ডেঙ্গুতে নাকাল হয়েই পার ২০২৩, ছিল না কার্যকর উদ্যোগ
মৃত্যুর কাছে জীবন সঁপে দেওয়া বলতে যা বোঝায়, ডেঙ্গু আতঙ্কে ঢাকাবাসীর ২০২৩ সালের উল্লেখযোগ্য সময় গেছে তেমন। এবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যু অতীতের সব রেকর্ড ছাড়ায়। ঢাকার রোগ হিসেবে পরিচিত ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ে দেশের গ্রামগঞ্জে। মৌসুমি রোগ হিসেবে পরিচিত হলেও ডেঙ্গুর দাপট এবার দেখা যায় প্রায় বছরজুড়েই। এমন অবস্থার মধ্যেও চোখে পড়েনি কার্যকর কোনো পদক্ষেপ।
সব মিলিয়ে ডেঙ্গু নিয়ে সারাদেশেই এক ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। উঠে আসে স্বাস্থ্য খাতের নানান সীমাবদ্ধতা। সংকট দেখা দেয় স্যালাইনের। এর সুযোগ নেন কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। দেখা দেয় আইসিইউ সংকট। দাম বেড়ে যায় ডাবসহ অন্যান্য ফল-পথ্যের।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা মনে করেন, অতীতেও ডেঙ্গু মানুষকে নাজেহাল করেছে। তবে এ রোগের প্রকোপ থেকে বাঁচতে নেওয়া হয়নি যথাযথ ব্যবস্থা। অন্যদিকে এ রোগের জন্য দায়ী এডিস মশা থেকে নিস্তার পেতে নেওয়া হয়নি কোনো জাতীয় পরিকল্পনা।
অতীতের সব রেকর্ড ছাড়ায়
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে, ১ জানুয়ারি থেকে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন মোট তিন লাখ ২০ হাজার ৮৩৫ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা এক লাখ ৯ হাজার ৮৯৯ জন, আর ঢাকার বাইরের দুই লাখ ১০ হাজার ৯৩৬ জন। ঢাকার তুলনায় ঢাকার বাইরে সংক্রমণ ছিল প্রায় দ্বিগুণ।
আরও পড়ুন>> ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সরকার যথাসময়ে পদক্ষেপ নেয়নি, মানুষও ছিল অসচেতন
ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এ বছর মারা গেছেন ১ হাজার ৬৯৯ জন। তবে মারা যাওয়া রোগীদের বেশির ভাগ ছিল ঢাকায়।
এর আগে ২০২২ সালে ডেঙ্গু ২৮১ জন মারা যান। গত বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৬২ হাজার ৩৮২ জন। এর আগে ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় ২০১৯ সালে, ১৭৯ জনের। এবার সব রেকর্ড ভাঙে।
স্যালাইন সংকট, আমদানি হয় ভারত থেকেও
ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে স্যালাইন। চিকিৎসকদের মতে, ডেঙ্গু রোগীদের শক সিন্ড্রোমে যাওয়ার আগেই ফ্লুয়িড ম্যানেজমেন্ট করাটা জরুরি। ডেঙ্গুর প্রকোপের সময় এ রোগীদের চিকিৎসায় স্যালাইনের সংকট দেখা দেয়। সংকটকালে ঢাকার ফার্মেসিগুলো ঘুরে পাওয়া যায়নি স্যালাইন। আর এ সুযোগে মানুষের পকেট কেটেছেন কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। উৎপাদনের চেয়ে চাহিদা বেশির অজুহাতে অনেকে রোগীদের কাছে ১০০ টাকার স্যালাইন বিক্রি করেছেন ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায়। দেশের এ সংকট মোকাবিলায় সরকার ভারত থেকে স্যালাইন কিনে আনে। তবে শীতকাল আসায় ধীরে ধীরে ডেঙ্গুর সংক্রমণ কমার সঙ্গে কমে সংকট।
আরও পড়ুন>> কিউলেক্স মশা নিধনে খাল-জলাশয় পরিষ্কার করছে ডিএনসিসি
চরম সংকটের মধ্যে আলোচনায় আসে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের স্যালাইন উৎপাদন বন্ধের বিষয়। এছাড়া এসেন্সিয়াল ড্রাগসের স্যালাইন উৎপাদনের বিষয়টিও আসে আলোচনায়। তবে সেসব আলোচনার শেষ ফলাফল চোখে পড়ার মতো নয়।
মৌসুমি রোগ এখন সারাবছর
