ভিডিও EN
  1. Home/
  2. স্বাস্থ্য

ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ

ডেঙ্গুতে অবহেলা নয়, জ্বর হলেই পরীক্ষা করুন

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক | প্রকাশিত: ০৯:২২ এএম, ২৮ অক্টোবর ২০২৪

‘ডেঙ্গু তার চরিত্র বদলেছে। এখন রোগীর এক-দুই দিন জ্বর থাকে, এরপর আবার থাকে না। কিন্তু পরে আবার জ্বর আসে। তখন শরীরে প্রেসার পাওয়া যায় না। রোগী আবোল তাবোল কথা বলে। এটি খুবই ভয়ংকর। এ রোগে যারা মারা যাচ্ছেন, তাদের বেশিরভাগই এমন অবস্থায় পাওয়া যায়। আর এর মূল কারণ হচ্ছে অবহেলা। জ্বর হলে আমরা পাত্তাই দিতে চাই না। কালক্ষেপণ করি। তাই জ্বর হলেই পরীক্ষা করা জরুরি।’

শুক্রবার (২৫ অক্টোবর) রাজধানীর বাড্ডায় জাগো নিউজের অফিসে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা বলেন ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ। ‘ডেঙ্গুর প্রকোপ: সচেতনতায় করণীয়’ শীর্ষক এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে জাগো নিউজ। এ গোলটেবিল বৈঠকে ডেঙ্গুর জীবাণুুবাহী এডিস মশা নিধন ও ডেঙ্গু আক্রান্ত মানুষের চিকিৎসা ও সচেতনতা নিয়ে করণীয় বিষয়ে বিস্তর আলোচনা হয়। অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা করে ‘ভিশন মশকিউটো কিলিং ব্যাট ডেঙ্গু সতর্কতা সিজন-৩’।

জাগো নিউজের প্ল্যানিং এডিটর মনিরুজ্জামান উজ্জ্বলের সঞ্চালনায় গোলটেবিল বৈঠকে জাগো নিউজের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক জিয়াউল হক, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) কীটতত্ত্ব বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক মো. গোলাম ছারোয়ার ও শ্যামলী ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট টিবি হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার, প্রধান প্রতিবেদক ইব্রাহীম হুসাইন অভি, ভিশন ইলেকট্রনিক্সের ডেপুটি ব্র্যান্ড ম্যানেজার রেজওয়ানুল হক প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, যে কারো সর্দি, জ্বর, গলা ব্যথা, মাথা ব্যথা হলে অবহেলা করা যাবে না। দ্রুত সময়ের মধ্যে ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে হবে। ডেঙ্গু পজেটিভ হলে চিকিৎসাও শুরু করা যাবে। তিনি বলেন, ডেঙ্গু হলে প্রচণ্ড শরীর ব্যথা হয়। এ জন্য ডেঙ্গুকে বলা হয়, ব্রেক বোন ফিভার। ডেঙ্গুতে এতো জ্বর, ব্যথা হয়, যার হয় সেই বুঝে। এক কথায় এটাকে হারভাঙা জ্বর বলা হয়। এরকম জ্বর হলে চার-পাঁচ দিন থাকে। এরপর জ্বর চলে যায়। কিন্তু এ সময় রোগীকে সতর্ক থাকতে হবে। অন্যথায় মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। ডেঙ্গুর পরবর্তী সময়টাকে ক্রিটিকাল পিরিয়ড বলা হয়। এই সময় যত অঘটন ঘটে। প্লাটিলেট কমে যায়; রক্তক্ষরণ হয়। অনেকের নাক-মুখ এবং টয়লেটের জায়গা দিয়ে রক্ত যায়। এমন কারো হলে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।

