ভিডিও EN
  1. Home/
  2. স্বাস্থ্য

ফরিদগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সই যেন রোগাক্রান্ত!

জেলা প্রতিনিধি | চাঁদপুর | প্রকাশিত: ০৪:৫৭ এএম, ১৩ নভেম্বর ২০১৫

ফরিদগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নিজেই রোগাক্রান্ত। নানা সমস্যায় জর্জরিত এ কমপ্লেক্স চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। অভিযোগ আছে, পর্যাপ্ত ডাক্তার পোস্টিং থাকলেও তাদের অনেককেই খুঁজে আনতে হয়। অথবা পাওয়াই যায় না। হাসপাতালের বহির্বিভাগে নগদ ফিস নিয়ে রোগী দেখেন তারা।

এক্স-রে বিভাগে ঝুলছে তালা। পুরনো জেনারেটর প্রায়শই থাকছে অচল। নড়বড়ে হাসপাতাল ভবনের ছাদ থেকে প্লাস্টার খসে খসে পড়ছে। এতে যে কারো প্রাণনাশের আশঙ্কা বিদ্যমান। স্টাফদের আবাসিক পুরনো আটটি ভবনের প্রত্যেকটি রয়েছে ভয়ানক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। জীবনের নিরাপত্তার আশঙ্কা নিয়ে ও বাধ্য হয়ে সেখানে বসবাস করছেন কর্মচারীরা। কয়েক বছর আগে একটি ভবনের ছাদ ধসে পড়ার পর তা পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে।

খোদ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার আবাসিক ভবনটি ঝোপ জঙ্গলে ঘিরে রয়েছে প্রায় এক যুগ ধরে। জনবল সঙ্কট রয়েছে তীব্রভাবে। হাসপাতাল ঘিরে রয়েছে দালালদের দৌরাত্ম।

হাসপাতালের রেকর্ড থেকে কর্তৃপক্ষ জাগো নিউজকে জানায়, ১৯৬৪ সালে ১০ শয্যা বিশিষ্ট পল্লী স্বাস্থ্য কেন্দ্র নামে প্রায় পাঁচ একর ভূমিতে যাত্রা শুরু হয় হাসপাতালের। ১৯৬৯ সালে মেরামত ও সম্প্রসারণ করে ৩১ শয্যা বিশিষ্ট থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে উন্নীত করা হয়। পরে, বিভিন্ন সময়ে ভবন মেরামত ও সম্প্রসারণ করে বহির্বিভাগ, অন্তঃবিভাগ, জরুরি বিভাগ, ইপিআই এবং ইওসিসহ স্বাস্থ্য বিভাগের বিভিন্ন কার্যক্রম সংযোজন করে পূর্ণাঙ্গ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রূপান্তর করা হয়। এটিকে ৫০ শয্যা বিশিষ্ট্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে উন্নীত করার লক্ষে ২০০৮ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। কিন্তু তা আজও বাস্তবায়ন হয়নি। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র জাগো নিউজকে জানান, বর্তমানে এখানে ২০ জন ডাক্তার নিয়োগ রয়েছে। তা সত্ত্বেও, হাসপাতালের নির্ধারিত কক্ষে কোনো কোনো ডাক্তারকে প্রায়ই পাওয়া যায় না। তাদের খুঁজে আনতে হয়। সপ্তাহের বিভিন্ন কার্য দিবসে কেউ কেউ হাসপাতালেই যান না। যদিও, হাজিরা খাতায় ভূতুড়ে স্বাক্ষর ঠিকই করা হয়।

