ভিডিও EN
  1. Home/
  2. স্বাস্থ্য

হার্টের রোগীর চাপ বাড়ছে ঢাকায়, বাড়ছে না চিকিৎসার পরিসর

আবদুল্লাহ আল মিরাজ | প্রকাশিত: ০৫:২৭ এএম, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • কার্ডিয়াক ইন্টারভেনশনের ব্যবস্থা মাত্র ১০ হাসপাতালে
  • হার্টের রোগে বছরে মৃত্যু পৌনে ৩ লাখ
  • হার্টের চিকিৎসা এখনো ঢাকাকেন্দ্রিক, রোগীরা নিরুপায়
  • প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাড়াতে হবে চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা

জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের শিশু কার্ডিয়াক ওয়ার্ড-২ এর বি-৭ নম্বর বেডে মায়ের কোলে শুয়ে ছিল ছয় মাস বয়সী শিশু আয়ান। তার মা আসকিনা জানান, আয়ানের জন্মের দুমাস পর হার্টে ছিদ্র ধরা পড়ে। ওষুধ চলছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, বয়স এক থেকে দেড় বছর হলে হার্টে অপারেশন করাতে হবে। তাদের বাড়ি কুমিল্লায়। হঠাৎ ছেলের অবস্থা খারাপ হওয়ায় তাকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসকরা ঢাকায় পাঠিয়ে দেন। আইসিইউতে তিনদিন রাখার পর আয়ানের অবস্থা এখন কিছুটা ভালো।

দেশে ভয়াবহ আকারে বাড়ছে অসংক্রামক রোগ। বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর ৬৩ শতাংশই হয় নানাবিধ অসংক্রামক ব্যাধিতে। এর মধ্যে শুধু হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বছরে দুই লাখ ৭৩ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। এর অন্যতম কারণ সঠিক সময়ে ব্যয়বহুল এই চিকিৎসা না পাওয়া। রোগটির উন্নত চিকিৎসায় ৮০ শতাংশ রোগীর একমাত্র ভরসা রাজধানীর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল।

চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি হলেও দেশে হৃদরোগের চিকিৎসার সুযোগ এখনো খুবই সীমিত। এ রোগের চিকিৎসায় সারাদেশে সরকারিভাবে কার্ডিয়াক ইন্টারভেনশনের ব্যবস্থা রয়েছে মাত্র আটটি মেডিকেল কলেজে। আর বেসরকারিভাবে দুটি হাসপাতালে এ ব্যবস্থা রয়েছে। একই অবস্থা সার্জারির ক্ষেত্রে। ঢাকার বাইরে সরকারিভাবে শুধু একটি মেডিকেল কলেজ এবং বেসরকারিভাবে চারটি হাসপাতালে কার্ডিয়াক সার্জারির ব্যবস্থা রয়েছে।

আজ ২৯ সেপ্টেম্বর, বিশ্ব হার্ট দিবস-২০২৪। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও গুরুত্ব সহকারে দিবসটি পালন করা হচ্ছে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘ইয়েস, ইউজ হার্ট ফর অ্যাকশন’ অর্থাৎ ‘হৃদয় দিয়ে হৃদরোগ প্রতিরোধের জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করতে হবে’।

আরও পড়ুন

এ প্রতিপাদ্যে জনসচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি সবাইকে হৃদযন্ত্রের যত্ন নিতে সাহায্য করা এবং তাদের সক্ষমতা বাড়ানার আহ্বান জানানো হয়েছে। সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধিরা হৃদরোগকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলছেন। দিবসটি উপলক্ষে সরকারি ও বেসরকারিভাবে আলোচনা সভা, র‌্যালি ও বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালিত হবে। এরই অংশ হিসেবে রোববার বেলা ১১টায় গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান (প্রজ্ঞা) ‘উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগ ঝুঁকি’ শীর্ষক ওয়েবিনারের আয়োজন করেছে। দুপুর ১টায় এভারকেয়ার হাসপাতালে অনুষ্ঠিত হবে পেসেন্ট ফোরাম।