ডেঙ্গুতে অবহেলা নয়, জ্বর হলেই পরীক্ষা করুন

তবে ডেঙ্গু রোগীর ৮০-৯০ শতাংশ চিকিৎসা ঘরে বসে সম্ভব জানিয়ে ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, ডেঙ্গু রোগীর মাত্র ২০ শতাংশ হাসপাতালে চিকিৎসা লাগে। তারও হয়তো এক থেকে দুই শতাংশের আইসিইউ লাগে। কিন্তু তারপরও এ রোগকে অবহেলা করা যাবে না। ডেঙ্গু হলে প্রচুর পরিমাণ পানি, তরল খাবার খেতে হবে। তবে যাদের বমি, পাতলা পায়খানা হয়, তাদের কিন্তু ঘরে বসে থাকা যাবে না।

শিশু, বয়স্ক লোক ও গর্ভবর্তী নারীরা ডেঙ্গুর জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ জানিয়ে ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, এই তিন ধরনের রোগীদের নিয়ে কোনো অবহেলা করা যাবে না। ডেঙ্গু আক্রান্ত হলেই দ্রুত হাসপাতলে ভর্তি হতে হবে। কোনো ক্রমেই দোকান থেকে নিজের মতো করে ওষুধ কিনে খাওয়া যাবে না। এই সময় প্যারাসিটামলের বাইরে অন্য কোনো ওষুধ খাওয়া যাবে না। তিনি বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার তিনদিন পর পরীক্ষা করলে কিন্তু ডেঙ্গুর রেজাল্ট কমে যায়। চার-পাঁচ দিন পরে করলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি বোঝা যায় না। তাতে একটা সমস্যা হবে। ডেঙ্গুর লক্ষণ থাকলে সিবিসি পরীক্ষা করাতে হবে। তখন প্লাটিলেট জানা যাবে। প্লাটিলেট এক লাখের নিচে থাকলে ধরে নেবেন এটা ডেঙ্গু পজেটিভ। তখন ডেঙ্গু হিসেবে চিকিৎসা করাতে হবে।

এখন ডেঙ্গুর দায় শুধু সিটি করপোরেশনকে দিয়ে লাভ নেই জানিয়ে এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, ডেঙ্গু এখন সারাদেশে ছড়িয়ে গেছে। ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বড় বড় শহরগুলোর মধ্যে তা সীমাবদ্ধ নেই। দেশের আনাচে-কানাচে ডেঙ্গু ছড়িয়ে গেছে। এজন্য সিটি করপোরেশনকে একা দোষারোপ করে লাভ নেই। এ রোগ থেকে মুক্তির জন্য সবার সমন্বিত উদ্যোগ দরকার। তিনি বলেন, ডেঙ্গু হলে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষ ঢাকায় চিকিৎসা নিতে চলে আসে, এটা ঠিক না। ঢাকায় আসার পথে কিন্তু রোগী কোনো চিকিৎসা পান না। ফলে দেখা যায়, ঢাকায় যতো রোগী মারা যাচ্ছে, তাদের সবাই কিন্তু ঢাকার না বাইরের লোকও আছে। এ জন্য যে এলাকায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছেন, সংশ্লিষ্ট উপজেলা বা জেলা হাসপাতালে ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিতে হবে।

ডেঙ্গুর ধরন বদলেছে জানিয়ে ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, একসময় বলা হতো মে-জুন থেকে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ডেঙ্গু হয়। এখন দেখি সারাবছরই ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যায়। সামনের দিনগুলোতে ডেঙ্গু কী হবে তা বলা যায় না। শঙ্কা বেশি ডেঙ্গু বাড়বে। তিনি বলেন, একজন মানুষের জন্য ডেঙ্গু রোগের চারবার ঝুঁকি থাকে। কেউ যদি প্রথমবার আক্রান্ত হয়, অতটা সিরিয়াস হয় না। অনেক ক্ষেত্রে রোগী নিজেই জানে না। নরমাল সর্দি-কাশি জ্বরে ইনফ্লুয়েঞ্জার মনে করে ভালো হয়ে যায়। কিন্তু দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থ সময় যদি ডেঙ্গু হয় তাহলে সিরিয়াস হয়ে যায়। এমন রোগীদের জন্য জরুরি হচ্ছে ডেঙ্গুকে অবহেলা না করা। এটি সবার জন্য জানা জরুরি। তবে চারবার ডেঙ্গু হয়ে গেলে আর কারো ডেঙ্গু হয় না।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশে (আইসিডিডিআরবি) ডেঙ্গু টিকার ট্রায়াল পরিচালনা করছে জানিয়ে ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, ডেঙ্গু টিকা বা মেডিসিন চূড়ান্ত পর্যায়ে নিতে আরও হয়তো বছর দুই-তিনেক লাগবে। আইসিডিডিআরবি বলেছে, এ টিকা সিঙ্গেল ডোজই অনেক কাজ করে। এটি করার জন্য আমাদের আরো কিছু কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে।