chandpur-hospital

হাসপাতালে আগত জাহানারা বেগম (৪৫), আব্দুল মালেক (৩০), মতিন (৫৫) প্রমুখ রোগী জাগো নিউজের এ প্রতিনিধির কাছে অভিযোগ করে বলেন, অফিস চলাকালীন সময়ই কোনো কোনো ডাক্তার নগদ ফিসের বিনিময়ে রোগী দেখেন। এজন্য তারা ব্যবহার করেন ব্যক্তিগত প্যাড। ফিসের টাকা গ্রহণ করার জন্য কখনো আয়া, ওয়ার্ডবয় কখনোবা দালালদের সাহায্য নেয়া হয়। যারা ফিস দিতে অক্ষম তাদের রোগ পর্যবেক্ষণে ও ব্যবস্থাপত্রে হেলাফেলা করা হয়। তবে, চিকিৎসা প্রদানে ফিস নেন না, এমন ডাক্তারও রয়েছে বলে রোগীরা জানিয়েছেন।

এখানে চারজন জুনিয়র কনসালট্যান্ট (বিশেষজ্ঞ) গাইনি, অ্যানেসথিসিয়া, সার্জারি ও মেডিসিনের পদ রয়েছে। কিন্তু, মাত্র গাইনি পদে একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার রয়েছেন। ডাক্তার শাহরিয়া শায়লা জাহান নামের এই গাইনি ডাক্তারকে সাধারণত তার কক্ষে পাওয়া যায় না। অফিস চলাকালীন তিনি কখনো প্রাইভেট হাসপাতালে কখনো বা থাকেন বাসায়। যদিও বা কখনো অফিস করেন নগদ ২শ টাকা ভিজিট তিনি চেয়েই নেন। কাঙ্খিত টাকা না পেলে রোগীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন বলে জাগো নিউজের এ প্রতিনিধির কাছে রোগীরা অভিযোগ করেছেন।

হাসপাতালে রয়েছে দালাল ও ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের দৌরাত্ম। ভুক্তভোগীরা আরো অভিযোগ করেন, চিকিৎসা গ্রহণ করতে যাওয়া রোগীদের পিছু নেন এক শ্রেণির দালাল। তারা একদিকে, ডাক্তারদের ফিস পাইয়ে দিতে সাহায্য করেন অন্যদিকে, বিভিন্ন টেস্ট লিখিয়ে নিতে ডাক্তারদের মানসিক নিপীড়ন করেন। এদিকে, অফিসের নির্ধারিত সময়ে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা ঢুকে পড়েন ডাক্তারদের কক্ষে। ভিজিটের নামে তাদের এই অনুপ্রবেশে রোগীদের চিকিৎসা নিতে ব্যাঘাত ঘটে।

হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২শ রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে যান। তাদের কারো কারো অভিযোগের সত্যতা পেতে গত এক সপ্তাহ সেখানে ঘুরে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে। বিগত দিনগুলোতে এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেছেন, এমন রোগীদের মধ্যে গণতদন্ত হলে এসব অভিযোগের সত্যতা মিলবে বলে সংশ্লিষ্টরা দাবি করেছেন। তবে, দীর্ঘ দিন অচল হয়ে পড়ে থাকা অপারেশন থিয়েটারটি চালু করা হয়েছে। সেখানে অত্যাবশ্যকীয় প্রসুতি সেবার (ইওসি) আওতায় গত তিন মাসে অন্তত ৩০টির মতো সিজিারিয়ান অপারেশন করা হয়েছে।

