জরায়ু মুখের ক্যান্সার সম্পর্কে যেসব তথ্য জানা জরুরি
আন্তর্জাতিক ক্যান্সার গবেষণা এজেন্সি সাম্প্রতিক এক জরিপে বলছে- বাংলাদেশে বছরে সাড়ে ছয় হাজারের বেশি নারী জরায়ু মুখের ক্যান্সারে মারা যাচ্ছে। প্রতি বছর নতুন করে ১২ হাজারের মতো নারীর শরীরে এই ক্যান্সার শনাক্ত হচ্ছে।
অথচ অন্য ধরনের ক্যান্সারের তুলনায় জরায়ু মুখের ক্যান্সার খুব সহজে নির্ণয় করা যায়। এমনকি হওয়ার আগেই ধরা যায়। তাছাড়া দেশের সকল সরকারি হাসপাতাল, এমনকি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও এটি নির্ণয়ের প্রাথমিক ধাপটি বিনামূল্যে পাওয়া যায়। তবুও বাংলাদেশে জরায়ু মুখের ক্যান্সারের হার এত বেশি কেন?
এ বিষয়ে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউটের হাসপাতালের গাইনি অংকলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আফরোজা খানম বলেন, জরায়ু মুখের ক্যান্সারের মূল সমস্যা হলো এটি শেষ পর্যায়ে গেলেই শুধু ব্যথা অনুভূত হয়। এর লক্ষণগুলোকে অনেকেই মাসিকের মেয়েলি সমস্যা বলে ভুল করে থাকেন।
প্রথম পর্যায়ে ব্যথা একদমই থাকে না। যখন শেষ পর্যায়ে চলে যায়, যখন রোগটা অনেক দূর ছড়িয়ে যায়, তখন ব্যাথা করে। হাড়ের মধ্যে চলে যায়। এই পর্যায়ে গিয়ে ব্যথা হয়।
তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে কোনো ব্যথা থাকে না দেখেই কিন্তু আমাদের দেশের নারীরা আসে না। প্রিভেনশন তো বোঝেই না, যখন হয়, হওয়ার পরেও তারা অপেক্ষা করে। দেখা যায় দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব যাচ্ছে কিন্তু লজ্জায় সে কাউকে বলছে না। স্বামীর সঙ্গে মেলামেশায় রক্ত যাচ্ছে সেটিও সে বলছে না।
তিনি আরও বলেন, জরায়ু মুখের ক্যান্সার নিয়ে হাসপাতালে যেসব নারীরা আসেন তাদের বেশিরভাগেরই বড্ড দেরি করে আসেন। যখন আসেন তখন আর তেমন কিছুই করার থাকে না। অথচ এতদূর পর্যন্ত এটি গড়ানোরই কথা নয়। কারণ অন্য ধরনের ক্যান্সারের তুলনায় জরায়ু মুখের ক্যান্সার সবচাইতে সহজে নির্ণয় করা যায়। এমনকি হওয়ার আগেই খুব সহজ পরীক্ষায় ধরা যায় ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা। জীবাণু প্রবেশের পর জরায়ু-মুখের ক্যান্সার হতে ১৫ থেকে ২০ বছরও সময় লাগে।
বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির হাসপাতালের সিনিয়র মেডিকেল অফিসার ডা. জেবুন্নেসা বেগম জরায়ু মুখের ক্যান্সার স্ক্রিনিং সম্পর্কে প্রচারে সহায়তা করেন।
