ভিডিও EN
  1. Home/
  2. স্বাস্থ্য

করোনা চিকিৎসায় এখনো ‘সমস্যা’ বিদ্যমান, ১০ সুপারিশ টিআইবির

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক | প্রকাশিত: ০৪:৩৬ পিএম, ১২ এপ্রিল ২০২২

দেশে করোনা সংক্রমণের দুই বছর হয়ে গেলেও প্রয়োজনের চেয়ে পরীক্ষাগার স্বল্পতা, পরীক্ষাগারে সক্ষমতার অধিক সেবাগ্রহীতা ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে নমুনা পরীক্ষায় নানা সমস্যা এখনো রয়ে গেছে বলে দাবি করছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

মঙ্গলবার (১২ এপ্রিল) ‘করোনা সংকট মোকাবিলায় সুশাসন: অন্তর্ভুক্তি ও স্বচ্ছতার চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এক গবেষণাপত্রে একথা উল্লেখ করা হয়।

গবেষণাপত্র প্রকাশ অনুষ্ঠানে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান, জ্যেষ্ঠ রিসার্চ ফেলো শাহজাদা এম আকরাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়, জরিপে দেখা গেছে, যারা নমুনা পরীক্ষা করতে গিয়েছিল তাদের ২৬ দশমিক ১ শতাংশ নানা সমস্যায় পড়েছে। যার মধ্যে ৬৮ দশমিক ৬ শতাংশ বলেছেন নমুনা দেওয়ার সময় পরীক্ষাগারগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা হয়নি। এছাড়া ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ নমুনা দিতে গিয়ে দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর ফিরে এসেছে। পরীক্ষাগারে কর্মীদের দুর্ব্যবহার ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ, নিজ বাসা থেকে নমুনা দিতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেছে ১০ দশমিক ৩ শতাংশ, নমুনা দিতে একাধিকবার কেন্দ্রে যাওয়া ১০ দশমিক ৩ শতাংশ, ভুল প্রতিবেদন দেওয়ার কারণে পুনরায় পরীক্ষা করতে বাধ্য হয়েছে বলে জানিয়েছে ৩ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ।

গবেষণায় আরো উল্লেখ করা হয়, সব জেলায় আরটি-পিসিআর পরীক্ষাগার না থাকায় ওই সব জেলা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে অন্য জেলায় পাঠানো হয়, অথবা লোকজন অন্য জেলায় গিয়ে নমুনা পরীক্ষা করে আসে। এতে দেখা গেছে, ৪ দশমিক ৮ শতাংশ সেবাগ্রহীতাকে অন্য জেলায় গিয়ে নমুনা দিতে হয়েছে। ফলে অন্য জেলা থেকে নমুনা পরীক্ষার প্রতিবেদন পেতে অনেক বিলম্ব হয়।

জরিপে দেখা যায়, সেবাগ্রহীতাদের কোভিড-১৯ নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট পেতে তাদের গড়ে ২ দশমিক ৫ দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৯ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। এছাড়া পরীক্ষাগারে নমুনা দিতে গিয়ে সেবাগ্রহীতাদের গড়ে ৩ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে (সর্বোচ্চ ১০ ঘণ্টা )।

কিছু ক্ষেত্রে নমুনা পরীক্ষায় অনলাইন নিবন্ধনের সুযোগ রাখা হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে শুধু একটি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পরীক্ষার ফি জমার সুযোগ রাখা হয়, ফলে যাদের এই অ্যাকাউন্ট নেই তারা ফি জমা দিতে গিয়ে সমস্যায় পড়েছেন। ভিড় এড়িয়ে দ্রুত ও নির্ভুল প্রতিবেদন পেতে ৯ দশমিক ৭ শতাংশ সেবাগ্রহীতা বিভিন্ন বেসরকারি পরীক্ষাগারে নমুনা পরীক্ষা করিয়েছে।

করোনা চিকিৎসা ব্যবস্থায় সক্ষমতার ঘাটতি

করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা ব্যবস্থায় সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে বলে উল্লেখ করছে টিআইবি, যা করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের যথা সময়ে সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা।

টিআইবি বলছে, হাসপাতালে পৌঁছানোর পর থেকে শয্যা পেতে রোগীদের গড়ে ৩ দশমিক ৫ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে। এছাড়া হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে ১৪ দশমিক ১ শতাংশ অনিয়মিতভাবে চিকিৎসকের সেবা পেয়েছেন। চিকিৎসার সময়ে জরুরি প্রয়োজনে ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ রোগীর অক্সিজেন পেতে দেরি হয়েছে। আর ১ দশমিক ৭ শতাংশ রোগী প্রয়োজন থাকলেও হাসপাতালে চিকিৎসার সময়ে একবারও অক্সিজেন পাননি।

হাসপাতালে ভর্তি হওয়া সেবাগ্রহীতাদের ১৫ শতাংশ প্রয়োজনে তাৎক্ষণিক ভেন্টিলেশন সুবিধা পাননি, অপরদিকে ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ যথাসময়ে আইসিইউ পাননি, এবং ৯ শতাংশ হাসপাতালে চিকিৎসার সময়ে একবারও আইসিইউ পাননি।

