বিশ্ব টয়লেট দিবস
সরকারি হাসপাতালের অপর্যাপ্ত টয়লেটও ব্যবহারের অনুপযোগী
# অপরিচ্ছন্ন টয়লেট নারীদের রোগের সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়
# টয়লেট ব্যবহারের পর হাত ধোয়ার ব্যবস্থা নেই অনেক হাসপাতালে
# প্রস্রাব চেপে রাখায় মূত্রনালিতে সংক্রমণ হচ্ছে
# ঘরের বাইরে নারীদের জন্য ব্যবহার উপযোগী টয়লেট নেই
স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনের অন্যতম শর্ত স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট। সাধারণভাবে বলা যায়, টয়লেট মানেই জীবাণুর কারখানা। তাই টয়লেট পরিষ্কার রাখা এবং পরিচ্ছন্নভাবে ব্যবহার করা খুবই জরুরি। কারণ, অপরিচ্ছন্ন টয়লেট থেকে হতে পারে নানান ধরনের রোগ। এসব রোগ প্রতিরোধে শুধু বাসায়ই নয়, হাসপাতালসহ সব পাবলিক প্লেসের টয়লেট পরিচ্ছন্ন রাখার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
সাধারণ মানুষ নানান রোগ-শোক নিয়ে হাসপাতালে যায়। তবে সরকারি হাসপাতালগুলোর শৌচাগারের (টয়লেট) বেহাল দশা। রাজধানীর বেশিরভাগ সরকারি হাসপাতালে নেই পর্যাপ্ত টয়লেট, নেই হাত ধোয়ার ব্যবস্থা। এর ফলে অনেকে জরুরি প্রয়োজনে হাসপাতালে গেলেও টয়লেট ব্যবহারে পড়েন বিড়ম্বনায়। পুরুষের চেয়ে নারীরা এই সমস্যায় বেশি ভোগেন। অপরিচ্ছন্ন ও নোংরা পরিবেশের টয়লেটের কারণে সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েন নারীরা।
এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব টয়লেট দিবস। শতভাগ স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতিবছর ১৯ নভেম্বর দিবসটি পালন করা হয়। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘দ্রুত পরিবর্তন’।
আরও পড়ুন: টয়লেট থেকে ছড়ায় যে ৫ কঠিন রোগের সংক্রমণ
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের তথ্যমতে, প্রতিবছর অস্বাস্থ্যকর টয়লেট ব্যবহারে দেশের দুই কোটি শিশু টাইফয়েড, জন্ডিস, কলেরা বা ডায়রিয়ার মতো রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এছাড়াও অপর্যাপ্ত টয়লেটের কারণে প্রস্রাব চেপে রাখায় মূত্রনালিতে সংক্রমণ ঘটছে। বিশেষ করে নারীরা ঘরের বাইরে গিয়ে পরিবেশ না পেয়ে জরুরি প্রয়োজনেও টয়লেট ব্যবহার করতে পারেন না। আবার পিরিয়ডকালীন প্রয়োজনে টয়লেট ব্যবহার না করলে মূত্রনালির পাশাপাশি জরায়ুতে সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। ফলে অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন জরায়ুর সংক্রমণে।
রাজধানীর ১০টি সরকারি হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগ ঘুরে দেখা যায়, এসব হাসপাতালের জরুরি বিভাগে প্রতিদিন সবমিলিয়ে প্রায় ৬ থেকে ৭ হাজার রোগী ও স্বজনরা এসে থাকেন। তাদের বড় অংশ নারী। তবে এই বিশাল সংখ্যক মানুষের জন্য টয়লেট আছে ৪১টি। এগুলোর মধ্যে আবার ১০টি তালাবদ্ধ ও ১৪টি ব্যবহার অনুপোযোগী। ফলে ব্যবহার উপযোগী আছে মাত্র ১৭টি টয়লেট। তবে টয়লেটের সঙ্গে হাত ধোয়ার বেসিন বা জায়গা আছে মাত্র দুইটি হাসপাতালে। অসংখ্য মানুষ ব্যবহার করার কারণে এসব টয়লেট প্রতি ঘণ্টায় পরিষ্কার করা প্রয়োজন। তবে প্রয়োজন অনুযায়ী পরিষ্কার না করায় সেগুলো হয়ে পড়ে নোংরা ও ব্যবহারের অনুপযোগী।