ভিডিও EN
  1. Home/
  2. স্বাস্থ্য

প্রজনন স্বাস্থ্যে প্রভাব

জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর দাম বাড়ায় কমছে ব্যবহার

আবদুল্লাহ আল মিরাজ | প্রকাশিত: ১১:০৩ এএম, ১১ জুলাই ২০২৪

যৌন সম্পর্কের সবচেয়ে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যঝুঁকিহীন উপায় কনডম ব্যবহার। কিন্তু বাংলাদেশে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও সরবরাহ সংকটকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে কনডমের দাম প্রায় দ্বিগুণ বাড়ানো হয়েছে। পণ্যটির অস্বাভাবিক দাম বাড়ায় এর ব্যবহার কমিয়ে প্রাকৃতিক উপায়ের দিকে ঝুঁকতে পারে মানুষ, এমন আশঙ্কা করা হচ্ছে। আর সেটি হলে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ বাড়তে পারে। এর পাশাপাশি অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভপাত বৃদ্ধি এবং যৌনরোগ বিস্তারের আশঙ্কাও করছেন জনসংখ্যা ও জনস্বাস্থ্যবিদরা। সরকারিভাবে এখন এসব সামগ্রী আরও সহজলভ্য করার পরামর্শ তাদের।

জনশুমারি ও গৃহগণনার ২০২২-এর ভিত্তিতে চলতি বছরের ১ জানুয়ারির তথ্যে বাংলাদেশে বর্তমানে প্রাক্কলিত মোট জনসংখ্যা ১৭ কোটি ১৫ লাখ ৯০ হাজার। ১৯৭৪ সালে দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ২ দশমিক ৬৪, যা ২০২২ সালে কমে ১ দশমিক ২২ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে করোনাকালীন পরিবার পরিকল্পনা ব্যবস্থা সামগ্রীর সরবরাহ কমে যায়। এতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কিছুটা বাড়তে পারে বলে মনে করে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর।

বর্তমান বিশ্বের জনসংখ্যা প্রায় ৮০০ কোটিতে পৌঁছেছে। ১৯৮৭ থেকে ২০২৪ সাল মাত্র ৩৬ বছরে বিশ্বে জনসংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৩০০ কোটি। এ পরিস্থিতিতে আজ বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। ১৯৮৭ সালের ১১ জুলাই বিশ্বের জনসংখ্যা ৫০০ কোটিতে উপনীত হয়। এ প্রেক্ষাপটে ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের তৎকালীন গভর্নিং কাউন্সিল জনসংখ্যাবিষয়ক ধারণার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে।

কনডমের দাম অনেক বেড়ে গেছে। যে কারণে খুচরা পর্যায়ে বিক্রি কমেছে। যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে এখন খাবার বড়ি ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে। দেশে তেমনভাবে কনডম উৎপাদন না হওয়ায় বিদেশ থেকে এসব পণ্য আমদানি করতে হয়। ডলারের দাম বাড়ায় কনডমের দামও বেড়েছে

এরপর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৪৫/২১৬ নম্বর প্রস্তাব পাসের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে বিশ্বে প্রতি বছর ১১ জুলাই বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত আসে। ‘পরিবেশ ও উন্নয়নের সঙ্গে জনসংখ্যার সম্পর্ক’ বিষয়টি সমন্বয়ের তাগিদ থেকেই পরবর্তীকালে বিশ্বব্যাপী একযোগে আনুষ্ঠানিকভাবে এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।

এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক উপাত্ত ব্যবহার করি, সাম্যের ভিত্তিতে সহনশীল ভবিষ্যৎ গড়ি’। এ বছর দিবসটির লক্ষ্য বিশ্বের মোট জনসংখ্যার সঠিক তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণ ও প্রতিটি মানুষের অধিকার নিশ্চিত করা। এর মধ্যে উপজাতি, অক্ষম, তৃতীয় লিঙ্গ বা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর তথ্যও যেন সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হয়, তার ওপরও জোর দেওয়া হচ্ছে।

আরও পড়ুন

জানা যায়, বাংলাদেশে যেসব কনডম পাওয়া যায় সেগুলোর অধিকাংশই দেশে তৈরি হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মালয়েশিয়া থেকে এসব পণ্য এনে দেশের বাজারে সরবরাহ করা হয়। রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন ফার্মেসি ঘুরে দেখা যায়, বাজারে এসএমসির কনডমের চাহিদাই সবচেয়ে বেশি। তবে এ কোম্পানির কনডমের দাম বেড়েছে দ্বিগুণ। এছাড়া ফার্মেসিগুলোর বেশিরভাগ কনডমই মালয়েশিয়া থেকে আমদানি করা। এছাড়া ভারত ও চীন থেকেও কিছু কনডম আমদানি হয়।

