ভিডিও EN
  1. Home/
  2. স্বাস্থ্য

মিটফোর্ড হাসপাতাল

দেড়শো বছরের পুরোনো মর্গ যেন নিজেই মৃত

রায়হান আহমেদ | প্রকাশিত: ০৯:২৯ এএম, ১৭ নভেম্বর ২০২৩

* একজন ডোম দিয়ে চলছে ময়নাতদন্তের কার্যক্রম
* একমাত্র মর্চুয়ারিটিও নষ্ট
* মরদেহ রাখা হয় হাসপাতালের ফ্রিজে
* নেই কোনো অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি
* জীর্ণশীর্ণ ভবন

আত্মহত্যা, সড়ক দুর্ঘটনা, খুনসহ বিভিন্ন কারণে কোনো ব্যক্তির অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে সেই মরদেহের ময়নাতদন্ত করতে হয়। হাসপাতালের মর্গে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি না থাকলে ময়নাতদন্তেও মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যায় না। আধুনিক প্রযুক্তি ও দক্ষ জনবলের অভাবে ধুঁকছে দেশের বেশিরভাগ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গগুলো। উন্নত প্রযুক্তির অভাবে সেকেলে পদ্ধতিতে চলছে মরদেহের ময়নাতদন্ত। তেমনই অবস্থা রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (মিটফোর্ড হাসপাতাল) মর্গের। আধুনিক যন্ত্রপাতি, দক্ষ জনবল ও অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতায় বেহাল সেখানকার মরদেহ কাটাছেঁড়ার কার্যক্রম।

সরেজমিনে দেখা গেছে, মেডিকেল কলেজের পেছনে জীর্ণশীর্ণ দেড়শ বছরের পুরোনো একটি মর্গ। টিনশেড একটি ভবন। দেয়াল থেকে খসে পড়ছে পলেস্তারা। মর্গের মূল ফটকে নেই মজবুত গেট। চারপাশেই ঝোপ-জঙ্গল। এর ভেতরেই চলছে মরদেহ ময়নাতদন্তের কার্যক্রম। অবকাঠামোগতভাবে এমন ভঙুর হওয়ায় মরদেহের নিরাপত্তা নিয়েও শঙ্কা দেখা গেছে৷

আরও পড়ুন: আধুনিক মর্গের জন্য সুনির্দিষ্ট আইন কেন নয়: হাইকোর্ট

মর্গ সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালটিতে দীর্ঘদিন ধরেই ময়নাতদন্ত কার্যক্রমের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম নেই। নেই পোর্টেবল এক্সরে, এমআরআই, সিটি স্ক্যান মেশিন। মরদেহ রাখার জন্য মর্গে একটি মাত্র মর্চুয়ারি রয়েছে, সেটিও অনেকদিন থেকে নষ্ট। মরদেহের কাটাছেঁড়ায় হাতুড়ি, ছুরি, কাঁচিই সেখানকার প্রধান সরঞ্জাম। ময়নাতদন্ত কাজে সহায়তাকারী ডোমেরও রয়েছে স্বল্পতা। পুরো মর্গে একজন মাত্র ডোম ও সঙ্গে দুজন সহকারী। এ অবস্থায়ই বছরের পর বছর চলছে মিটফোর্ডের মর্গে মরদেহ কাটাছেঁড়ার কার্যক্রম।

আধুনিক কোনো যন্ত্রপাতিই নেই। যা আছে তা দিয়েই কাজ করি। মর্গের ভেতরে তো যাচ্ছেতাই পরিবেশ। এভাবেই কাজ চলছে। একটা মাত্র মর্চুয়ারি, সেটিও নষ্ট। ময়নাতদন্তের কার্যক্রমের জন্য অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির চাহিদা দিয়েছি তিনবার, কিন্তু এখনো তা পূরণ করা হয়নি

