২২২ ডেঙ্গু রোগী হলি ফ্যামিলিতে
এমএম ১/১১ নম্বর বিছানায় শুয়ে আছে ১৩ বছর বয়সী মো. হাবিবুর ইসলাম শান্ত। চোখ-মুখ ফোলা। সামনে দাঁড়িয়ে পরিচয় দেয়ার শুরুতেই বিরক্তির সুরে সে বলে, ‘ওই দিকে যাইয়্যা কথা কন।’ পাশেই তার মা ও ভাই। তার ভাই ফাহমিদুল ইসলাম সোহাগ তখন ফোনে বলছিলেন, ‘দুই ব্যাগ রক্ত পাইছি। আরও দুই ব্যাগ লাগবে। এখনও ব্যবস্থা করতে পারি নাই।’
রাজধানীর হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হাবিবুর ইসলাম শান্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। গত মঙ্গলবার (২ জুলাই) শান্তর জ্বর আসে। বুধবার রাত ১২টার দিকে তাকে এ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
সোহাগ জানান, শান্তর রক্তে প্লেটলেট কমে গেছে। ৫১ হাজারে নেমে এসেছে। চিকিৎসকরা রক্ত দিতে বলেছেন। এক ইউনিট রক্ত লাগবে। কিন্তু এখনও এর ব্যবস্থা হয়নি।
তেজগাঁওয়ের বেগুনবাড়ির বাসিন্দা সোহাগ জানান, সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে তাদের এলাকায় মশা নিধনে কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
হলি ফ্যামিলির সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা বলছেন, এ বছর অধিকাংশ ডেঙ্গু রোগীই আশঙ্কাজনক অবস্থায় ভর্তি হচ্ছেন। অন্যান্য বছরের তুলনায় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি।
হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে ডেঙ্গুর প্রভাব শুরু হয়েছে গত মে’র কাছাকাছি সময় থেকে।
রাজধানীর রামপুরার তানজিলা নামে এক নারী ডেঙ্গু রোগ নিয়ে গত ১ মে এ বছরের মধ্যে প্রথম হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে ভর্তি হন। ১ মে থেকে ৭ জুলাই (রোববার) দুপুর দেড়টা পর্যন্ত মোট ২২২ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন এখানে। তাদের মধ্যে ২৬ জন রোগী তখন পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন।
১ মে থেকে ৭ জুলাই পর্যন্ত ৬৮ দিনের মধ্যে ৩০ দিন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি করেছে হাসপাতালটি। এই ৩০ দিনে গড়ে সাতজনের বেশি (৭ দশমিক ৪) মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এ হাসপাতালে ভর্তি হন।
হাসপাতালে কর্তব্য পালনরত সেবিকারা জানান, জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত কোনো মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এ হাসপাতালে ভর্তি হননি। মে থেকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে শুরু করেছে। এখন ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার হার অনেক বেশি।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো ডেঙ্গু প্রতিরোধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। এ জন্য ডেঙ্গু এত বিস্তার লাভ করতে পেরেছে।
