পশুপাখির রোগ মানুষে
দেশে মুরগির মাধ্যমে সংক্রামক রোগ ছড়ানোর ঝুঁকি বেশি
বর্তমান সময়ে জনপ্রিয় খাবার মুরগির মাংস। মুখরোচক নানা খাবার যেমন- ফাস্ট ফুড, বাসাবাড়িতে রান্না-বান্না সব কিছুতেই মুরগির মাংসের ব্যবহার। এ চাহিদাকে কেন্দ্র করে দেশের আনাচে-কানাচে গড়ে উঠেছে মুরগির খামার ও দোকান। গ্রাম কিংবা শহরের বাজার, এমনকি গলিতেও রয়েছে মুরগির খুচরা দোকান। তবে খামার থেকে আনা, কয়েকবার হাতবদল হয়ে খুচরা দোকানে পৌঁছাতে গিয়ে এসব মুরগি আক্রান্ত হতে পারে নানা ধরনের ভাইরাসে।
বিজ্ঞানীদের মতে, সারা বিশ্বে মানুষের মধ্যে ছড়ানো সংক্রামক রোগের ৬০ শতাংশই সংক্রমিত হয় জীবজন্তু বা পশুপাখি থেকে। জীবজন্তুর মাধ্যমে রোগে মানুষ আক্রান্ত হলে তা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে মানুষ যেসব প্রাণীর কাছাকাছি বেশি আসে তার মধ্যে অন্যতম হাঁস-মুরগি। ফলে হাঁস-মুরগির বাজার রোগ-জীবাণুর সংক্রমণ ছড়ানোর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্থান।
মঙ্গলবার (২২ আগস্ট) রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও আশপাশ এলাকার মুরগির বাজার ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ দোকানই অপরিষ্কার, অপরিচ্ছন্ন ও গন্ধে ভরপুর। তবে টাউন হল ও কৃষি মার্কেটে মুরগির বাজারের ভবনের ভেতরে থাকা দোকানগুলো কিছুটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পাওয়া যায়। এসব দোকানে মুরগি কেটে পরিষ্কার করার জন্য পানির ব্যবস্থা রয়েছে।
এছাড়া মুরগি রাখা খাঁচাগুলো কয়েকদিন পর পর পরিষ্কার করা হয়। তবে মার্কেটের বাইরের দোকানগুলোতে দেখা যায় বেহাল দশা। দোকানের মেঝে প্রতিদিন পরিষ্কার করা হলেও খাঁচা বা আশপাশ দীর্ঘদিন অপবিচ্ছন্ন থাকে। অন্যদিকে পানি বের হওয়ার ব্যবস্থা না থাকায় মুরগির রক্ত এবং ময়লা-আবর্জনা পাশের ড্রেনে ফেলা হয়।
আরও পড়ুন: করোনাসহ বিশ্ব কাঁপানো ৭ সংক্রামক রোগ
টাউন হলের একাধিক মুরগি বিক্রেতা ও দোকার কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখানে কাজ করা বেশিরভাগ মানুষই সারাবছর ভোগেন সর্দি-কাশিজনিত রোগে। অনেকে আবার ফুসফুসের নানা রোগে আক্রান্ত। ফরেন চিকেন হাউজের এক কর্মচারী জানান, সাধারণত হালকা সর্দি-কাশি হলে অনেকে ফার্মেসি থেকে ওষুধ নিয়ে সেবন করেন। অবস্থা একটু বেশি খারাপ হলে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আউটডোরে চিকিৎসা নিয়ে আসেন। তিনি নিজেও সর্দিজনিত সমস্যায় ভুগছেন বলে জানান।
মুরগির দোকানি জুয়েল জানান, উত্তরবঙ্গ থেকে তারা মূলত দেশি মুরগি নিয়ে আসেন। সেখানে থাকা তাদের লোকজন বাড়ি বাড়ি থেকে মুরগি কিনে একসঙ্গে সেগুলো ট্রাকে পাঠিয়ে দেন। এছাড়া পাকিস্তানি মুরগি আসে বিভিন্ন ফার্ম থেকে, বিক্রেতারাই দোকানে নিয়ে আসেন। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে নানা হাত বদল হয়ে এসব মুরগি ঢাকায় আসে।
আরও পড়ুন: সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে আমরা কতটা প্রস্তুত?