জানা গেছে, মর্গের একমাত্র মর্চুয়ারিটি নষ্ট থাকায় মিটফোর্ড হাসপাতালের হিমাগারে রাখতে হয় মরদেহ। অনেক সময় অজ্ঞাতপরিচয় মরদেহ এলে শনাক্তের দুই থেকে তিনদিন মর্গে রাখতে হয়। এক্ষেত্রে অনেক সময় পর্যাপ্ত মর্চুয়ারির অভাবে মরদেহ সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা যায় না। এতে মরদেহে পচন ধরে। এছাড়া মর্গে নমুনা রাখার জন্যও নেই কোনো ল্যাব। ফলে নমুনা নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।

jagonews24

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মর্গের একটি সূত্র জাগো নিউজকে জানায়, বাংলাদেশের কোনো মেডিকেলে মরদেহ শনাক্তের এক্সরে মেশিন নেই। এক্সরে মেশিন থাকলে বিশেষ করে গুলিবিদ্ধ মরদেহগুলো সহজে শনাক্ত করা যায়। কাটাছেঁড়া ছাড়াই আধুনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে মাত্র দুই মিনিটে মরদেহে থাকা বুলেটের অগ্রভাগ শনাক্ত করা যায়। সহজে ময়নাতদন্ত করা যায়। ফলে এসব যন্ত্রপাতি না থাকায় ভোগান্তিতে পড়তে হয়।

এসব সংকট নিয়ে কাজ করতে গিয়ে অনেকক্ষেত্রে সঠিক ও আইনিভাবে ময়নাতদন্তের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ময়নাতদন্ত সঠিকভাবে না হলে মৃত্যুর প্রকৃত রহস্য উদঘাটন ও অপরাধী শনাক্তে বিপাকে পড়তে হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে।

আরও পড়ুন: সামান্য বৃষ্টিতেই ময়লা পানিতে সয়লাব মর্গ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিয়া রহমান জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমান মর্গগুলোতে এখনো মান্ধাতার আমলের মত ময়নাতদন্ত চলছে। ক্রিমিনাল অ্যাক্টিভিটিজ কিন্তু দিন দিন বেড়েই চলছে। অথচ মর্গ এখন সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত জায়গা। অত্যাধুনিক মেশিন নেই, প্রয়োজনীয় সংখ্যক জনবল নেই। আধুনিক পদ্ধতি বা প্রফেশনাল অ্যাপ্রোচ কোনোটাই নেই। পুরো প্রসেসটিই এখনো সেকেলে থেকে গেছে। এখন আবার সিআইডির (পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ) ল্যাব হচ্ছে। সেখানে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয়।

জীর্ণশীর্ণ দেড়শ বছরের পুরোনো একটি মর্গ। টিনশেড একটি ভবন। দেয়াল থেকে খসে পড়ছে পলেস্তারা। মর্গের মূল ফটকে নেই মজবুত গেট। চারপাশেই ঝোপ-জঙ্গল। এর ভেতরেই চলছে মরদেহ ময়নাতদন্তের কার্যক্রম

তিনি বলেন, যে কোনো হত্যাকাণ্ডের রহস্য বা অপরাধ তদন্তে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মর্গে সে কাজটিই হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের হাসপাতালগুলোতে মর্গের কার্যক্রম খুবই খারাপ। সেখানে কোনো ধরনের প্রটোকল মানা হয় না। হত্যার কারণ যদি সঠিকভাবে উদঘাটন না হয় তবে অপরাধ বৃদ্ধিতে এর প্রভাব পড়বে।

jagonews24

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) বলছে, বিভিন্ন মামলার তদন্ত করতে গিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে দেশের মর্গ ব্যবস্থাপনা বেহাল। সম্প্রতি মর্গের এমন দুর্দশার চিত্র তুলে ধরে নির্ভুল ময়নাতদন্তের স্বার্থে পিবিআই কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়ে ১১টি সুপারিশ দিয়েছে।

আরও পড়ুন: ১২ বছর পর মর্গ পেল সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ

