৫৯ শতাংশ রোগীই জানেন না উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন
উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন একটি দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্যগত সমস্যা। অনেক মানুষ হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপের কারণ হিসেবে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তাকে চিহ্নিত করেন। আবার দুশ্চিন্তা বা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় বুক ধড়ফড় করাকে অনেকে হাইপারটেনশন ভাবেন। তবে হাইপারটেনশন উচ্চ রক্তচাপেরই অন্য নাম। বিশ্বে প্রতিবছর উচ্চ রক্তচাপে মোট মৃত্যু সব সংক্রামক রোগে মৃত্যুর চেয়েও বেশি। এ উচ্চ রক্তচাপ নীরবে মহামারির মত অগণিত মানুষের ক্ষতি করে যাচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে ১২৮ কোটি মানুষ (৩০-৭৯ বছর) উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। যার দুই-তৃতীয়াংশ বাস করে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে। বিশ্বে প্রতিবছর উচ্চ রক্তচাপে মৃত্যু হয় ১ কোটিরও বেশি মানুষের, যা সব সংক্রামক রোগে বার্ষিক মোট মৃত্যুর চেয়েও বেশি।
আরও পড়ুন: উচ্চ রক্তচাপ কী? হঠাৎ রক্তচাপ বেড়ে গেলে করণীয়
বাংলাদেশ অসংক্রামক রোগ (এনসিডি) স্টেপস সার্ভে অনুযায়ী, দেশে প্রতি পাঁচজনে একজন প্রাপ্তবয়স্ক অর্থাৎ ২১ শতাংশ মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ রোগে অসুস্থতা ও মৃত্যু কমানো সম্ভব না হলে ২০২৫ সালের মধ্যে এনসিডি লক্ষ্যমাত্রা এবং ২০৩০ সালের মধ্যে অসংক্রামক রোগজনিত অকাল মৃত্যু এক-তৃতীয়াংশে কমিয়ে আনা সংক্রান্ত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না।
বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপে (২০১৭-১৮) দেখা গেছে, দেশে ১৮ বছরের বেশি বয়সী ২৭ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। আক্রান্তদের ৫৯ শতাংশ জানেনই না যে তারা উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। আক্রান্তদের ৩৬ শতাংশ এ রোগের চিকিৎসা নেন বা ওষুধ সেবন করেন। তাদের মাত্র ১২ শতাংশের উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকতে দেখা গেছে। অর্থাৎ আড়াই কোটির বেশি মানুষ অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। দেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ২১ শতাংশ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত। তাদের মধ্যে নিয়মিত ওষুধ গ্রহণের মাধ্যমে রোগটি নিয়ন্ত্রণে রেখেছে মাত্র ১৪ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি ৭ জনে একজনেরও কম।
এমন পরিস্থিতিতে সারা বিশ্বের মত আজ বুধবার (১৭ মে) দেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস-২০২৩। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘সঠিকভাবে রক্তচাপ মাপুন, নিয়ন্ত্রণে রাখুন এবং দীর্ঘজীবী হোন’।
আরও পড়ুন: দেশে প্রতি ৫ জনে একজন উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন
চিকিৎসকদের মতে, এ রোগে আক্রান্তদের একটা বড় অংশ জানেনই না তিনি উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। কারণ, অধিকাংশ সময় উচ্চ রক্তচাপের নির্দষ্টি কোনো লক্ষণ এবং উপসর্গ থাকে না। যারা চিকিৎসকের কাছে যান তাদের অনেকে উচ্চ রক্তচাপের জটিলতা নিয়ে যান। যেমন- হার্ট ফেইলিওর, স্ট্রোক, কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর। অথচ এ রোগ সহজে নির্ণয় করা ও ওষুধের মাধ্যমে সুস্থ হওয়া সম্ভব।
এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণ হিসেবে চিকিৎসকরা জানান, এ রোগের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো লক্ষণ বা উপসর্গ থাকে না। রোগী বুঝতেই পারেন না যে তার উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। এজন্য উচ্চ রক্তচাপকে নীরব ঘাতক বলা হয়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সকালের দিকে মাথাব্যথা, নাক দিয়ে রক্ত পড়া, হৃৎপিণ্ডের অনিয়মিত ছন্দ, দৃষ্টিতে পরিবর্তন এবং কানে গুঞ্জনের মত উপসর্গ দেখা দিতে পারে। উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা করা না হলে এটি ধমনি এবং মানবদেহের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে। ধমনি শক্ত হয়ে হৃৎপিণ্ডে রক্ত ও অক্সিজেনের প্রবাহ হ্রাস পেতে পারে। ফলে বুকে ব্যথা বা অ্যানজাইনা, হার্ট অ্যাটাক, হার্ট ফেইল এবং হার্ট বিট অনিয়মিত হতে পারে। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ অর্থাৎ স্ট্রোক এমনকি বিকল হতে পারে।
ব্র্যাক জেমস পি গ্রান্টস স্কুল অব পাবলিক হেলথ-এর অধ্যাপক ডা. মলয় কান্তি মৃধা জাগো নিউজকে বলেন, সবশেষ বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপে দেখা গেছে, ১৮ বছরের বেশি বয়সী ২৭ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। যা ২০৩০ সাল নাগাদ দাঁড়াবে ৩ কোটি ৮০ লাখে। কিন্তু আক্রান্তদের ৬৭ শতাংশ জানেই না যে তাদের রোগটি রয়েছে। উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত অধিকাংশ রোগীই (৬৪ শতাংশ) কোনো ওষুধ সেবন করে না। ১৪ শতাংশ মানুষের রোগটি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনের মাধ্যমে ৭৬ শতাংশ উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
