কন্ট্রোল রুম থেকে সরিয়ে দেয়া হলো মিডিয়াবান্ধব ডা. আয়েশাকে
দেশের অনলাইন, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া অর্থাৎ গণধ্যমকর্মীদের পরিচিতমুখ ডা. আয়েশা আক্তারকে আর স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের দায়িত্ব পালন করতে দেখা যাবে না। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলমের মৌখিক নির্দেশে তিনি ওই দায়িত্ব থেকে সরে যাচ্ছেন। এখন থেকে তিনি অসংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ (এনসিডিসি) প্রোগাম ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করবেন। আর তার পরিবর্তে স্বাস্থ্য অধিদফতরের এমআইএস (ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম) শাখার কর্মকর্তারা কন্ট্রোল রুমের দায়িত্ব পালন করবেন।
ডা. আয়েশা আক্তার গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কন্ট্রোল রুমে সার্বক্ষণিক কাজ করার ফলে অধিদফতরের সার্বিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছিলেন। তিনি সিনিয়র-জুনিয়র নির্বিশেষে গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে বিশ্বস্ত তথা মিডিয়াবান্ধব কর্মকর্তা হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। বিগত সময়ে রানা প্লাজা দুর্ঘটনা, ঘূর্ণিঝড় মহাসেন, ফণী, আইলা, আম্ফান, বনানী ও চকবাজারের অগ্নিকাণ্ড, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট এবং সবশেষ দেশে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার পর স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকাণ্ড তুলে ধরে প্রশংসিত হয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার জন্য চালিয়ে যাচ্ছিলেন নিরলস প্রচেষ্টা। কিন্তু সেই প্রচেষ্টায় থেমে যেতে হলো তাকে।
মিডিয়াবান্ধব এই কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেয়ার ফলে গণমাধ্যমকর্মীদের মাঝে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। গণমাধ্যম কর্মীরা বলছেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিভিন্ন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও ডা. আয়েশার বিরুদ্ধে কখনো কোনো অভিযোগ ওঠেনি। আর্থিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এমন কোনো কর্মকাণ্ডে তিনি নিজেই জড়িত হতে চাননি। তিনি কন্ট্রোল রুমে দায়িত্ব পালন করাকে নিছক চাকরি মনে করেননি, নিজের সংসারের প্রাপ্য সময়ও তিনি দিনের পর দিন দিয়েছেন অধিদফতরে। কিন্তু এমন নিবেদিত কর্মকর্তাকেই এভাবে সরে যেতে হলো প্রায় এক যুগ ধরে পালন করে আসা দায়িত্ব থেকে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আমিনুল হাসানের বিরুদ্ধে রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তিসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। তাকে সম্প্রতি ওই পদ থেকে ওএসডি করা হয়। তার বিরুদ্ধে দুদকে অনুসন্ধান চলছে। ওএসডিকৃত ও দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ওই কর্মকর্তাকে দুদিন আগে ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজির (আইএইচটি) অধ্যক্ষ হিসেবে পদায়ন দেয়া হয়েছে। আর যিনি সততার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন তাকে পুরস্কৃত না করে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হলো, যা তার জন্য অপমানের।