এডিস মশাকে ডোমেস্টিক মশা বলা হয় জানিয়ে ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, এ মশা সুন্দর সুন্দর ঘর-বাড়ি, দালান-কোঠায় জন্মায়। বাইরে যখন আমরা ডাব খাই, খেয়ে খোসা ফেলে রাখি সেখানে মশা ডিম পাড়ে। পরিত্যক্ত পাত্রে মশা জন্মায়। ঘরের ভেতর ফ্রিজের নিচে, এসির পানিতে মশা জন্মায়। তাই এ মশা নিজেদেরই মারতে হবে। এ জন্য সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। কোথাও যেন পানি জমে না থাকে। তিনি বলেন, কোনো পাত্রে পাঁচ দিনের বেশি পানি জন্মালে মশা জন্মাবে। ছুটিতে গেলে ঘরে তালা মেরে গেল কমোডের পানিতে মশা জন্মায়। নিজের ঘরবাড়ি দায়িত্ব নিজেকে নিতে হবে। সিটি করপোরেশনের লোক তো আর ঘরে গিয়ে মশা নিধন করবে না। এটা সম্ভব না এবং বাস্তব সম্মতও না। সিটি করপোরেশনের এতো কর্মীবাহিনীও নেই। নিজের ঘরবাড়ি এবং আঙিনা নিজেকে পরিষ্কার করতে হবে।

দেশে পুরুষের তুলনায় ডেঙ্গুতে নারীদের মৃত্যু বেশি হচ্ছে জানিয়ে এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, নারীরা ডেঙ্গুকে গায়ে লাগায় কম। সব সময় নিজের পরিবার নিয়ে ব্যস্ত থাকে। নিজের দিকে নজরটা কম দেয়। সামান্য জ্বর পাত্তাই দেয় না। আবার খাওয়া-দাওয়াতে কোনো গুরুত্ব থাকে না। অন্যদিকে, নারীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। তারা বাসায় বাইরে তেমন বের হয় না। ভিটামিন ডি এর অভাব থাকে। তিনি বলেন, আজকাল সংক্রামক ব্যাধি ক্রমেই কমে যাচ্ছে। ম্যালেরিয়া, বিভিন্ন ধরনের ফক্স, হাম, রুবেলাসহ অনেক রোগী এখন কম। ভ্যাকসিন কার্যক্রম সঠিকভাবে হওয়াতে এসব রোগ কমছে। উল্টো দিকে এখন অসংক্রামক রোগ বেড়ে যাচ্ছে। যেমন, মানুষের ডায়াবেটিস, হাইপ্রেসার, ওজন বেড়ে যাচ্ছে। বয়স্কদের রোগ বালাই বেড়ে যাচ্ছে। এ ধরনের রোগ কিন্তু এখন সারা পৃথিবীতে এক ধরনের সমস্যা। জীবনযাত্রার পরিবর্তন এর মূল কারণ। আমাদের খাদ্যাভ্যাস তালিকা পরিবর্তনের বড় কারণ। সুস্থ থাকতে হলে শারীরিক পরিশ্রমের বিকল্প নেই।

এমএমএ/এসএনআর/জিকেএস