বাজার বিশ্লেষণে তিনটি কনডমের একটি বক্সের দাম হিসাব করে দেখা যায়, কোরাল কনডমের দাম আগে ছিল ৩৫ টাকা, যা বর্তমানে বেড়ে ৬০ টাকা হয়েছে, ক্যারেক্স কনডম ১৫ থেকে ২৫ টাকা, সেনসেশন ২৫ থেকে ৪০ টাকা, ডিউরেক্স ১০০ থেকে ১২৫ টাকা, প্যানথার ১৫ থেকে ২৫ টাকা, এক্সট্রিম ৭০ থেকে ৯০ টাকা, ইউঅ্যান্ডমি ৩৫ থেকে ৭০ টাকা। ভারত থেকে আমদানি করা ম্যানফোর্সের আগের দাম ছিল ৭০ টাকা, যা এখন বেড়ে ১৩০ টাকা। প্রাণ-আরএফএলের টাইগার কনডমের আল্ট্রা থিনের দাম আগের মতোই ৬০ টাকায় রয়েছে। তবে টাইগার রেগুলার কনডমের দাম ৩০ থেকে বেড়ে হয়েছে ৪০ টাকা।

জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর দাম বাড়ায় কমছে ব্যবহার, প্রজননে প্রভাব

জেড হক ফার্মা ও ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের স্বত্বাধিকারী নাজমুল জাগো নিউজকে জানান, কনডমের দাম অনেক বেশি বেড়ে গেছে। যে কারণে খুচরা পর্যায়ে বিক্রি কমেছে। যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে আগে অনেকে কনডম ব্যবহার করলেও এখন খাবার বড়ি ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে। কনডমের দাম বাড়ায় খাবার বড়ির চাহিদা ও বিক্রি বেড়েছে। দেশে তেমনভাবে কনডম উৎপাদন না হওয়ায় বিদেশ থেকে এসব পণ্য আমদানি করতে হয়। ফলে ডলারের দাম বাড়ায় কনডমের দামও বেড়ে গেছে।

তিনি বলেন, কনডমের দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে খুচরা পর্যায়ে বা সাধারণ মানুষের ব্যবহারে। বেশি দামের কনডম যেমন ১৫০ থেকে শুরু করে ৩০০ টাকায় একটি কনডমও অনেকে কেনেন। তবে এ ধরনের ক্রেতার সংখ্যা একেবারেই কম। বেশিরভাগ ক্রেতাই কম বা মাঝারি দামের কনডম কিনে থাকেন।

আমার তিন সন্তান। অভাবের সংসারে আর সন্তান নেওয়ার ইচ্ছে নেই। আগে নিয়মিত কনডম ব্যবহার করতাম। শুনেছি, বিনামূল্যে সরকারি কনডম দেওয়া হয়। কিন্তু কিছু কারণে সেখান থেকে নেওয়া হয় না। দোকানেও অনেক দাম। তাই এখন কনডম ব্যবহার কমিয়ে দিয়েছি। তবে সচেতন থাকি যেন গর্ভধারণ না হয়।- রিকশাচালক কাসেম

সাইফুল নামের একজন চাকরিজীবী রাজধানীর একটি দোকানে যান কনডম কিনতে। সেখানেই কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে জানান, কনডমের অতিরিক্ত দাম বাড়ায় তিনি ব্যবহার কমিয়েছেন। ঘরে কনডম রাখলেও অনেক সময় প্রাকৃতিকভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। সাইফুল বলেন, আমাদের বন্ধুমহলেও অনেকের কাছে শুনেছি এ বিষয়ে (প্রাকৃতিকভাবে নিয়ন্ত্রণ)। আবার অনেকে কনডম ব্যবহার না করে খাবার বড়িও ব্যবহার করছেন।

আরও পড়ুন

রাজধানীর উত্তর বাড্ডা এলাকার রিকশাচালক কাসেম বলেন, আমার তিন সন্তান। অভাবের সংসারে আর সন্তান নেওয়ার ইচ্ছে নেই। আগে নিয়মিত কনডম ব্যবহার করতাম। শুনেছি বিনামূল্যে সরকারি কনডম দেওয়া হয়। কিন্তু কিছু কারণে সেখান থেকে নেওয়া হয় না। দোকানেও অনেক দাম। তাই এখন কনডম ব্যবহার কমিয়ে দিয়েছি। তবে সচেতন থাকি যেন গর্ভধারণ না হয়।

