ডেঙ্গুতে মৃত্যু
এখনো ছেলের জন্য কাঁদেন রংপুরের মানু লাল, শীতেও হচ্ছে ডেঙ্গু
রংপুর শহরের ডোম মানু লালের দুই ছেলে। বড় ছেলে বুলেট বাসফো। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সরকারি একটা চাকরি জুটিয়েছিলেন বুলেট। ছেলের চাকরিতে মানু লালের দু’চোখ ভরে স্বপ্ন ছিল দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের নিশ্চয়তা। কিন্তু সে স্বপ্ন পূরণ হওয়ার আগেই ডেঙ্গু কেড়ে নিয়েছে সব আশা। গত বছরের ৪ জুলাই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান বুলেট। এখনো ছেলের জন্য কাঁদেন মানু লাল।
বুলেটের বাবা মানু লাল জানান, ২০২২ সালের শুরুর দিকে চাকরি হয় বুলেটের। ধারদেনা করে ঢাকার একটি সরকারি দপ্তরে যোগ দেন। দেড় বছরের মাথায় ঈদের ছুটিতে রংপুর নগরীর পুরাতন সদর হাসপাতাল কলোনির বাড়িতে এসেই জ্বরে আক্রান্ত হন বুলেট। পরে পরীক্ষা করে ডেঙ্গু নিশ্চিত হলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে মারা যান বুলেট। বুলেটের স্ত্রী রীতা রানী এখন শ্বশুরের আশ্রয়ে থেকে পাড়ি দিচ্ছেন অনিশ্চিত অনাগত দিন।
গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার নকাইহাটের আশরাফুল ও লাবনী দম্পতির একমাত্র সন্তান ছিল রিয়ানা। নারায়ণগঞ্জের একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন আশরাফুল। সন্তানের দেখাশোনার জন্য স্ত্রীকে কোথাও কাজ করতে দেননি। কিন্তু নিয়তির খেলা ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে ২০১৯ সালের ৩ আগস্ট রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় রিয়ানাকে। ৬ আগস্ট সকাল ৭টায় মারা যায় রিয়ানা।
- আরও পড়ুন
- ডেঙ্গু সংক্রমণের মূল কারণ জলবায়ু পরিবর্তন
- ডেঙ্গুতে বাবার মৃত্যু, ছেলের অবস্থাও সংকটাপন্ন
- ‘একটি পদ্ধতিতে মশা নিধনে সফলতা আসবে না’
নীরব ঘাতক ডেঙ্গুর কবলে পড়ে অঙ্কুরেই ঝরে পড়ছে মানু লাল ও আশরাফুলের মতো এমন অনেকের স্বপ্ন। কেবল গ্রীষ্ম বা বর্ষা নয়, এখন সারা বছরের রোগ হিসেবে ভয়ংকর হয়ে উঠছে ডেঙ্গু।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে ডেঙ্গুর ধরন বদলেছে। ডেঙ্গু একদিকে যেমন ভয়ংকর হয়ে উঠছে, তেমনি শহর ছাড়িয়ে ঝুঁকি বাড়িয়েছে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও। কমবেশি সারা বছরই ডেঙ্গু আক্রান্তের খবর পাওয়া যাচ্ছে।
মানু লাল ও তার ছেলে বুলেট বাসফো
রংপুর বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, গত দুই বছরে রংপুরের আট জেলায় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে সরকারি মেডিকেলে মারা গেছে ১৪ জন। এর বাইরে বেসরকারি মেডিকেল ও বাড়িতেও মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর।
- আরও পড়ুন
- বিয়ের দিনক্ষণ চূড়ান্ত, তার আগেই ডেঙ্গুতে প্রাণ গেলো তামান্নার
- চাঁদপুরে নতুন করে ডেঙ্গুর প্রকোপ
- ডেঙ্গুতে ভিকারুননিসার ছাত্রীর মৃত্যু
পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২ সালে রংপুর বিভাগের আট জেলায় ডেঙ্গু জ্বরে মোট আক্রান্ত রোগী ছিল ২৬৫ জন। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী চিকিৎসা নিয়েছে দিনাজপুরের এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৪৭ জন এবং রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৫৪ জন। এর বাইরে ঠাকুরগাঁও হাসপাতালে ১০ জন, নীলফামারী হাসপাতালে ৩২ জন, পঞ্চগড় হাসপাতালে নয়জন, লালমনিরহাটে সাতজন, কুড়িগ্রামে চারজন এবং গাইবান্ধায় দুজন।