ঢাকার বাইরে চিকিৎসা সুবিধা খুবই কম

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে হৃদরোগের বিশ্বমানের সেবা রয়েছে। কিন্তু সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠেছে ঢাকাকেন্দ্রিক। যার সামর্থ্য আছে, সে চিকিৎসা নিতে পারছে। যার সামর্থ্য নেই, সে নিতে পারছে না। দেশে যে চিকিৎসা আছে, সেখানে এনজিওগ্রাম, রিং পরানো, বাইপাস সার্জারি সবই শহরকেন্দ্রিক। প্রত্যন্ত অঞ্চলে সেগুলোর সুযোগ-সুবিধা নেই। এমনকি সারাদেশে ক্যাথল্যাবের ৭১ ও সিসিইউর ৫৭ শতাংশই ঢাকায়।

তারা বলছেন, কাগজে-কলমে ঢাকাসহ সাত জেলায় পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার কথা বলা হলেও ঢাকা ছাড়া বাকি ছয় জেলায় হৃদরোগের চিকিৎসা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি বেশিরভাগ সময় নষ্টই থাকে। এ কারণে রোগীরা চিকিৎসা বঞ্চিত হচ্ছেন। অন্যদিকে, সারাদেশে হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীর অস্বাভাবিক চাপ বাড়ছে রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে। এ রোগের চিকিৎসাও যথেষ্ট ব্যয়বহুল। ফলে উচ্চবিত্তদের বড় একটি অংশ দেশে চিকিৎসা না নিয়ে চলে যাচ্ছেন বিদেশে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকার বাইরে শুধু চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ এবং বেসরকারিভাবে চারটি হাসপাতালে কার্ডিয়াক সার্জারির ব্যবস্থা রয়েছে। অন্যদিকে, সরকারিভাবে কার্ডিয়াক ইন্টারভেনশনের (রিং ও স্ট্যান্ট বসানো) ব্যবস্থা রয়েছে আটটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। আর বেসরকারিভাবে রয়েছে দুটি হাসপাতালে।

দেশে হৃদরোগের বিশ্বমানের সেবা রয়েছে। কিন্তু সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠেছে ঢাকাকেন্দ্রিক। যার সামর্থ্য আছে, সে চিকিৎসা নিতে পারছে। যার সামর্থ্য নেই, সে নিতে পারছে না

ঢাকার বাইরের রোগীদের চাপ সামলাতে সরকার ২০১৯ সালে আট বিভাগে বিশেষায়িত হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলেও এখনো তা আলোর মুখ দেখেনি। অথচ প্রকল্প নেওয়ার সময় বাস্তবায়নের মেয়াদকাল ছিল তিন বছর। এখন জানা যাচ্ছে, এ মেয়াদ ২০২৫ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।

ঢাকার বাইরে বেসরকারিভাবে কার্ডিয়াক সার্জারি হয় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতাল, ইমপেরিয়াল হাসপাতাল ও এভারকেয়ার হাসপাতাল। বেসরকারিভাবে সিলেট ও সিরাজগঞ্জে রয়েছে এই সার্জারির ব্যবস্থা। এছাড়া সরকারিভাবে পুরোনো আটটি মেডিকেল হাসপাতালে কার্ডিয়াক ইন্টারভেনশনের ব্যবস্থা রয়েছে।

এই আটটি হাসপাতাল হলো- রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, খুলনা আবু নাসের মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, দিনাজপুরে এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। বেসরকারিভাবে দিনাজপুরে জিয়া হার্ট ফাউন্ডেশন ও সিলেটে একটি বেসরকারি হাসপাতালে এ ব্যবস্থা রয়েছে।

হাসপাতাল পরিস্থিতি
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালের পরিসংখ্যান বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালে ১ হাজার ২৫০ শয্যার হাসপাতালটির জরুরি বিভাগে ৯৫ হাজার ২৪ জন ও বহির্বিভাগে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৭৯৬ রোগী চিকিৎসা নেন। ২০২১ সালে এ সংখ্যা বেড়ে জরুরি বিভাগে ১ লাখ ১৫ হাজার একজন এবং বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেন ১ লাখ ৫০ হাজার ৪৯৯ জন।