‘আমাদের রিকশাচালকদেরই অনেকে যৌনকর্মীদের কাছে যায়, অনেক টাকা-পয়সা নষ্ট করে। কিন্তু তারা কনডম ব্যবহারের ক্ষেত্রে সচেতন। তারা বেশিরভাগ সময় তুলনামূলক দামে কম যেমন- টাইগার, প্যানথার এসব কনডম ব্যবহার করে’- বলেন কাসেম।

সন্ধ্যা হলেই ফার্মগেটে দেখা মেলে ভাসমান যৌনকর্মীদের। তাদেরই একজন সাহেরা (ছদ্মনাম)। কথা হলে জাগো নিউজকে জানান, খদ্দেরদের কনডম ব্যবহারের বিষয়টি তিনি খুবই গুরুত্ব দেন। প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে তিনি কারও কাছে যান না। তবে অনেক খদ্দেরই কনডম ব্যবহারে অনীহা দেখায়। এক্ষেত্রে তিনি নিজের সঙ্গেই কনডম রাখেন, যেন ঝুঁকিমুক্ত থাকা যায়।

সরকারের দলিল জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৭-১৮ অনুযায়ী, দেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবহার সামগ্রীর ৪৫ শতাংশ বিক্রি হয় ফার্মেসিতে, সরকার দেয় ৪৪ শতাংশ আর ৫ শতাংশ সরবরাহ করে বিভিন্ন এনজিও।

কনডমের বিকল্প হিসেবে দীর্ঘদিন খাবার বড়ি ও ইনজেকশন নিলে সন্তান জন্মদানের সামর্থ্য কমতে পারে। এখন তো স্বামী-স্ত্রীরা চাইলে সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে অনেক ভালো মানের কনডম বিনামূল্যেই নিতে পারেন। ডা. মঞ্জুর হোসেন

জরিপের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনার অপূর্ণ চাহিদা, অর্থাৎ দরকার থাকলেও প্রয়োজন অনুসারে না পাওয়ার হার ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোরী মায়েদের মধ্যে সাড়ে ১৫ শতাংশ। এর গড় হার ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সীদের মধ্যে ১২ শতাংশ।

কনডমের মূল্যবৃদ্ধি জনসংখ্যার ভারসাম্যে কোনো প্রভাব ফেলবে কি না- জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের চেয়ারম্যান আবু হাসনাত মো. কিশোয়ার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশে স্বল্পআয়ের মানুষ অনেক বেশি। তাদের মাঝে কনডমের অতিরিক্ত দামের প্রভাব পড়বেই। অনেকে অতিরিক্ত দামের কারণে প্রাকৃতিক উপায় ব্যবহার করবে। এতে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে অনেকে স্বেচ্ছায় গর্ভপাত করিয়ে থাকে। এছাড়াও নানা সমস্যা তো বাড়বেই।

জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর দাম বাড়ায় কমছে ব্যবহার, প্রজননে প্রভাব

আরও পড়ুন

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কিশোর-কিশোরী ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মো. মঞ্জুর হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, সরকারিভাবে ১০ পয়সা নামেমাত্র দামে কনডম দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের ফ্যাসিলিটিতে এসে কনডম নেওয়ার হার অনেক কম। আমাদের কনডমের ঘাটতি কখনোই ছিল না। কিন্তু মানুষের মাঝে লজ্জাবোধ এবং নানা কারণে তাদের এ সেবা নেওয়ার হার অনেক কম। সেবা নেওয়ার হার বাড়াতে অধিদপ্তর অনেক উদ্যোগ নিয়েছে৷ গ্রামে মাঠকর্মীরা জনে জনে গিয়ে তথ্য দিয়ে আসে।

তিনি বলেন, সাধারণ মানুষ যেহেতু বাইরে থেকে কনডম কেনে সেক্ষেত্রে দাম বৃদ্ধি কনডমের ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রভাব তো ফেলবেই। দাম বাড়লে চাহিদা কমা তো স্বাভাবিক। কিন্তু শারীরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কনডমের ব্যবহার কমলে যৌনরোগ বিস্তারলাভ করতে পারে। কনডমের বিকল্প হিসেবে দীর্ঘদিন খাবার বড়ি ও ইনজেকশন নিলে সন্তান জন্মদানের সামর্থ্য কমতে পারে। এখন তো স্বামী-স্ত্রীরা চাইলে সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে অনেক ভালো মানের কনডম বিনামূল্যেই নিতে পারেন।

‘আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে এসেও যে কোনো দম্পতি বিনামূল্যে কনডম নিয়ে যেতে পারেন। তবে যে কাউকে দিলে তারা বাইরে নিয়ে বেশি দামে বিক্রি করে দিতে পারেন, সে দিকটিও খেয়াল রাখতে হবে’- বলেন ডা. মঞ্জুর।

এএএম/এমকেআর/এএসএম