এদিকে, প্রতি বুধবার সকাল ৯টা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত জরায়ুর মুখ ও স্তন ক্যান্সার পরীক্ষার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রায় এক যুগ আগের অত্যাধুনিক অ্যাম্বুলেন্সটি এখন ব্যবহার অনুপযোগী। জরুরি মেরামত করে কোনোভাবে জেলার মধ্যে চলাচল করছে। বিকল হয়ে থাকা এক্স-রে মেশিনটির কক্ষে বছরের পর বছর ঝুলছে তালা। জরুরিভাবে একটি ডিজিটাল এক্স-রে মেশিন সরবরাহ করা হলে গরীব মানুষ উপকৃত হবেন। অ্যানেসথেসিয়ার (জি.এ) জি.এ মেশিনটিও নষ্ট হয়ে আছে অনেক দিন আগে। বিনষ্ট একটি জেনারেটর চলছে ধুঁকে ধুঁকে। বিদ্যুৎ না থাকলে সমগ্র হাসপাতালে ভূতুড়ে পরিবেশ বিরাজ করে। এ হাসপাতালে জনবল সঙ্কটও প্রকট আকার ধারণ করেছে। এখানে, অ্যানেসথেসিওলজিস্ট (পদের বি.মে. অফিসার) একটি, নার্সিং সুপারভাইজার একটি (তিনি প্রেষণে অন্যত্র কর্মরত), প্রধান সহকারী কাম-হিসাব রক্ষক একটি, পরিসংখ্যানবিদ একটি, মেডিকেল টেকনোলোজিস্ট (ল্যাবরেটরি) একটি, মেডিকেল টেকনোলোজিস্ট (রেডিওগ্রাফি) একটি, সিনিয়ার স্টাফ নার্স চারটি, সহকারী নার্স একটি, স্বাস্থ্য সহকারী ৩৬টি পদ শুন্য রয়েছে। ফলে, এ শুন্য পদগুলোর কাজে মারাত্মক বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

অন্যদিকে, প্রায় ৫০ বছর আগে নির্মিত হাসপাতালের মূল ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে। ছাদ, দেয়াল, মেঝে এবং বিভিন্ন স্থানে ফাটল ধরেছে। প্লাস্টার এবং ঢালাইয়ের কংক্রিট খসে পড়ছে। যেকোনো সময় বড় রকমের দুর্ঘটনার আশঙ্কা আছে। আশঙ্কাজনকভাবে হাসপাতালের ওয়ার্ডে রোগী অবস্থান, ডাক্তার এবং অন্যান্য কর্মচারীগণ দায়িত্ব পালন করছেন। একই অবস্থা আবাসিক পুরনো আটটি ভবনের। এসব ভবন ভেঙে পুনর্নির্মাণ করা প্রয়োজন।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২০ জন ডাক্তার কর্মরত আছেন। তাদের আবাসনের জন্য চার ইউনিটের একটি মাত্র আবাসিক ভবন রয়েছে। আবাসিক মেডিকেল অফিসারের ভবন দুইটির অবস্থা বসবাসের অযোগ্য। খোদ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার আবাসিক ভবনটি ঝোপ জঙ্গলে ঘিরে রয়েছে প্রায় এক যুগ ধরে।

chandpur-hospital

এ দোহাই দিয়ে কোনো ডাক্তারই এখানে নিয়মিত থাকেন না। তাদের কেউ থাকেন জেলা সদরে, কেউ ঢাকায়। মঙ্গলবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ডাক্তার শাহরিয়া শায়লা জাহানের কক্ষে তাকে পাওয়া যায়নি। দুপুর সাড়ে ১২টায় বক্তব্যের জন্য তার মোবাইল ফোনে ফোন দিলে, তিনি রিসিভ করেননি।

এ ব্যাপারে, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (জুনিয়র কনসালটেন্ট অ্যানেসথেসিয়া) ডাক্তার মো. জাহাঙ্গীর আলম শিপন জাগো নিউজের এ প্রতিনিধিকে বলেন, হাসপাতালের ভৌত অবকাঠামো ও জনবল সমস্যার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন দফতরে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।

তিনি বলেন, রোগীদের সেবা প্রদানে বর্তমানে এ হাসপাতালের বড় রকমের উন্নতি সাধিত হয়েছে। এক প্রশ্নের উত্তরে, সঠিক ও ন্যায়সঙ্গত সেবা প্রদানে কর্তৃপক্ষ বদ্ধ পরিকর রয়েছেন উল্লেখ করে তিনি আরো জাগো নিউজকে বলেন, অফিস চলাকালীন নগদ টাকা নেয়ার অভিযোগ এখন নেই। তারপরও এমন ঘটনা ঘটলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ইকরাম চৌধুরী/এমজেড/পিআর