রাতে পঙ্গু হাসপাতালে রোগীদের অব্যক্ত যন্ত্রণা!
হাত থেকে অনবরত রক্ত ঝরছে। সাদা ব্যান্ডেজ ভিজে চুপচুপ লাল। সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ২২ বছর বয়সী এই তরুণের হাত উচুঁ করে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন তারই সমবয়সী আরেক তরুণ। দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে অপারেশন থিয়েটারের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভেতর থেকে চিকিৎসকের ডাক পাওয়ার অপেক্ষায়।
মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত আরেক বৃদ্ধ রোগী ব্যথায় কাতরাচ্ছেন অদূরে ট্রলিতে। ছোট্ট এক শিশু সাইকেল চালাতে গিয়ে হাত দু'টুকরা। ব্যথায় চিৎকার করছে শিশুটি। উদ্বিগ্ন শিশুটির মা টয়লেটের ভেতরে ঢুকে দৌড়ে বের হয়ে এসে স্বামীকে বললেন, ভেতরে ময়লা উপচে পড়ছে। দরজায় ছিটকিনি নেই।
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আরেক ব্যক্তির আত্মীয় এসে বললেন, এতক্ষণ রোগীর অপারেশনের সিরিয়াল কতো তাই জানতে পারলাম না। ওটির এক বয়কে দুই হাজার টাকা বকশিস দিয়ে দ্রুত অস্ত্রোপচার করিয়ে দেবে রাজি করিয়েছি।
এ দৃশ্যপট সোমবার (৭ জানুয়ারি) রাত ১২টায় রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) জরুরি অস্ত্রোপচার কক্ষের সামনের। এ প্রতিবেদকও আহত এক আত্মীয়কে সঙ্গে নিয়ে সরেজমিন জরুরি অস্ত্রোপচার কক্ষের সামনে রোগীদের অব্যক্ত যন্ত্রণার দৃশ্য অবলোকন করেন।
ডাক্তার ও নার্সদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, অন্যদিনের চেয়ে সোমবার রাতে অস্ত্রোপচারের রোগীর চাপ বেশি ছিল। অস্ত্রোপচার কক্ষের সামনে পা ফেলার জো নেই। কেউ মাটিতে, কেউ ট্রলিতে কেউবা আবার নার্সশূন্য কক্ষের ভেতরে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা চেয়ারে বসে অস্ত্রোপচারের জন্য ডাক্তারের ডাকের অপেক্ষা করছেন।
জরুরি বিভাগ থেকে রেফার হয়ে বেশ লম্বা বারান্দাপথ পাড়ি দিয়ে ওটির সামনে আসলে ওয়ার্ডবয়রা ফাইল ভেতরে নিয়ে যাচ্ছেন। এরপর সিরিয়াল না মেনেই কাউকে ডেকে নিচ্ছেন, আবার কাউকে অপেক্ষা করতে বলছেন। কেউ কেউ ঘনঘন বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছেন ওষুধ ও ইনজেকশন কিনে আনতে।
রোগীদের ট্রলিতে ঠেলে যারা নিয়ে আসছেন তারা ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বকশিস না দিলে সেখান থেকে যাচ্ছেন না। টাকার পরিমাণ পছন্দ না হলে উল্টো দু-চার কথা শুনিয়ে দিচ্ছেন।
জরুরি অস্ত্রোপচার কক্ষটির বাইরে দুটি টয়লেট থাকলেও তা ব্যবহারের অনুপযোগী। টয়লেটে উপচে ময়লা পানি পড়ছে। একটিতে ছিটকিনি নেই।
এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন রোগীর অভিভাবক জানান, রাত ১টায় ডাক্তার তার রোগীকে ওটিতে নিতে বলেন। তাকে ডেকে একটি স্লিপ লিখে ব্যান্ডেজ কিনে আনতে পাঠান। প্রাথমিক অস্ত্রোপচার শেষে ভাঙা হাত জায়গামতো বসেছে কি না তা এক্সরে করে দেখতে জরুরি বিভাগের সামনের এক্সরে বিভাগে পাঠান। এক্সরে যিনি করছিলেন তিনি সাড়ে ৩০০ টাকা চান। রশিদ চাইলে তিনি সামনের কাউন্টার থেকে আনতে বলেন। এ সময় কাউন্টারের লোকটি ২৫০টাকা রাখেন। ভেতরে গিয়ে সাড়ে ৩০০ টাকা চাওয়ার কারণ জানতে চাইলে ওই ব্যক্তি উত্তেজিত হয়ে ওঠেন।
আরেক ব্যক্তি জানান, তার রোগীর অস্ত্রোপচারের জন্য ডাক্তার রক্ত পরীক্ষা করে রাখতে বলেছিলেন। কাউন্টারে গিয়ে রশিদ কেটে টাকা দিতে চাইলে কাউন্টার থেকে বলা হয়, রশিদ দিয়ে রিপোর্ট চাইলে আজ দেয়া সম্ভব না, কাল রিপোর্ট পাবেন। নিরুপায় হয়ে নগদ ৪০০ টাকা দিয়ে রিপোর্ট করাতে রাজি হন তিনি।
এক্সরে ফ্লিম নিয়ে ফিরে আসলে ডাক্তার জানান, রোগীকে রাতে থাকতে হবে। সিট খালি নেই। কিছুক্ষণ পর এক ওয়ার্ডবয় জানান, দুই হাজার টাকা দিলে মহিলা ওয়ার্ডে সিট দেয়া যাবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চিকিৎসক বলেন, জরুরি অস্ত্রোপচার কক্ষে রোগীদের অতিরিক্ত চাপ থাকে। তারা রোগীদের দিয়ে পারত পক্ষে কোনও ওষুধপত্র কিনিয়ে আনেন না। কিন্তু ওয়ার্ডবয়সহ কিছু দালাল সিন্ডিকেট করে রোগীদের নানাভাবে প্রতারণায় ফেলেন, ওষুধপত্র কিনিয়ে আনেন, বকশিসের নামে নগদ টাকা নেন বলে আমরাও অভিযোগ পাই।
এমইউ/জেডএ