জরায়ু মুখের ক্যান্সার সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘যে দুই প্রকার প্যাপিলোমা ভাইরাস দিয়ে এই ক্যান্সার হয়, সহবাসের মাধ্যমেই সেটি স্প্রেড হয়। ভাইরাসটি ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই ক্যান্সার হয় না। অন্য ক্যান্সারে জীবাণুটি ঢোকার পরে আমরা সময় খুব একটা পাই না। কিন্তু জরায়ু-মুখের ক্যান্সারে ১৫ থেকে ২০ বছরও সময় লাগে জীবাণু প্রবেশের পর ক্যান্সারটি হতে। তার মানে হলো এটি নির্ণয়ে এতটা সময় পাওয়া যায়। নিয়মিত স্ক্রিনিং করালে ইনিশিয়ালি আমরা জার্মটা কমাই দিতে পারি।’
ডা. জেবুন্নেসা বলেন, ক্যান্সার শব্দটি শুনলে বেশিরভাগ মানুষের মাথায় সম্ভবত ভীতিকর কিছুর অনুভূতি হয়। কিন্তু এর সঙ্গে যখনি জরায়ু মুখ শব্দটি যুক্ত হয় তখন অনেকেই এ নিয়ে কথা বলায় যেন সংকোচ বোধ করেন। আর এর সঙ্গে যৌন সম্পর্কের বিষয়টি যুক্ত থাকায় সে নিয়ে কথা বলায় রয়েছে আরও আড়ষ্টতা। এমনকি চিকিৎসকেরাও তার বাইরে নন। অথচ জরায়ু মুখের ক্যান্সার নির্ণয়ের পরীক্ষার প্রাথমিক ধাপটি অত্যন্ত সহজ। সময়ও লাগে মাত্র এক মিনিট।
তিনি বলেন, ‘এর স্ক্রিনিংটা খুবই সহজ। কোনো যন্ত্রপাতি লাগে না। আমরা সবাই ভিনেগার বা সিরকার সম্পর্কে শুনেছি। সেটি ডাইলুট করে তুলায় লাগিয়ে জরায়ুর মুখে লাগিয়ে এক মিনিট রেখে দিলে যায়গাটা যদি সাদা হয়ে যায় তখন মনে করতে হবে এটি ক্যান্সারের পূর্বাভাস। তখন আমরা সেটি কোনো পর্যায়ে আছে তা জানতে মাইক্রোস্কোপ দিয়ে বাকি পরীক্ষা করতে পাঠাই। এমনও হয় খুব প্রাথমিক হলে সেখানেই রোগীর জরায়ুতে ইলেকট্রিক সেক দিয়ে দেয়া হয়। সেটাতেও কয়েক মিনিট লাগে।’
বাংলাদেশের সব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সরকারি জেলা সদর হাসপাতাল, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র, এমনকি নির্বাচিত কিছু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে জরায়ু মুখের ক্যান্সার নির্ণয়ের প্রাথমিক ধাপটি বিনামূল্যে পাওয়া যায়। অর্থাৎ বিবাহিত ও যৌন সংসর্গ আছে এমন নারীরা সিরকা দিয়ে পরীক্ষার সহজ এই ধাপটি করিয়ে নিলেই জেনে যাবেন তার এই ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা।
বয়স তিরিশ হওয়ার পর থেকে প্রতি তিন থেকে পাঁচ বছর পর পর একবার এই পরীক্ষাটি করিয়ে নিতে বলেন চিকিৎসকেরা। কিন্তু এত সহজ ও বিনামূল্যে সেবা থাকা সত্ত্বেও জরায়ু মুখের ক্যান্সার বাংলাদেশে নারীদের মধ্যে দ্বিতীয় প্রধান ক্যান্সার। এতে বছরে মারা যাচ্ছে সাড়ে ছয় হাজারের বেশি। নতুন করে ১২ হাজারের মতো নারীর শরীরে এই ক্যান্সার শনাক্ত হচ্ছে।
ডা. আফরোজা খানম বলেন, ‘এর শনাক্তকরণের বিনামূল্যের সেবাটি সম্পর্কে তথ্য নারীরা অনেকেই জানেন না। জানলেও সংসার ফেলে সময় ও আর্থিক সমস্যার কারণে আসতে পারেন না। আবার অনেকেই বলেন আমার ক্যান্সার হয় নাই আমি কেন যাবো। স্ক্রিনিং এর উপকারটি সম্পর্কে তাদের জানাটা খুব জরুরি।’
বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটি নির্বাহী কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. এম এ হাই বলছেন এর পেছনে প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা একটি সাংস্কৃতিক কারণ রয়েছে। বাংলাদেশে মেয়েদের খুব অল্প বয়সে বিয়ে আর ঘন ঘন সন্তান জন্মদানকেই বলা হচ্ছে এর প্রধান কারণ।
তিনি বলছেন, ‘আমাদের কালচারাল বিষয় হলো এখানে অল্প বয়সে বিয়ে হয় আর অনেক বাচ্চা হয়। এত অল্প বয়সে সবকিছু ঠিকমতো গঠনই হয়নি। তার মধ্যেই যৌন সঙ্গম আর খুব অল্প বয়সে বাচ্চা নেয়া। এতে জরায়ু মুখের উপর অনেক চাপ পড়ে। যেহেতু তারা অপুষ্টিতে ভোগে তাই তাদের সেরে উঠতে সময় লাগে। তাতে দেখা যাচ্ছে জরায়ু মুখের রিপেয়ারটা ভালোমতো হয় না। এভাবে বারবার বাচ্চা হতে গিয়ে যদি বারবার ড্যামেজ হয় তাহলে ওখানে একটা অ্যাবনরমাল সেল তৈরি হতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এর অর্থনৈতিক কারণও আছে। যেমন মেয়েরা যারা খাটাখাটি করে ফ্যামিলিতে হয়ত তাদের ঠিকমত দেখাশোনা করে না। তাদেরকে সময়মত ডাক্তারের কাছে নেয়া হয় না। সে নিজে অর্থের অভাবে যেতে পারে না। আর বাংলাদেশে নারীদের স্বভাবই হলো সবাই খাওয়ার পরে কিছু থাকলে খায় না থাকলে খায় না।’
ডা. হাই জানান, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কারণের সঙ্গে শিক্ষারও একটি বিষয় রয়েছে। তারই করা এক গবেষণায় তিনি দেখেছেন বাংলাদেশে যৌনাঙ্গের পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে শিক্ষার মারাত্মক অভাব।
তিনি বলেন, ‘আমি আমার এক স্টাডিতে দেখেছি যে বাংলাদেশে গ্রামে ৭৫ শতাংশ নারীর জরায়ু-মুখে ইনফেকশন আছে। এর কারণ হচ্ছে সেক্সুয়াল অর্গানের পরিচ্ছন্নতার অভাব। এই পরিচ্ছন্নতা তাকে নিজেকে যেমন বজায় রাখতে হবে তেমনি তার পুরুষ সঙ্গীকেও সমানভাবে রাখতে হবে। নারীরা লজ্জায় মুখ ফুটে কিছু বলে না সেই সংস্কৃতিকে পরিবর্তন করতে হবে। বাড়ির পুরুষ সদস্যদের এ ব্যাপারে তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারতে হবে।’
কিন্তু ডা. আফরোজা খানম হতাশা প্রকাশ করে বলছেন, ‘দেশে মেয়েরা রূপচর্চার জন্য যে সময় ও অর্থ ব্যয় করে সেটি যদি তারা নিজেদের স্বাস্থ্যের জন্য করতো। চেহারা দেখা যায় তাই আমরা তার পেছনে সময় দিচ্ছি। কিন্তু আমার জরায়ু আমাকে মা হতে সাহায্য করে। এটির গুরুত্ব তাদের বোঝা উচিত।
এর বাইরে যেসব নারীর বহু পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক, তারা রয়েছেন বেশি ঝুঁকিতে। অথবা যেসব পুরুষের অনেক যৌন সঙ্গী রয়েছে তারাও নারী সঙ্গীদের বেশি ঝুঁকিতে ফেলছেন।’
তবে এই ক্যান্সার সম্পর্কে আরেকটি ভালো বিষয় হলো- এটিই একমাত্র ক্যান্সার যার টিকা রয়েছে। যা দেয়ার উপযুক্ত সময় হলো মেয়েদের যৌন জীবন শুরুর আগে।
এমবিআর/এমএস