স্বাস্থ্য অধিদফতরে বর্তমান মহাপরিচালক যোগদানের পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে গত ৪ আগস্ট গণমাধ্যমের সঙ্গে কর্মকর্তাদের আলাপের বিষয়ে একটি নির্দেশনা জারি হয়। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের যুগ্ম-সচিব (প্রশাসন অধিশাখা) মো. জিল্লুর রহমান চৌধুরী স্বাক্ষরিত ওই নির্দেশনায় বলা হয়, স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষে বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সাক্ষাৎকার প্রদান ও টকশোতে অংশগ্রহণের আগে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের অনুমতি লাগবে। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে ব্রিফিং ও সাক্ষাৎকার প্রদান বা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের বিষয়ে অংশগ্রহণকারীকে ন্যূনতম পরিচালক পদমর্যাদার কর্মকর্তা হতে হবে।
নির্দেশনায় আরও বলা হয়, বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে স্বাস্থ্য বিভাগের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মুখপাত্র হিসেবে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন ও অধিদফতরের প্রতিনিধিত্ব করেন। নিয়মিত ব্রিফিং ছাড়াও এসব বক্তব্য ও মন্তব্যের কারণে অনেক সময় সরকারকে বিব্রত হতে হয়। প্রচারমাধ্যমে সরকারের প্রতিনিধিত্ব করার বিষয়ে যথাযথ বিধিবিধান অনুসরণ বাঞ্ছনীয়।
সেই নির্দেশনার পর দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র হিসেবে পরিচালক পদমর্যাদার কোন কর্মকর্তা কথা বলবেন সে সম্পর্কে এখনো কোনো নির্দেশনা জারি হয়নি।
ওই নির্দেশনা জারির আগ পর্যন্ত ডা. আয়েশা আক্তার মুখপাত্র হিসেবে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করছিলেন। কিন্তু তারপর থেকে তিনিও আর মুখ খোলেননি। এর ফলে গণমাধ্যমকর্মীরা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা নিয়ে বিপাকে পড়েন।
এ প্রসঙ্গে জানতে ডা. আয়েশা আক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
তবে তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আজ শুক্রবার (২১ আগস্ট) বিকেলে ‘বিদায় কন্ট্রোল রুম’ শিরোনামে একটি স্ট্যাটাস দেন। স্ট্যাটাসে তিনি লিখেন, “তোমাকে ভালোবেসে ভুলেই গিয়েছি, সরকারি চাকুরেদের সাপ্তাহিক ছুটি থাকে! ১৩ বছরের পথচলায় দুই ঈদেও তোমার সাথে সময় কাটিয়েছি সকাল-সন্ধ্যা। পুরাতন স্বাস্থ্য ভবনের ছোট রুমটির আপন করে নেয়ার ক্ষমতা। সহকর্মীদের ভালোবাসা। সাংবাদিকদের আপা ডাকার সাথে, তথ্যের নানা বায়না পূরণ করতে করতে টের পাইনি, যৌবনের সূর্য কখন পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। ছেলেটা জানতো, ওর মা দেশের জনগণের চাকর। দেশের মানুষের শ্রমে-ঘামে মিশ্রিত টাকায় ওর মায়ের বেতন হয়। তাই ছুটির দিনে পাশে পেতো না বলে খুব রাগ করতো না।
আজ খুশি হয়েছে। প্রাথমিকের গন্ডি পার হবার পর প্রথমবারের মতো ছুটির দিন মায়ের সাথে কাটাতে পারবে বলে।
নতুন পথের নতুন দিগন্ত হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমায়। সরকারি চাকুরে বলে কথা!! হয়তো শঙ্খচিল, শালিকের বেশে দেশকে ভালোবেসে চুপি চুপি কাজ করে যাবো। আমার কাছে দেশপ্রেম মানে নিজের দায়িত্বটা নিখুঁতভাবে পালন করা। অতীতে করেছি, ভবিষ্যতেও করবো। আর দেশের সব গণমাধ্যমকর্মীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা বোনের আসন দেয়ার জন্য। আপনারা জাতির দর্পণ। আপনাদের কলমের কালিতে একদিন শুচিশুভ্র হবে সব কলঙ্কিত অধ্যায়। যোগ্যতার মাপকাঠিতে বিচার হবে মানুষের।
বিশ্বাস করি জাতির জনকের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে দিকভ্রান্ত হবে না বাংলাদেশ। করোনাকালে তিনি নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছেন স্বাস্থ্য খাতের প্রত্যেকটি কর্মকাণ্ড।
বি. দ্র. (চলুন সমুদ্রে নেমেই মাপি গভীরতা। দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ,
ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ? কে আছ জোয়ান, হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যত।)”
এমইউ/এইচএ/জেআইএম