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কথা হয় সাইদুল আলমের সঙ্গে। অসুস্থ মেয়ের চিকিৎসায় চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে চেম্বারের বাইরে অপেক্ষা করছিলেন। দীর্ঘসময় অপেক্ষায় থাকায় অসুস্থ মেয়ের টয়লেটে যাওয়ার প্রয়োজন পড়লে অনেক খোঁজাখুঁজি করে টয়লেট পাননি। পরে দায়িত্বরত এক আনসার সদস্যের পরামর্শে পরবর্তী ওয়ার্ডের টয়লেট ব্যবহার করেন। সেখানেও ছিল দীর্ঘ লাইন।
জাগো নিউজকে সাইদুল আলম বলেন, ছেলেদের জন্য সমস্যা একটু কম হলেও মেয়েদের জন্য এটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।
আরও পড়ুন: টয়লেট শেষে হাত পরিষ্কার না করলে যে ক্ষতি হয়
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে এখন ব্যবহারযোগ্য টয়লেট নেই বললেই চলে। ফলে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে আসা অনেক রোগী ও তাদের স্বজনরা পড়ছেন বিড়ম্বনায়। জরুরি প্রয়োজনে টয়লেট খুঁজলে ওয়ার্ডের টয়লেট দেখিয়ে দেন দায়িত্বরতরা। ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আগে যে টয়লেট ছিল, তা এখন বন্ধ বলে জানান তারা।
ঢাকা শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিটিউটে রোগী ও তাদের স্বজন মিলিয়ে প্রতিদিন আসেন ৫০০ থেকে ৬০০ জন। তবে এই হাসপাতালের জরুরি ও বহির্বিভাগ নেই কোনো টয়লেট। পুরুষরা মসজিদের সঙ্গে থাকা টয়লেট ব্যবহার করেন। তবে শিশু হাসপাতালে আসা শিশুদের সঙ্গে থাকা স্বজনদের বেশিরভাগই নারী। ফলে টয়লেট না থাকায় নারীদেরই বেশি সমস্যায় পড়তে হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের এখানে টয়লেট ছিল। এগুলো ভেঙে নতুন করে তৈরি করা হচ্ছে। এতে বেশ কিছুদিন সময় লাগতে পারে।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আছে মাত্র দুইটি টয়লেট। এর মধ্যে একটি তালাবদ্ধ, অন্যটি ব্যবহার করতে সিরিয়াল ধরে অপেক্ষা করতে হয় দীর্ঘসময়। আবার ওই টয়লেট ব্যবহার শেষে সেখানে হাত ধোয়ার জন্য কোনো বেসিন নেই।
আরও পড়ুন: টয়লেট পরিষ্কারের সঠিক উপায়
এছাড়া শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে টয়লেট আছে ৮টি। এগুলোর মধ্যে ৪টি থাকে তালাবদ্ধ, দুইটি ব্যবহার অনুপযোগী। ফলে রোগী ও স্বজনরা ব্যবহার করতে পারছেন মাত্র দুইটি।
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান- নিটোরের জরুরি বিভাগে আছে ৬টি টয়লেট। এগুলোর মাত্র দুইটি ব্যবহারযোগ্য। বাকিগুলোর দুইটি তালাবদ্ধ ও দুইটি ব্যবহার অনুপযোগী।
জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের জরুরি বিভাগে সেবা নিতে প্রতিদিন আসেন ৩০০ থেকে ৪০০ জন। এখানে টয়লেট আছে তিনটি। এর মধ্যে দুইটির দরজা ভাঙা। বাকি একটির দরজা ভালো থাকলেও ট্যাপ নষ্ট। এখানে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা থাকলেও সাবান নেই।
জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের জরুরি বিভাগে টয়লেট আছে ৮টি। এগুলোর মধ্যে দুইটি তালাবদ্ধ। বাকিগুলোর মধ্যে চারটি ব্যবহার উপযোগী।
আরও পড়ুন: টয়লেট চেপে রাখলে কী হয়?
