্ছে। করপোরেশন থেকে টাকা পেলে সবাইকে ডেকে নিয়ে টাকা বিতরণ করা হবে।’ তবে গত ৫ আগস্ট পর্যন্ত এই টাকা আর বিক্রেতারা পায়নি বলে জানিয়েছে ডিএনসিসি সূত্র।
উত্তরার কোটবাড়ীর বাসিন্দা হাসান জামান বলেন, ‘ডিএনসিসির ওই ঘোষণার পর এলাকার অনেক টোকাই, গৃহকর্মী, পরিত্যক্ত পলিথিন, প্লাস্টিক সংগ্রহ করছিলেন। অনেক চায়ের দোকানি নিজ দোকানের ব্যবহৃত চায়ের কাপ, পলিথিনও বস্তায় ভরে কাউন্সিলর অফিসে দিয়ে আসছেন। কিন্তু তাদের কাউকে টাকা দেওয়া হয়নি।’
অর্থছাড় না করে কেন ব্যবহৃত পরিত্যক্ত পণ্য কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, এ বিষয়ে জানতে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলমের মোবাইলে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে ডিএনসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা মকবুল হোসাইন জাগো নিউজকে বলেন, ‘সাবেক মেয়রের ঘোষণার পরপরই অর্থছাড় করতে দাপ্তরিক কাজ শুরু হয়েছিল। কিন্তু দাপ্তরিক কাজ শেষ হওয়ার আগেই গত আগস্টে তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এখন সেই ফাইল কী অবস্থায় আছে, তা জানা নেই।’
এমএমএ/এএসএ/এএসএম