ভিডিও EN
  1. Home/
  2. স্বাস্থ্য

বিরূপ আবহাওয়ার কারণে বছরজুড়ে ভোগাচ্ছে ডেঙ্গু

মুসা আহমেদ | প্রকাশিত: ১০:২৭ এএম, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪

ডেঙ্গু আমাদের দেশে বর্ষার রোগ হিসেবে পরিচিত। বর্ষার সময় জমে থাকা পানিতে এডিস মশা দ্রুত প্রজনন করে। বাড়ে ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ। ভোল পাল্টে গত কয়েক বছর সারা বছরই দাপট দেখাচ্ছে মশাবাহিত এ রোগটি। শুষ্ক মৌসুম, এমনকি শীতেও প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছে কয়েকশ মানুষ, হচ্ছে মৃত্যু।

শুষ্ক মৌসুমেও ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার বিষয়ে কীটতত্ত্ববিদ ও গবেষকরা বলছেন, এডিসের উপদ্রব বাড়ার বড় কারণ ‘জলবায়ুর পরিবর্তন’। এখন ডেঙ্গু শীত-গ্রীষ্ম কিছুই মানছে না। পরিবর্তিত আবহাওয়ায়ও খাপ খাইয়ে নিচ্ছে। যে কারণে সারা বছরই ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। আর মানুষের অসচেতনতায় তা নিয়ন্ত্রণেও আনা যাচ্ছে না।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ ও গবেষক অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার জাগো নিউজকে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের আবহাওয়া ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার জন্য বেশ উপযোগী। ডিসেম্বর মাসেও দিন-রাতের তাপমাত্রার পার্থক্যই তা বলে দেয়। এমন আবহাওয়ায় এডিস মশা তার প্রজনন ও বসবাসের জন্য নতুন নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম হচ্ছে।’

‘গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আবহাওয়ায় তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বাড়ার সঙ্গে এডিস মশার বংশবৃদ্ধি এবং ডেঙ্গুর সংক্রমণও বাড়ছে। যদিও জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে ডেঙ্গু ভাইরাসের সরাসরি সম্পর্ক নিয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা এখন পর্যন্ত সম্পন্ন হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান শুধু ঢাকার ৭৭টি হাসপাতাল এবং কয়েকটি জেলার হাসপাতালের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। বাস্তবতা হচ্ছে, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ছোট-বড় ক্লিনিকে আরও অসংখ্য রোগী চিকিৎসা নিচ্ছে। এমন অনেক রোগী আছে, যারা ডেঙ্গু পরীক্ষা করিয়ে বাসায় থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছে। প্রতিবার ডেঙ্গুর সংক্রমণ একই সময়ে ফিরে আসছে এবং আমরা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছি। এডিস মশা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেওয়ায় রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।’

কবিরুল বাশার বলেন, ‘ডেঙ্গুর প্রকোপ কম বা বেশি হওয়ার পেছনে জনসাধারণের সচেতনতা, এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংসে তাদের সহযোগিতা ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর যথাযথ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশের বিভিন্ন স্থানে আমাদের গবেষণা দল ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার ঘনত্বের যে গবেষণা করছে, তা থেকেও স্পষ্টভাবে জানা যাচ্ছে যে পরিস্থিতি খুবই জটিল। ব্রুটো ইনডেক্স নামে পরিচিত মশার ঘনত্বের সূচক যদি কোনো এলাকায় ২০-এর ওপর থাকে, তবে সেই এলাকায় ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগের ঝুঁকি বেশি থাকে। আমাদের পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, বিভিন্ন স্থানে ব্রুটো ইনডেক্স এখনো ২০-এর ওপরে রয়ে গেছে। এডিস মশার ঘনত্ব এমন থাকলে নভেম্বর-ডিসেম্বরে শীতের মধ্যেও ডেঙ্গু সংক্রমণের ঝুঁকি কমবে না।’

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ফজলে শামসুল কবির বলেন, ‘সাধারণত আগে এপ্রিল থেকে জুন বা জুলাই পর্যন্ত ঢাকা শহরে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা যেত। এখন সারা বছরই হাসপাতালে ডেঙ্গুরোগী পাওয়া যাচ্ছে। কয়েক বছর ধরে অসময়ে বৃষ্টি বা জলবায়ু পরিবর্তনে আক্রান্ত রোগীর হার বাড়ছে। চলতি বছরও সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে। ফলে শহর-গ্রাম সব জায়গায় ডেঙ্গু প্রকোপ বাড়ছে।’

