ভিডিও EN
  1. Home/
  2. স্বাস্থ্য

নীরব ঘাতক তামাক

রাজস্ব থেকে আয়ের চেয়ে বেশি তামাকজনিত স্বাস্থ্যব্যয়

রাসেল মাহমুদ | প্রকাশিত: ০৭:০১ পিএম, ২৯ ডিসেম্বর ২০২২

‘ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’, ‘ধূমপান ফুসফুস ক্যানসারের কারণ’, ‘ধূমপান হৃদরোগের কারণ’ প্রভৃতি সতর্কবাণী সংযোজন করে হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করছে তামাক ও তামাকজাত পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো। বিনিময়ে প্রতি বছর মোটা অংকের রাজস্ব আদায় করে সরকার। প্রাণঘাতী তামাক প্রতিবছর কেড়ে নিচ্ছে দেশের দেড় লক্ষাধিক প্রাণ, বিশ্বে যার সংখ্যা ৮০ লাখের বেশি। ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর তামাক খাত থেকে যে রাজস্ব আদায় হয় তার চেয়ে বেশি ব্যয় হচ্ছে তামাকজনিত রোগের চিকিৎসায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, ২০২০ সালে বিশ্ব জনসংখ্যার মধ্যে তামাক ব্যবহারকারী ২২ দশমিক ৩ শতাংশ। এর মধ্যে ৩৬ দশমিক ৭ শতাংশ পুরুষ এবং ৭ দশমিক ৮ শতাংশ নারী। প্রতি বছর তামাক ব্যবহারে মারা যায় ৮০ লাখের বেশি মানুষ। ৭০ লাখের বেশি মারা যায় সরাসরি তামাক ব্যবহারের ফলে। আর ১২ লাখের মতো অধূমপায়ী, যারা তামাকের ধোঁয়ার সংস্পর্শে আসার ফলে মারা যান।

বিশ্বে ১৩০ কোটি তামাক ব্যবহারকারীর ৮০ শতাংশের বেশি লোক নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে বাস করে। অর্থাৎ বাংলাদেশের মতো নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে তামাক কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবসার বড় বাজার হিসেবে নিয়েছে। গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে ২০১৭ অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৫ বছরের অধিক বয়সীদের মধ্যে ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ বা ৩ কোটি ৭৮ লাখ মানুষ তামাকজাত দ্রব্য সেবন করে। ২০০৯ সালে তামাকসেবী ছিল ৪৩ দশমিক ৩ শতাংশ।

আরও পড়ুন>>সিগারেটের চেয়ে ক্ষতিকর ই-সিগারেট, দেশে বাড়ছে আসক্তি

টোব্যাকো অ্যাটলাস ২০১৮-এর এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশে তামাকজনিত কারণে বিভিন্ন মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে বছরে প্রায় ১ লাখ ৬২ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়।

রাজধানীর একটি স্কুলে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত সুজন খালাসী ছিলেন ক্লাসে প্রথম। পাড়ার তরুণদের সঙ্গে মিশে প্রথমে সিগারেট, পরে গাঁজাসহ সব ধরনের মাদক নেওয়া শুরু করে। এতে স্কুলের সেরা ছাত্রটিও এসএসসিতে ভালো ফলাফল করতে পারেনি। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পড়া ছেলেটি এখন একটি মেডিকেলের ল্যাবে টেকনিশিয়ান হিসেবে চাকরি করছেন। তবে এখনো মাদক থেকে বের হতে পারেননি তিনি। সুজন খালাসীর মতো এমন অনেক শিক্ষার্থীর স্বপ্নই শেষ করে দিয়েছে নীরব ঘাতক মাদক।

মাদক শুধু নিজের স্বপ্নকেই ভাঙে না, সঙ্গে সুন্দর পরিবারকেও ধ্বংস করে। বিমানবাহিনীতে চাকরি করা নিজাম ফকিরের বাবা ছেলেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন। এক সময় সঙ্গ দোষে সেই ছেলে আসক্ত হয়ে পড়েন মাদকে। ২০০৭ সালে বিয়ে করেন নিজাম ফকির। কিন্তু মাদকাসক্ত হওয়ার কারণে মাত্র কয়েক মাস পরেই নিজামকে ছেড়ে চলে যান তার স্ত্রী।

আরও পড়ুন>>তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন: সংশোধিত খসড়া পাস হলে সেবনকারীর সংখ্যা কমবে