এমএম ১/৫ বিছানায় ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি শান্তিবাগের সুরঞ্জন দাস। তার মা বলেন, ‘গ্রামের বাড়িতে কয়েকদিন আগে আমার ও আমার মেয়ের জ্বর হয়েছিল। ভয় পাইনি। কিন্তু ঢাকায় ছেলের যখন জ্বর আসল, ওতেই আমরা ভয় পেয়ে যাই। কারণ ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রভাব বেশি। সঙ্গে সঙ্গেই আমরা রক্ত পরীক্ষা করিয়েছি। ডেঙ্গু ধরা পড়েছে।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে সুরঞ্জন দাসের বাবা বলেন, ‘আগে থেকে সরকার সতর্ক হয় না। সতর্ক হয় পরে।’
সুরঞ্জন দাস জানান, রাস্তায় ছোট ছোট গর্ত করে কাজ করা হয়েছে। সেগুলো ভালোভাবে ঢালাই করা হয়নি। গর্ত রয়ে গেছে। সেখানে পানি জমে। বাসার আশপাশেও প্রচুর ময়লা।
এ হাসপাতালেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি আছেন রুফিয়া বেগম। তার মেয়ে আফরোজা আক্তার জানান, বাসার আশপাশ পরিষ্কার। তারপরও ডেঙ্গু হলো মায়ের।
হাসপাতালটির রোগীদের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তাদের সবাই ঢাকা মহানগরীর। ঢাকার বাইরের কাউকে ডেঙ্গু নিয়ে এ হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়নি। যেসব এলাকার মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- ইস্কাটন, মতিঝিল, মিন্টো রোড, রামপুরা, খিলগাঁও, বনগ্রাম, মগবাজার, শান্তিবাগ, মালিবাগ, বসুন্ধরা, শান্তিনগর, ওয়ারী, দারুস সালাম, বেগুনবাড়ি, সিদ্ধেশ্বরী, বাসাবো, রাজাবাজার, কে বি ঘোষ রোড, কলাবাগান, শাহাজাদপুর, মানিকনগর, বনশ্রী, টিকাতলী, গ্রিন রোড, বাড্ডা, গুলবাগ, কাফরুল, শাহাজাহানপুর, সবুজবাগ, বেগমবাড়ি, সতীশ সরকার রোড, বেইলি রোড, কাকরাইল, পুরানা পল্টন, নতুন পল্টন, নারিন্দা, অতীশ দীপঙ্কর রোড, মিরপুর, ফকিরাপুল, ফ্রি স্ট্রিট, তেজকুনিপাড়া। এদের মধ্যে ইস্কাটন, সিদ্ধেশ্বরী, রামপুরার রোগী তুলনামূলক বেশি।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, হলি ফ্যামিলিতে ১ মে তিনজন রোগী ভর্তি হন। এরপর ২৫ মে একজন, ২৯ মে চারজন, ১ জুন একজন, ৩ জুন চারজন, ৮ জুন পাঁচজন, ১১ জুন দুইজন, ১২ জুন ছয়জন, ১৩ জুন দুইজন, ১৫ জুন ১০ জন, ১৬ জুন দুইজন, ১৭ জুন ছয়জন, ১৮ জুন পাঁচজন, ১৯ জুন সাতজন, ১৯ জুন তিনজন, ২০ জুন পাঁচজন, ২২ জুন ১০ জন, ২৩ জুন সাতজন, ২৪ জুন আটজন, ২৫ জুন ১৫ জন, ২৬ জুন চারজন, ২৭ জুন ২১ জন, ২৯ জুন ১৮ জন, ৩০ জুলাই আটজন, ১ জুলাই আটজন, ২ জুলাই নয়জন, ৩ জুলাই নয়জন, ৪ জুলাই ১৫ জন, ৬ জুলাই ১৬ জন, ৭ জুলাই দুপুর দেড়টা পর্যন্ত আটজন ভর্তি হয়েছেন।
এ বিষয়ে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আবু হেনা মুস্তফা কামাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘আশঙ্কাজনক অবস্থায় রোগীরা ভর্তি হচ্ছেন। আশঙ্কাজনক বলতে আমরা প্লেটলেট কমে যাওয়াকে বলি। প্লেটলেট কমে যাওয়ার সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক বেশি।’
‘এ বছর ডেঙ্গুর সংখ্যা বেশি। সেই সঙ্গে এর ‘ডেপন্থে’ও বেশি অন্যান্য বছরের তুলনায়।’
এ চিকিৎসক আরও বলেন, ‘তবে শক নিয়ে রোগীরা খুবই কমই ভর্তি হচ্ছে। একজন বোধহয় শক নিয়ে ভর্তি হয়েছিল ১০ থেকে ১২ দিন আগে। সে বাইরে হয়তো কোনো জায়গায় ভর্তি ছিল। শকে অজ্ঞান অবস্থায় আমাদের এখানে আসছিল, পরে খুব সম্ভবত মারা গেছে। এরপর আর কেউ মারা গেছে বলে আমার নজরে নাই।’
পিডি/বিএ/পিআর