পিবিআই এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, মর্গগুলোতে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ, আলোর ব্যবস্থা, আধুনিক অবকাঠামো ও বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির সংকট। বর্তমানে অনেক জেলায় দিনের বেলায়ও মোমবাতি জ্বালিয়ে ময়নাতদন্ত করতে হয়। মর্গে পর্যাপ্ত দক্ষ জনবলের অভাব ও ময়নাতদন্ত বিষয়ে মর্গ সহকারী বা ডোমদের কোনো মৌলিক প্রশিক্ষণও নেই। এছাড়া ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে ব্যস্ত মর্গগুলোতে ডোম স্বল্পতাও অত্যন্ত প্রকট। মরদহে সংরক্ষণের পরিবেশ ও প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার অভাবও রয়েছে।

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গত এক বছরে এই হাসপাতালটির মর্গে ধর্ষণ সংক্রান্ত মামলায় ১৭০ জন ভুক্তভোগীর ময়নাতদন্ত করা হয়। এ বছরের চলতি নভেম্বর মাস পর্যন্ত ময়নাতদন্ত হয়েছে ৩৮২টি। ২০২২ সালে ময়নাতদন্ত হয় ৫০০টি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাসপাতালটির ফরেনসিক মেডিকেল বিভাগ থেকে আধুনিক সরঞ্জামের পাশাপাশি ইলেকট্রিক কাটার, মরদেহ বহনের ট্রলি গামবুট, ফরমালিন, কেমিক্যাল, আলামত সংগ্রহের রাসায়নিক বস্তা, কনটেইনার, উন্নতমানের ছুরি ও কাঁচিসহ ইত্যাদির জন্য বারবার চাহিদা দেওয়া হলেও এখনো মর্গের কোনো উন্নতি হয়নি।

মর্গে একটি মাত্র মর্চুয়ারি রয়েছে, সেটিও অনেকদিন থেকে নষ্ট। মরদেহের কাটাছেঁড়ায় হাতুড়ি, ছুরি, কাঁচিই সেখানকার প্রধান সরঞ্জাম। ময়নাতদন্ত কাজে সহায়তাকারী ডোমেরও রয়েছে স্বল্পতা

এ বিষয়ে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কামদা প্রসাদ সাহা জাগো নিউজকে বলেন, এক কথায় আধুনিক কোনো যন্ত্রপাতিই নেই। যা আছে তা দিয়েই কাজ করি। মর্গের ভেতরে তো যাচ্ছেতাই পরিবেশ। এভাবেই কাজ চলছে। একটা মাত্র মর্চুয়ারি, সেটিও নষ্ট। ময়নাতদন্তের কার্যক্রমের জন্য অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির চাহিদা দিয়েছি তিনবার, কিন্তু এখনো তা পূরণ করা হয়নি।

তিনি বলেন, মর্গের এই দুরবস্থা দীর্ঘদিনের। অনেক বলেছি আবেদন করেছি কোনো কাজ হয়নি। যেখানে লোকবল দরকার কমপক্ষে তিনজন, সেখানে মাত্র একজন ডোম কাজ করেন। তবুও তিনি স্থায়ী নিয়োগপ্রাপ্ত নন।

আরও পড়ুন: কাটাছেঁড়া করা মরদেহের মতোই করুণ দশা মর্গটির

অধ্যাপক কামদা প্রসাদ সাহা আরও বলেন, আমাদের শিক্ষকেরও সংকট। এ সংকটের প্রভাব কিন্তু মর্গেও রয়েছে। ফরেনসিক বিভাগে পাঁচজন শিক্ষক। যেখানে প্রয়োজন অন্তত ১৫ জন। মর্গে আমি ছাড়াও অন্য শিক্ষকদেরও যেতে হয়। আমিও সবসময় যেতে পারি না। বিভিন্ন কোর্টে খুনের মামলার সাক্ষী দিতে ছুটতে হয়।

জানা যায়, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সপ্তাহে অন্তত তিন থেকে চারটি মরদেহ আসে। বিশেষত ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) আওতাভুক্ত ১২টি থানা এলাকা থেকে মরদেহ আসে এ হাসপাতালে।

আরএএএইচ/এমকেআর/এমএস