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে সিগারেট খাত থেকে ২৪ হাজার ৭২৬ কোটি টাকা রাজস্ব পেয়েছে এনবিআর। অথচ তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় ও উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ বছরে ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। অর্থাৎ, তামাক গ্রহণের ফলে মৃত্যুর পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতেও ব্যয় হয় বাজেটের বিশাল অংশ। যারা অকালে মারা যান তারা অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখতে পারতেন। সেই অংক পুরোপুরি হিসাবে আনলে ক্ষতির মাত্রা আরও কয়েকগুণ বেশি হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও তামাক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কাজ করা বেসরকারি গবেষণা সংস্থা উন্নয়ন সমন্বয়-এর সভাপতি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, তামাক কোম্পানি থেকে যে পরিমাণ রাজস্ব আসে তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যয় হয় স্বাস্থ্যখাতে। বিশেষ করে তামাক গ্রহণের ফলে যেসব রোগ হয় সেসব রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে। রাজস্বের দৃষ্টিতে না দেখে স্বাস্থ্যের দিক বিবেচনা করে দেখা উচিত। অনেকে মনে করে এগুলো বন্ধ করে দিলে রাজস্ব আহরণ কমে যাবে। অথচ এর মাধ্যমে স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে ফেলে। আমাদের লক্ষ্যটা ঠিক করা উচিত আসলে আমরা এই খাত থেকে রাজস্ব আহরণের দিকে জোর দেবো নাকি স্বাস্থ্যের ওপর বেশি জোর দেবো।

তামাক কোম্পানিতে সরকারের ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ অংশীদার ও বোর্ড অব ডিরেক্টরিতে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণ রয়েছে। ফলে প্রাণঘাতী পণ্য উৎপাদনকারী তামাক কোম্পানিগুলোর প্রভাব বিস্তারের ঘটনা নতুন নয়, বরং পৃথিবীর অনেক দেশেই তারা কূট-কৌশলে তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ হাসিল করছে।

আরও পড়ুন>>ই-সিগারেট নিষিদ্ধের প্রস্তাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সায়

বাংলাদেশেও তামাক কোম্পানিগুলোর অনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে জনস্বাস্থ্য ও তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর নেপথ্যে কাজ করছে তামাক কোম্পানিতে স্বাধীনতার পর থেকেই সরকারি শেয়ার। ফলে সরকারের উচ্চপদস্থ একাধিক কর্মকর্তা বিএটির পরিচালনা পর্ষদে প্রতিনিধিত্ব করছেন। এমনকি বিএটিবিতে শেয়ার নেই এমন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিকেও তাদের পরিচালনা পর্ষদে প্রতিনিধিত্ব করছে বলে দাবি তামাকবিরোধী সংগঠনগুলোর। ফলে তামাকের ওপর করারোপ, তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি প্রণয়ন না হওয়ার পেছনে এসব নীতিনির্ধারকের ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করে তারা।

তামাকবিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞার (প্রগতির জন্য জ্ঞান) নির্বাহী পরিচালক এ বি এম জুবায়ের জাগো নিউজকে বলেন, তামাক কোম্পানি সরকারকে যে শেয়ারটা দিয়ে রেখেছে এটা কৌশলগতভাবেই তারা ব্যবসার স্বার্থে দিয়ে রেখেছে। নীতিনির্ধারকদের অনেকে তাদের বোর্ডে আছেন। এটার মাধ্যমে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন, কর বৃদ্ধি এসব ক্ষেত্রে তারা প্রভাবিত করার সুযোগ পায় নীতিনির্ধারকদের নানান ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে।

“আমরা বলেছি সরকারের এই শেয়ারটা যেন প্রত্যাহার করা হয়। ফলে তামাক কোম্পানি আর প্রভাবিত করতে পারবে না, সেই সুযোগটাও পাবে না। ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘আমরা ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তামাকের ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করতে চাই।’ সেটা বাস্তবায়ন করতে হলে সবাইকে কাজ করতে হবে এবং তামাক কোম্পানির শেয়ার প্রত্যাহার করতে হবে।”

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সোহেল রেজা চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ধূমপান ও তামাক সেবনের ফলে হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যানসার, ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত হয়ে বিশ্বে প্রতি বছর ৮০ লক্ষাধিক মানুষ মারা যাচ্ছে। বাংলাদেশে বছরে এক লাখ ৬১ হাজারের অধিক মানুষ তামাকজনিত বিভিন্ন রোগে মারা যায়। এছাড়া তামাকের কারণে অসংক্রামক জাতীয় অনেক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য সেবন। জর্দা ও গুল ব্যবহারের ফলেও মুখে ক্যানসার হচ্ছে। তাই সুস্থ ও সুন্দরভাবে জীবনযাপন করতে চাইলে তামাকের বিস্তার রোধ করতে হবে।

আরএসএম/এএসএ/জিকেএস