পরের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে রোগী আরও বেড়ে জরুরি বিভাগে ১ লাখ ৩১ হাজার ৯০৩ জন এবং বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেন ১ লাখ ৮৭ হাজার ৬৪৮ জন। গত বছরের (২০২৩ সালের) জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত জরুরি বিভাগে ৯৬ হাজার ৯৭ জন ও বহির্বিভাগে ১ লাখ ৩২ হাজার ৪১৩ চিকিৎসা নিয়েছেন। এছাড়া এসময় আন্তঃবিভাগে ভর্তি হয়েছেন ৬৩ হাজার ৬১১ জন ও চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ৫১১ জন হৃদরোগী।

বাড়াতে হবে চিকিৎসার পরিসর
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. ওয়াদুদ চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, হৃদরোগ চিকিৎসার পথিকৃৎ প্রতিষ্ঠানটি শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত। এখানে যেসব চিকিৎসক ও শিক্ষক আছেন এবং ছিলেন, তারা দেশের কার্ডিওলোজি চিকিৎসার অভিভাবক। কিন্তু সেটা অনেকে ভুলতে বসছেন। বর্তমানে সারাদেশে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে পরিচিত ১ হাজার ১০০ জনের মতো কার্ডিওলোজিস্ট এবং ২৫০ জনের মতো কার্ডিয়াক সার্জন রয়েছেন।

আরও পড়ুন

তিনি আরও বলেন, ঢাকার বাইরেও হৃদরোগের চিকিৎসা আছে, তবে রোগীদের চাহিদা অনুপাতে কম। দিন শেষে রোগীরা ঢাকাতেই আসছেন। ১ হাজার ২৫০ শয্যার হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে গড়ে ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ রোগী ভর্তি থাকছেন। প্রায় সমান সংখ্যক রোগী প্রতিদিন হাসপাতালটির জরুরি ও বহির্বিভাগে ভিড় করছেন। ঢাকার বাইরে কার্ডিওলোজি চিকিৎসা আশানুরূপ উন্নতি না হওয়ায় এমনটা হচ্ছে।

জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের সদ্য সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দিন বলেন, শুধু একটা ইনস্টিটিউটের ওপর ভরসা করলে কোনোদিনও হার্টের চিকিৎসার উন্নতি করা সম্ভব নয়। হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে সবসময় ভিড় ছিল, এখনো হচ্ছে। এর কারণ রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, বরিশাল, খুলনার হাসপাতালগুলোতে জনবল এবং সরঞ্জাম কমবেশি থাকলেও সার্জারি চিকিৎসা যথাযথভাবে হচ্ছে না।

দিন শেষে রোগীরা ঢাকাতেই আসছেন। ১ হাজার ২৫০ শয্যার হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে গড়ে ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ রোগী ভর্তি থাকছেন। প্রায় সমান সংখ্যক রোগী প্রতিদিন হাসপাতালটির জরুরি ও বহির্বিভাগে ভিড় করছেন

‘হার্টের রোগীদের দ্রুত সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হলে ঢাকার পাশাপাশি বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে হার্টের উন্নতি সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, হৃদরোগের বড় কারণ হচ্ছে তামাকের ব্যবহার, কায়িক পরিশ্রম না করা, অস্বাস্থ্যকর চর্বি, ক্যালরিযুক্ত খাদ্যগ্রহণ, লবণ বেশি খাওয়া এবং ওজন অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়া। এসব কারণে উচ্চ রক্তচাপ অথবা ডায়াবেটিস হচ্ছে। যাদের এই রোগ হচ্ছে তাদের ইস্কেমিক হার্ট ডিজিজ বেশি হচ্ছে। যারা ধূমপান করছে তাদের এই ঝুঁকি দ্বিগুণ।

‘উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তদের হার্ট ফেইলিউর ও হার্ট অ্যাটাক চার থেকে দশগুণ পর্যন্ত বেড়ে যাচ্ছে। যা অকালমৃত্যুর বড় কারণ। তামাকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ এবং উচ্চ রক্তচাপজনিত হৃদরোগ প্রতিরোধে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে’ যোগ করেন ডা. মীর জামাল উদ্দিন।

এএএম/এমকেআর