গবেষকদের মতে, খামার কিংবা গ্রাম থেকে ক্রেতার কাছে মুরগি পৌঁছাতে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। এসময়ে একসঙ্গে রাখা হয় অনেক মুরগি, যার মধ্যে রোগাক্রান্তও থাকতে পারে। রোগাক্রান্ত মুরগির সংস্পর্শে এসে অন্য মুরগিও এতে আক্রান্ত হতে পারে। রোগাক্রান্ত এসব মুরগির মাধ্যমে রোগ-জীবাণু মানুষের শরীরের সংক্রমিত হতে পারে।
সম্প্রতি রাজধানীতে জেনেটিক ডিজিজ (পশু থেকে মানুষে এবং মানুষ থেকে পশুতে জীবাণু ছড়ানো) নিয়ে এক কর্মশালার আয়োজন করা হয়। ওই কর্মশালায় আইসিডিডিআরবি’র স্টপ স্পিলওভার (জীবজন্তু থেকে রোগ যাতে ছড়িয়ে না পড়ে) কর্মসূচির প্রধান নাদিয়া রিমি বলেন, দেশের বিজ্ঞানী ও গবেষকরা প্রাথমিকভাবে ২০ স্থান চিহ্নিত করেছেন, যেসব স্থানে মানুষ ও জীবজন্তু বা পশুপাখিকে একে অন্যের সংস্পর্শে তুলনামূলকভাবে বেশি আসতে দেখা যায়। এর মধ্যে নয়টি স্থান বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে আছে বাদুড়ের প্রতিবেশ, মানুষের আবাসস্থলে স্তন্যপায়ী পশু পালন, হাঁস–মুরগি শিল্প, মানুষ ও পশুপাখির একসঙ্গে চলাচল, পরিযায়ী পাখির স্থান, উন্মুক্ত সাফারি পার্ক ও জাতীয় উদ্যান, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও পরীক্ষাগার, পশু হাসপাতাল এবং জাতীয় উদ্যানের পার্শ্ববর্তী এলাকা। গবেষকদের ধারণা, এর মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মুরগির বাজার, বিশেষ করে রাজধানীর মুরগির বাজারগুলো। কারণ, এখানে মানুষের যাতায়াত অনেক বেশি।
আরও পড়ুন: মাছের কামড় খেলেই সারবে কঠিন রোগ
ওই সেমিনারে বক্তব্য দেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল মান্নান। বাংলাদেশ বার্ড ফ্লু মুক্ত হতে পারেনি জানিয়ে তিনি বলেন, প্রতিবছর শীতকালে বার্ড ফ্লুর প্রকোপ দেখা যায়। ২০০৭–০৮ সালে দেশের ৪৭ জেলার ১২৮ উপজেলায় এবং বিভিন্ন মহানগরের ১৪টি থানা এলাকায় বার্ড ফ্লুর প্রকোপ দেখা দিয়েছিল। তখন ১৬ লাখ মুরগি ও ২২ লাখ ডিম ধ্বংস করা হয়। ওই সময় এ খাত সংশ্লিষ্ট প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ বেকার হয়ে পড়েন। বাংলাদেশের আর্থিক ক্ষতি হয় ৪ হাজার ১৬৫ কোটির টাকা। দেশে এখনো বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্নভাবে বার্ড ফ্লু দেখা যায়। ২০০৭ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে সারা দেশে মোট ৫৫৬ বার বার্ড ফ্লুর প্রকোপ দেখা দেয়। দেশে এ পর্যন্ত ১১ জন বার্ড ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছেন, এর মধ্যে ৩ জন ছিলেন বাজারের মুরগি বিক্রেতা। বার্ড ফ্লুতে দেশে মারা গেছেন একজন।
পশুপাখি বা জীবজন্তু থেকে সংক্রামক রোগ মানুষের মধ্যে ছড়ানোর সম্ভাবনা বেশি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, নিপাহ ভাইরাস বা অন্য ভাইরাস যেকোনো সময় মানুষের মধ্যে বড় মাত্রায় ছড়াতে পারে। এমনকি করোনাভাইরাস থেকেও ভয়ানক হতে পারে নিপাহ ভাইরাস। কারণ, এখন পর্যন্ত নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্তদের ৭০ শতাংশই মারা গেছে। এসব রোগ প্রতিরোধে সবচেয়ে বড় উপায় হচ্ছে জীবাণু ছড়ানোর যে সাইকেল রয়েছে সেখানে গ্যাপ তৈরি করা। যেমনটা হয়েছে কোভিডের সময়ে আক্রান্তদের আইসোলেশনে রাখার মাধ্যমে।
আরও পড়ুন: অসংক্রামক রোগ মোকাবেলায় আমরা কতটা প্রস্তুত?