হাসপাতালে চিকিৎসার সময় ২২ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ চিকিৎসা নিতে নানা সমস্যায় পড়েছেন। যার মধ্যে প্রয়োজনীয় ওষুধ না পাওয়া (৬৪ দশমিক ৭ শতাংশ), প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সেবা না পাওয়া (৩৩ দশমিক ৩ শতাংশ), ট্রলি, স্ট্রেচার বা হুইল চেয়ার না পাওয়া (৯ দশমিক ৮ শতাংশ), অ্যাম্বুলেন্স সেবা না পাওয়া (৩ দশমিক ৯ শতাংশ)উল্লেখযোগ্য।

অপরদিকে চিকিৎসাসেবার অপ্রতুলতা এবং যথা সময়ে সেবা না পাওয়ায় হাসপাতালে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ ক্ষেত্রে রোগীর মৃত্যু হয়েছে। আর ১১ দশমিক ৮ শতাংশ ক্ষেত্রে রোগের জটিলতা বেড়েছে।

গবেষণায় আরো উল্লেখ করা হয়, সরকারি হাসপাতালে সেবার অপ্রতুলতার কারণে ও ভালো সেবা পেতে ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ রোগী বেসরকারি হাসপাতালে গেছেন। বেসরকারি হাসপাতাল থেকে সেবা গ্রহণের কারণ হিসেবে তারা যে বিষয়গুলো উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে- সেখানে সেবার মান ভালো (৬০ দশমিক ৯ শতাংশ), বেসরকারি হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পাওয়া যায় (৪৪ দশমিক ৯ শতাংশ), ডাক্তার বা পরিচিত কোনো ব্যক্তির পরামর্শে (৪২ দশমিক ০ শতাংশ), আইসিইউ শয্যা পাওয়ার জন্য (২৯ দশমিক ০ শতাংশ), সরকারি হাসপাতালে শয্যা খালি না পাওয়ায় (২৩ দশমিক ২ শতাংশ) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

তবে গবেষণায় বলা হয়, বেসরকারি হাসপাতালে সেবাগ্রহীতার ওপর অর্থনৈতিক বোঝা তৈরি করেছে। সরকারি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা গ্রহণে শয্যা, ওষুধ, আইসিইউ, অক্সিজেন, ও অন্যান্য খরচসহ সেবাগ্রহীতা পর্যায়ে মোট গড় চিকিৎসা খরচ যেখানে ৩৫ হাজার ৯৩৮ টাকা, সেখানে বেসরকারি হাসপাতালে মোট গড় চিকিৎসার খরচ ৪ লাখ ৫৮ হাজার ৫৩৭ টাকা। জরিপে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ সেবাগ্রহীতা আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় বাড়ি থেকে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়।।

এসময় করোনা সংকট মোকাবিলা ও স্বচ্ছতার জন্য ১০টি সুপারিশ করেছে টিআইবি। সেগুলো হলো-

১. করোনা চিকিৎসার উন্নয়নে সরকারি ও প্রকল্পের বরাদ্দ যথাযথভাবে দ্রুততার সঙ্গে কাজে লাগিয়ে প্রতিটি জেলায় আইসিইউ শয্যা, আরটি-পিসিআর পরীক্ষাগারসহ অন্যান্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন শেষ করতে হবে।

২. সরকারি পরীক্ষাগারে বিনামূল্যে নমুনা পরীক্ষার ব্যবস্থা ও বেসরকারি পরীক্ষাগারে নমুনা পরীক্ষার ফি কমাতে হবে।

৩. বেসরকারি পর্যায়ের অংশীজনদের সম্পৃক্ত করে টিকার আওতার বাইরে রয়ে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ মানুষ চিহ্নিত করে তাদের টিকার আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

৪. মাঠ পর্যায়ের সরকারি প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার মাঠকর্মীদের ব্যবহার করে প্রত্যন্ত এলাকা ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিনামূল্যে নিবন্ধন ও টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

৫. প্রথম ডোজ পাওয়া বিশেষত নিবন্ধন ছাড়া টিকাগ্রহীতার দ্বিতীয় ডোজ নিশ্চিত করতে প্রচারণা বাড়ানো; এক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, উন্নয়ন সংস্থার সহায়তা নিতে হবে।

৬. মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তর, প্রতিষ্ঠান, গবেষক, উদ্যোক্তা সমিতির সহায়তায় প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের চিহ্নিত করতে হবে, এবং তাদের মধ্যে প্রণোদনা ঋণ আবেদন প্রক্রিয়া সম্পর্কিত তথ্য প্রচার করতে হবে।

৭. মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা ঋণ প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে, বিভিন্ন শর্ত শিথিল করে ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়াতে হবে।

৮. ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বাইরে ক্ষুদ্র এবং কুটির শিল্প সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বেশি ঋণ বিতরণ করতে হবে।

৯. টিকা প্রাপ্তির উৎস, ক্রয়মূল্য, বিতরণ ব্যয়, মজুত ও বিতরণ সম্পর্কিত তথ্য সবার জন্য উন্মুক্ত করতে হবে।

১০. কোভিড-১৯ চিকিৎসা ও টিকা সম্পর্কিত সব প্রতিষ্ঠানে অভিযোগ নিরসন ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে এবং অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।

এইচএস/জেডএইচ/এএসএম