তিনি বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সারা বিশ্বেই ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। আমাদের তুলনায় মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়ায় ডেঙ্গুর প্রকোপ পাঁচ গুণ বেশি। তবে এসব দেশে মৃত্যুর হার খুবই কম। যদিও সেখানে জনসংখ্যা কম। চিকিৎসাসেবা ভালো। আমাদের দেশে জ্বর হলে ডাক্তারের কাছে যেতে চায় না। উল্টো প্যারাসিটামল খাই। শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ না হলে অনেকে হাসপাতালেই যায় না। ফলে ডেঙ্গুতে মৃত্যু বেশি হচ্ছে।’

ডিএসসিসির কর্মকর্তা ফজলে শামসুল কবির বলেন, ‘আগে শুধু ঢাকা-চট্টগ্রাম শহরে ডেঙ্গু হতো। এখন যেখানেই নগরায়ণ হচ্ছে, সেখানে ডেঙ্গু বংশ বিস্তার করছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এখন মোট ডেঙ্গুরোগীর ৮০ শতাংশই ঢাকার বাইরের। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে করপোরেশনের পাশাপাশি নাগরিকদের সচেতনতা খুব বেশি জরুরি।’

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চলতি বছরের নভেম্বরের দিকে সারাদেশে এডিস মশার প্রকোপ বাড়বে, তা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আগেই সবাইকে জানিয়েছিল বলে জানান ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘এবার জুন-জুলাইয়ের দিকে ঢাকায় বৃষ্টিপাত কম ছিল। তখন শহরের হাসপাতালগুলোতে রোগীর সংখ্যাও কম ছিল। কিন্তু অক্টোবর-নভেম্বরে বৃষ্টি বেশি হওয়ায় রোগীর সংখ্যাও বেড়ে যায়।’

একটি গবেষণার উদাহরণ দিয়ে ইমরুল কায়েস চৌধুরী বলেন, ‘কোনো ডেঙ্গুপ্রবণ এলাকায় এক মিলিমিটার বৃষ্টি বেশি হলে ১৮ শতাংশ ডেঙ্গু বেড়ে যায়। তবে এখন জলবায়ুর যে পরিস্থিতি ডেঙ্গু সারা বছরই থাকবে। এর মধ্যে বৃষ্টি বেশি হলে ডেঙ্গু বাড়বে।’

গত ১ ডিসেম্বর ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএমসিএ) আয়োজিত এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। ডেঙ্গুর ভয়াবহতা ও প্রতিরোধে করণীয় বিষয়ে গণসচেতনতামূলক এ সভায় সংগঠনটির সভাপতি এম এ মুবিন খান বলেন, প্রতিদিন বাড়ছে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগী এবং মৃত্যুর সংখ্যা। জেলা শহরগুলোতে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি না হলেও ঢাকা-চট্টগ্রামের অবস্থা ভয়াবহ। এবার ‘এক্সপান্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রোমে’ মৃত্যুহার বাড়ছে। সাধারণত দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বর্ষার আগে শুরু হয়। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ডেঙ্গু ভাইরাসবাহিত মশা শীত-গ্রীষ্ম মানছে না, বছরব্যাপী প্রজনন ও বংশবিস্তার করছে।

বিপিএমসিএ সভাপতি বলেন, পৃথিবীর যেসব শহর ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছে, দেখা যায় তারা সারাবছর ধরে নিবিড় নজরদারি চালায়, যেন কোথাও পানি জমে না থাকে। বিশেষ করে পাশের কলকাতা শহর ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছে। সেখানে বেশ কয়েক বছর ধরে কলকাতা করপোরেশন সারা বছর ধরেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের কাজ করছে। তাদের প্রতিটি ওয়ার্ডে কর্মী আছেন, যাদের মধ্যে একদল প্রচারের কাজ চালায়, আর অন্য দল পানি জমে কি না কোথাও সেটার ওপর নজর রাখে।

এছাড়া শহরের প্রতিটা হাসপাতাল বা পরীক্ষাগারে রোগীদের কী কী রক্ত পরীক্ষা হচ্ছে বা ভাইরাস পাওয়া যাচ্ছে তার প্রতিদিনের হিসাব রাখা হয়, যাতে ডেঙ্গুরোগীর খোঁজ পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া যায়- জানান তিনি।

এমএমএ/এএসএ/জেআইএম