কর্মশালায় আলোচকদের কথায় উঠে আসে, সারাবিশ্বে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও নগরায়ণের কারণে ধ্বংস হচ্ছে বন। ফলে সংকুচিত হয়ে পড়ছে বনের জীবজন্তু–পশুপাখির আবাসস্থল। এ কারণে বনের জীবজন্তু ও পশুপাখি আগের তুলনায় আরও বেশি মানুষের সংস্পর্শে আসছে। এতে পশুপাখির রোগ মানুষের মধ্যে ছড়ানোর ঝুঁকিও বাড়ছে। ইবোলা, নিপাহ এবং সাম্প্রতিক কালে ছড়ানো কোভিড-১৯ সবই প্রাণীদের রোগ। যে কোনো উপায়ে তা মানুষের মধ্যে এসে প্রকট আকারে প্রকাশ পায়।
স্বাধীনতার পর গত ৫২ বছরে বাংলাদেশে ১৯টি নতুন রোগ ও পুরোনো রোগ নতুনভাবে দেখা দিয়েছে। রোগতত্ত্ববিদরা জানিয়েছেন, ১৯৭৭ সালে এ দেশের মানুষ প্রথম ‘জাপানিজ এনকেফালাইটিস’ রোগে আক্রান্ত হয়। তার আগে এই রোগ বাংলাদেশে ছিল না। এর বাহক মশা। এইচআইভি/এইডস, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, বার্ড ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু, নিপাহ, জিকা- এসব রোগ অন্য দেশ থেকে বাংলাদেশে এসেছে। সবশেষ এভাবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে আমাদের দেশে।
আরও পড়ুন: যেসব লক্ষণে বুঝবেন মুরগির গামবোরো রোগ হয়েছে
বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে পশুপাখি থেকে মানুষের মধ্যে রোগ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি আছে। যুক্তরাষ্ট্র, আফ্রিকা বা ইউরোপের কোনো দেশে দেখা দেওয়া নতুন কয়েকটি রোগ বিগত কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশেও দেখা গেছে। এসব রোগ বিস্তারে কখনো সময় নিয়েছে বেশি, কখনো কম। যেমন এইচআইভি/এইডস বৈশ্বিকভাবে আফ্রিকায় শনাক্ত হয়েছিল ১৯৮০ সালে। ওই ভাইরাস বা রোগ বাংলাদেশে প্রথম শনাক্ত হয় ১৯৮৯ সালে। নিপাহ ভাইরাস মালয়েশিয়ায় প্রথম শনাক্ত হয়েছিল ১৯৯৮ সালে। এর চার বছর পর তা বাংলাদেশে শনাক্ত হয়। করোনাভাইরাস চীনের উহানে প্রথম শনাক্ত হয় ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের শেষে। আড়াই মাসের মধ্যে অর্থাৎ ২০২০ সালের ৮ মার্চ তা বাংলাদেশে শনাক্ত হওয়ার তথ্য জানানো হয়।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. সেলিম উজ্জামান বলেন, জীবজন্তুর কোনো রোগ সরাসরি, কোনো রোগ পরোক্ষভাবে, কোনোটা আবার কীটপতঙ্গের মাধ্যমে মানুষের শরীরে আসে। আবার কোনো কোনোটা মানুষের শরীরে আসে খাবার বা পানির মাধ্যমে। জীবজন্তু–পশুপাখি থেকে আসা ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, পরজীবী (প্যারাসাইট) ও ছত্রাক মানুষের রোগের অন্যতম প্রধান কারণ।
এএএম/কেএসআর/এমএস