ডেঙ্গুকে মৌসুমি রোগ হিসেবেই বিবেচনা করা হতো। বর্ষাকালে এর প্রাদুর্ভাব দেখা দিতো। বর্ষা কমলেই কেটে যেত দুর্যোগ। তবে গত বছর এবং এ বছরে পরিবর্তন হয় চিত্র। সারা বছরই দেখা মেলে ডেঙ্গুর। এ বছর জানুয়ারি থেকেই ছিল ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা যায়, দেশে জানুয়ারিতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল ৫৬৬ জন। এরপর ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬ জন, মার্চে ১১১ জন, এপ্রিলে ১৩৬ জন রোগী পাওয়া যায়। জুন থেকে ঊর্ধ্বগতির দিকে ওঠে ডেঙ্গু। জুনে আক্রান্ত হয় ৫ হাজার ৯৫৬ জন। এরপর জুলাই মাসে ৪৩ হাজার ৮৮৫৪ জন ও আগস্টে আক্রান্ত হয় ৭১ হাজার ৯৭৬ জন। এই বছর সবচেয়ে বেশি রোগী আক্রান্ত হয় সেপ্টেম্বরে ৭৯ হাজার ৫৯৮৮ জন। এছাড়া অক্টোবরে ৬ হাজার ৭৬৯, নভেম্বরে ৪০ হাজার ৭১৬ ও চলতি মাস ডিসেম্বরে এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ৯ হাজার জন।
এবার ১২ মাসের মধ্যে শুধু মার্চ মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়নি কারো। আর সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী মারা যায় সেপ্টেম্বরে, ৩৯৬ জন। এছাড়া জানুয়ারিতে ৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩ জন, এপ্রিলে ২, মে মাসে ২, জুন মাসে ৩৪, জুলাই মাসে ২০৪, আগস্টে ৩৪২, অক্টোবরে ৩৫, নভেম্বরে ২৭৪ ও চলতি মাস ডিসেম্বরের ২৭ তারিখ পর্যন্ত ৭৭ জন ডেঙ্গুতে মারা যায়।
আরও পড়ুন>> ডেঙ্গু প্রতিরোধে সারা বছর সচেতন থাকতে হবে: আতিক
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইইডিসিআর,বি-এর সাবেক প্রধান বিজ্ঞানী ডা. মোশতাক হোসেন বলেন, ডেঙ্গু এখন সারাবছরের রোগ। সারাবছর এ রোগের সংক্রমণ থাকে। সামনের দিনগুলোতেও এভাবেই চলবে। তবে বর্ষাকালে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা দেবে। কারণ এসময় এডিসের প্রজনন বেশি হয়ে থাকে।
ডেঙ্গুতে মৃত্যুর প্রধান কারণ শক সিন্ড্রোম
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর জানান, ডেঙ্গু রোগীর অবস্থা যত বেশি খারাপ হবে তত বেশি মৃত্যু হবে। ডেথ রিভিউতে মৃত্যুর প্রধান কারণ হিসেবে দেখা যায় দেরিতে হাসপাতালে আসা। এছাড়া আরেকটি কারণ ছিল এক্সপান্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম। যাতে ডেঙ্গু থেকে রোগীর হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে, লিভার ফেইল করছে অথবা ব্রেইন আক্রান্ত হচ্ছে। এসময় রোগীদের মৃত্যু ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়ে।
তিনি জানান, বেশিরভাগ মৃত্যু হচ্ছে ডেঙ্গু শকে। তাই আমরা চিকিৎসকদের জানিয়েছি, প্রতিদিন যদি ১০০ জন ডেঙ্গু রোগী আসে সবাইকে সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখার প্রয়োজন হয় না। এদের মধ্যে ১০ জনের যদি ডেঙ্গু শকের লক্ষণ থাকে, তাদের গুরুত্ব দিয়ে গাইডলাইন অনুযায়ী চিকিৎসা করতে হবে। এবাবে শকের রোগীদেরও শতভাগ মৃত্যু কমানো সম্ভব। ডেথ রিভিউ কমিটিকে আমরা জানিয়েছি, যাতে শকে থাকা রোগীদের বেডের ব্যবস্থা হয় এবং ২৪ ঘণ্টা অবজারভেশনে রাখা হয়।
রেহাই মেলার আশা নেই নতুন বছরে
দেশে ডেঙ্গু সংক্রমণের পরিবর্তন আগামী বছরও দেখা যাবে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, ডেঙ্গু রোধে নেওয়া হয়নি উল্লেখযোগ্য কোনো কার্যক্রম। এছাড়া রোগ ছড়িয়েছে সারাদেশেই। তাই আগামী বছর এ রোগের প্রকোপ আরও বাড়তে পারে।
ডা. মুশতাক আহমেদ বলেন, এবছর যেমন হয়েছে, নতুন বছরেও তেমনই হবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আমাদের কার্যক্রম এভাবে চলতে থাকা মানেই আমরা আমাদের নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছি না। সমন্বিতভাবে কাজ না করলে ডেঙ্গু চলতেই থাকবে।
এএএম/এমএইচআর/জেআইএম