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের জরুরি বিভাগে টয়লেট আছে ৭টি। এগুলোর একটি তালাবদ্ধ, ব্যবহার উপযোগী ৫টি।
জাতীয় কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগে টয়লেট আছে ৬টি। তবে ব্যবহার উপযোগী ৪টি।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালের জরুরি বিভাগে টয়লেট একটি। এখানে হাত ধোয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে।
এসব হাসপাতালের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিদিন দুইবার করে টয়লেট পরিষ্কার করা হয়। তবে এত মানুষের ব্যবহারে প্রতি ঘণ্টায়-ই পরিষ্কার করা প্রয়োজন।
টয়লেটের অপ্রতুলতা ও অপরিচ্ছন্নতায় হাসপাতালে আসা রোগীদের ওপর কী প্রভাব পড়তে পারে জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মুশতাক হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালগুলোতে থাকা টয়লেট নারীদের জন্য উপযোগী নয়। এতে দেখা যায়, টয়লেটের সুবিধা না থাকায় তারা হাসপাতালে এসে পানি পান করেন না বা কমিয়ে দেন। কিংবা অনেক সময় ধরে প্রস্রাব আটকে রাখেন। এতে কিডনির সমস্যা হচ্ছে। মূত্রথলির পাশাপাশি জরায়ুর ইনফেশন হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।’
তিনি বলেন, ‘অবশ্যই রোগী অনুপাতে হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত টয়লেট থাকা জরুরি। অন্যথায় চিকিৎসার জন্য এসে উল্টো রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণ হবে হাসপাতাল।’
আরও পড়ুন: টয়লেট ব্যবহারের যে ভুলে হয় প্রস্রাবে ইনফেকশন
ওয়াটার অ্যান্ড স্যানিটেশন ফর আরবান পুওরের (ডব্লিউএসইউপি) ২০১৭ সালের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় জনসংখ্যার মাত্র ৫৮ শতাংশ মানুষ উন্নত স্যানিটেশন সুবিধা পান। বাকি ৪২ শতাংশ মানুষ প্রাথমিকভাবে বাজার এবং অন্যান্য পাবলিক স্পেসে থাকা অপর্যাপ্ত পাবলিক টয়লেটের ওপর নির্ভর করেন।
এতে আরও জানা যায়, ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় ৫০ লাখ মানুষের জন্য মাত্র ১০০টি পাবলিক টয়লেট আছে। সাধারণত স্বল্প আয়ের মানুষ এসব টয়লেট ব্যবহার করেন। এদের মধ্যে রয়েছেন দোকানি, শ্রমিক, ভাসমান বিক্রেতা এবং গাড়ির চালক।
ঢাকায় সাধারণ মানুষের জন্য পাবলিক টয়লেটের প্রকল্প নিয়ে কাজ করে ভূমিজ। প্রতিষ্ঠানটির তথ্যমতে, হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও একই অবস্থা। ব্যবহারযোগ্য পাবলিক টয়লেটের সংখ্যা একটি প্রধান উদ্বেগের বিষয়। খারাপভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা পাবলিক টয়লেটগুলো প্রায়শই ব্যাকটেরিয়া এবং জীবাণুর প্রজনন ক্ষেত্র হয়ে ওঠে, যা ব্যবহারকারীদের জন্য স্বাস্থ্যের ঝুঁকির কারণ হতে পারে। সঠিক অবকাঠামো এবং ব্যবস্থাপনার অভাব শুধুমাত্র অপরিচ্ছন্নতা বাড়ায় না, বরং দুর্গন্ধের জন্যও দায়ী।
ভূমিজের সিইও ফারহানা রশিদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘সব পাবলিক টয়লেট যথাযথ ব্যবস্থাপনায় নিয়ে আসার মাধ্যমে ব্যবহারযোগ্য করা যেতে পারে। আসলে একটা পাবলিক টয়লেট তৈরির মাধ্যমেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না, এটি কেবল শুরু। পরিকাঠামো তৈরি করা এবং সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা নিশ্চিত করার জন্য সেই অনুযায়ী বাজেট বরাদ্দ দরকার। প্রশিক্ষিত ব্যক্তিদের দিয়ে রক্ষণাবেক্ষণ হলে ব্যবহারযোগ্য টয়লেটের সংখ্যা বাড়বে।’
এএএম/কেএসআর/এমএস