আরও পড়ুন: উচ্চ রক্তচাপ হলে যে ৭ খাবার খাবেন না
বাংলাদেশ কার্ডিওবাসকুলার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সভাপতি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হৃদরোগ বিভাগের অধ্যাপক এস এম মুস্তাফা জামান বলেন, উচ্চ রক্তচাপ মূলত তিন ধরনের হয়ে থাকে। একটা হলো প্রাথমিক। এর কোনো কারণ জানা যায় না। বয়স্কদের এটি বেশি হয়। কিন্তু আমরা কম বয়সী রোগীও পাচ্ছি। যাদের অল্প বয়সে উচ্চ রক্তচাপ হয় এর সঙ্গে নানা কারণ জড়িত থাকে, যেমন- কারও কিডনি ছোট হয়ে গেছে, কারো হরমোনের সমস্যা অথবা রক্তনালী সরু হয়ে গেছে, থাইরয়েড সমস্যা, পিটুইটারি গ্লান্ডের সমস্যা বা মস্তিষ্কে কোনো সমস্যা। তবে এ ধরনের রোগী কম পাওয়া যায়।
বাংলাদেশ উচ্চ রক্তচাপ মোকাবিলায় বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকার অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য বহুখাতভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা ২০১৮-২৫ তৈরি করেছে। যেখানে অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা অনুসরণ করে ২০২৫ সালের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের প্রাদুর্ভাব তুলনামূলকভাবে ২৫ শতাংশ কমানোর (relative reduction) জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। উচ্চ রক্তচাপ ব্যবস্থাপনায় জাতীয় গাইডলাইন এবং এর চিকিৎসায় ন্যাশনাল প্রোটোকল প্রণয়ন করা হয়েছে।
এ গাইডলাইন তৈরির সঙ্গে যুক্ত অধ্যাপক এস এম মুস্তাফা জামান জাাগো নিউজকে বলেন, বর্তমানে ২৯৯টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বিনামূল্যে উচ্চ রক্তচাপের তিন ধরনের ওষুধ দিচ্ছে। কিন্তু মানুষ এ বিষয়ে জানে না। কোনো প্রচারও নেই। উচ্চ রক্তচাপ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যে গাইডলাইন রয়েছে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। সম্মিলিতভাবে কাজ করলে এর প্রকোপ মোকাবিলা করা সম্ভব।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের ইপিডেমিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, রক্ত চলাচলের সময় ধমনির ভেতরের গায়ে যে পার্শ্বচাপ তৈরি হয় তাকে রক্তচাপ বলে। রক্তচাপ যদি স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে অনেক বেড়ে যায়, তাহলে তাকে উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন বলে। রক্তচাপ সাধারণত দুটি মাত্রা বা সংখ্যার মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। প্রথম সংখ্যাটি সিস্টোলিক, যা হৃৎপিণ্ড সংকুচিত হয়ে রক্তনালীতে যে চাপ তৈরি হয় তার প্রতিনিধিত্ব করে। দ্বিতীয় সংখ্যাটি ডায়াস্টোলিক, যা হৃৎপিণ্ডের প্রসারণের সময় রক্তনালীতে চাপের প্রতিনিধিত্ব করে। স্বাভাবিক অবস্থায় একজন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মানুষের রক্তচাপের পরিমাপ ১২০/৮০ মি.মি. পারদচাপ ধরা হয়ে থাকে।
আরও পড়ুন: যেসব খাবার উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে
অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস যেমন খাদ্যের সঙ্গে অতিরিক্ত লবণ (সোডিয়াম) গ্রহণ, স্যাচুরেটেড ফ্যাট, ট্রান্স ফ্যাটযুক্ত খাবার এবং তামাক, অ্যালকোহল সেবন উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ায়। অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। যেমন- শারীরিকভাবে কর্মঠ না থাকা, অতিরিক্ত ওজন, মানসিক চাপ এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে ফলমূল ও শাকসবজি না খাওয়া।
অ্যাডভোকেসি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞার (প্রগতির জন্য জ্ঞান) উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক কর্মসূচি প্রধান হাসান শাহরিয়ার জাগো নিউজকে বলেন, উচ্চ রক্তচাপজনিত নীরব মহামারির থেকে জনস্বাস্থ্যকে সুরক্ষা পেতে হলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ সরবরাহ নিরবছিন্ন রাখতে হবে। এজন্য বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। কমিউনিটি ক্লিনিকে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে কমিউনিটি ক্লিনিকের ওষুধ তালিকায় উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। স্বাস্থ্যকেন্দ্র রোগীর চাপ কমাতে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং কমিউনিটি ক্লিনিকে উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের জন্য ২ থেকে ৩ মাসের ওষুধ একসঙ্গে দেওয়ার পরিষেবা নিশ্চিত করতে হবে। সঠিক নিয়মে পরীক্ষা, চিকিৎসাসেবা গ্রহণ এবং উচ্চ রক্তচাপজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে।
এএএম/এমকেআর/জেআইএম