প্রিন্স মাহিদোল অ্যাওয়ার্ড পেলেন আইসিডিডিআরবি’র নির্বাহী পরিচালক
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) নির্বাহী পরিচালক এবং বিশিষ্ট বিজ্ঞানী প্রফেসর জন ডি. ক্লেমেন্স জনস্বাস্থ্য ক্ষেত্রে তার অসামান্য অবদানের জন্য প্রিন্স মাহিদোল পুরস্কার পেয়েছেন। ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে গবেষণা করে তিনি এবং তার সহকর্মী কলেরার টিকা উদ্ভাবন এবং বিশ্বব্যাপী এ টিকার সফল বিস্তারের স্বীকৃতিস্বরুপ এই সম্মানজনক পুরস্কার লাভ করলেন।
আইসিডিডিআরবির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সুইডেনের গোথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইয়ান আর. হোমগ্রেনের সঙ্গে তিনি যৌথভাবে এ পুরস্কার লাভ করেন। পুরস্কারটি বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্য উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে একটি শীর্ষস্থানীয় স্বীকৃতি। থাইল্যান্ডের প্রয়াত প্রিন্স মাহিদোলের নামানুসারে প্রতিবছর এই পুরস্কার প্রদান করা হয়। প্রিন্স মাহিদোল থাইল্যান্ডের আধুনিক মেডিসিন এবং জনস্বাস্থ্যের জনক হিসেবে খ্যাত।
প্রফেসর ক্লেমেন্স এবং প্রফেসর হোমগ্রেন দীর্ঘদিন যাবত আইসিডিডিআরবি-র সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং তিন দশকের বেশি সময় ধরে তারা মুখে খাওয়ার কলেরার টিকা (ওসিভি) নিয়ে কাজ করে চলেছেন।
গত বছরের নভেম্বরে আন্তর্জাতিক জুরি বোর্ডের নির্বাচনে তারা এ পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন এবং গত সপ্তাহে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদেরকে পুরস্কৃত করা হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে তাদেরকে পুরস্কৃত করেন প্রিন্স মাহিদোল ফাউন্ডেশনের সভাপতি এবং থাইল্যান্ডের রাজকুমারী মহা চক্রী সিরিধরন। মানবজাতির কল্যাণে নিরাপদ, কার্যকর, সাশ্রয়ী এবং আন্তর্জাতিকভাবে লাইসেন্সপ্রাপ্ত মুখে খাওয়ার এই কলেরার টিকা উদ্ভাবন এবং তার বিস্তারের জন্য তিনি প্রফেসর ক্লেমেন্স এবং তার সহকর্মীর ভূয়সী প্রশংসা করেন।
থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের রাজপ্রাসাদে অনুষ্ঠিত এ অনুষ্ঠানে আইসিডিডিআরবি-র উপ-নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, থাইল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. নাজমুল কাওনাইনসহ অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
সম্প্রতি আইসিডিডিআরবি, বাংলাদেশ সরকার এবং অন্যান্য সংস্থাগুলো মিলে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মাঝে দ্রুততম সময়ে প্রায় দশ লাখ ডোজ কলেরার টিকা প্রদান করে। যা বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম কলেরা টিকা দান কর্মসূচি হিসেবে বিবেচিত। এই দূরদর্শী টিকাদান কার্যক্রম সফল হওয়ায় রোহিঙ্গাদের মাঝে সম্ভাব্য কলেরার মহামারি প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
আশির দশকে প্রফেসর হোমগ্রেন এবং গোথেনবার্গ ইউনিভার্সিটির সহকর্মীরা মিলে মুখে খাওয়ার প্রথম কলেরার ভ্যাকসিন ডুকরাল আবিষ্কার করেন। ১৯৮৫ সালে প্রফেসর ক্লেমেন্স বাংলাদেশের চাঁদপুরের, মতলবে ওসিভির প্রথম গবেষণা করেন। তাতে তিনি দেখান যে, ওসিভি নিরাপদ এবং টিকা গ্রহণের তিন বছর পর্যন্ত কার্যকরী।
এই গবেষণার ফলাফল ওসিভি ডুকরালকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ছাড়পত্র পেতে এবং ৫০টি দেশে আন্তর্জাতিক লাইসেন্স অর্জনে সহায়তা করে।
২০১০ সালে হাইতিতে কলেরা মহামারি আকার ধারণ করে। সেসময় জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মাঝে কলেরা প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় এ টিকার প্রয়োজনীয়তা আরও ব্যাপকভাবে উপলব্ধ হয়। এ সময়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কলেরা মহামারি রোধে ওসিভি ব্যবহারের পরামর্শ দেয়। ফলে ২০১৩ সালে বিশ্বব্যাপী ব্যবহারের জন্য ওসিভির মজুদ শুরু করা হয়। এই মজুদ থেকে এ পর্যন্ত ৩ কোটি ৬০ লাখ টিকা ১০০টি কর্মসূচির মাধ্যমে ২০টি দেশে প্রদান করা হয়েছে।
সাশ্রয়ী মূল্যে এই টিকা উৎপাদনের জন্য বর্তমানে আইসিডিডিআরবি স্থানীয় ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির কাছে প্রযুক্তি হস্তান্তরে সহযোগিতা করছে। এতে স্থানীয়ভাবেই কলেরার টিকার চাহিদা মেটানোসহ বিশ্বের অন্যান্য কলেরা প্রবণ দেশেও এই টিকা রফতানি করা সম্ভব হবে।
প্রফেসর ক্লেমেন্স এ পুরস্কার প্রাপ্তিতে আইসিডিডিআরবি এবং বাংলাদেশের প্রতি তার গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘কলেরার টিকা উদ্ভাবনে আইসিডিডিআরবি, বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের জনগণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। প্রিন্স মাহিদোল পুরস্কারটি এই টিকার প্রসারে এক নতুন মাত্রা যোগ করল। সম্পদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও লাখ লাখ প্রাণ বাঁচানোর জন্য এই স্বীকৃতি আমাদের চলমান প্রচেষ্টাকে আরও বেগবান করবে।’
তিনি বলেন, ‘একটি জনগোষ্ঠীর ৬০ শতাংশ মানুষকে কলেরার টিকা দিলে সেই জনগোষ্ঠীর সবাই কার্যকরভাবে সুরক্ষা পেতে পারে। আমরা মনে করি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০৩০ সালের মধ্যে কলেরা নির্মূলের রোডম্যাপ বাস্তবায়নে কলেরার টিকা বিশেষ ভূমিকা রাখবে।’
প্রিন্স মাহিদোল ফাউন্ডেশন প্রতিবছর জনস্বাস্থ্য এবং মেডিসিন এই দু’টি বিভাগে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ব্যক্তি অথবা কোনো প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ পুরস্কার প্রদান করে থাকে। প্রতিটি পুরস্কারের সঙ্গে একটি মেডেল, একটি সনদ এবং এক লাখ মার্কিন ডলার দেয়া হয়।
এমইউ/এসআর/পিআর