২০২৩ সালে এ বিভাগে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছিল পাঁচ হাজার ৪৯৪ জন। মৃত্যু হয়েছিল ১২ জনের। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ছিল দিনাজপুরে পাঁচজন। এরপর রংপুরে চারজন, গাইবান্ধায় দুজন ও লালমনিরহাটে একজন। গত বছর বেশি রোগী চিকিৎসা নিয়েছে রংপুরে এক হাজার ২৯৫ জন। এরমধ্যে স্থানীয়ভাবে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৪৬০ জন। এছাড়া গাইবান্ধায় এক হাজার ৪৪ জন, দিনাজপুরে ৮৮৩ জন, নীলফামারীতে ৭৬৫ জন, কুড়িগ্রামে ৭০৮ জন, লালমনিরহাটে ৩০৩ জন, ঠাকুরগাঁওয়ে ৩০৯ জন ও পঞ্চগড়ে ১৮৭ জন।
- আরও পড়ুন
- ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হাইকোর্টের নির্দেশ
- ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর তথ্য সংগ্রহ করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভাগের আট জেলায় মোট আক্রান্ত হয়েছে এক হাজার ৪৭২ জন। এর মধ্যে বেশি রোগী দিনাজপুরে ৩৪৪ জন, নীলফামারীতে ৩০১, কুড়িগ্রামে ২১৭, গাইবান্ধায় ১৪৬, রংপুরে ১৯৭, লালমনিরহাটে ৬৩, ঠাকুরগাঁওয়ে ৭৭ এবং পঞ্চগড়ে ১১৮ জন।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে ৩০ জন এবং মৃত্যু হয়েছে দুজনের। এর মধ্যে গাইবান্ধায় একজন এবং নীলফামারীতে একজন। আক্রান্ত রোগীরা রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বিভাগের সব জেলা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রংপুর বিভাগীয় পরিচালক ডা. মো. হারুন-অর-রশীদ জাগো নিউজকে বলেন, রংপুরে ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪-এ ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা দুটোই কমেছে। সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য এটি কমানো সম্ভব হয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে অনেক জায়গায় স্থানীয় প্রশাসন আংশিক নিষ্ক্রিয় থাকায় পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। তবে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি ও স্থানীয় প্রশাসন সক্রিয় ভূমিকা পালন করলে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা সম্ভব।
শীতেও ডেঙ্গু রোগী থাকা প্রসঙ্গে ডা. মো. হারুন-অর-রশীদ বলেন, মশারি না টাঙিয়ে ঘুমানোর প্রবণতা এবং মশা নিধনে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া অন্যতম কারণ। ডেঙ্গু থেকে রেহাই পেতে সবাইকে স্বাস্থ্য সচেতন হতে হবে।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, নদী ও পরিবেশ বিষয়ক গবেষক ড. তুহিন ওয়াদুদ জাগো নিউজকে বলেন, দেশে ডেঙ্গুর ধরন বদলেছে। বর্তমান সময়ে বর্ষাকাল বা বৃষ্টি এসবের সঙ্গে ডেঙ্গুর সম্পর্ক নেই। কারণ ডেঙ্গু বিস্তারকারী এডিস মশার লার্ভা এখন জমে থাকছে নির্মাণাধীন ভবন, পরিত্যক্ত টায়ারসহ বিভিন্ন জায়গায়। এসব কারণে ডেঙ্গু হয়ে উঠেছে সারা বছরের রোগ। এটা কেবল ঢাকাকেন্দ্রিক নয়, দেশজুড়ে ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্য সবাইকে স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়াতে হবে।
জেডআইকে/এমএএইচ/এমএমএআর/জিকেএস