‘কিডনি রোগ থেকে বাঁচতে সচেতনতার বিকল্প নেই’

কিডনি রোগ বিশ্বজুড়ে ক্রমাগত বেড়েই চলছে। বাংলাদেশেও এই রোগের প্রাদুর্ভাব উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। এই রোগের কারণে শুধু ব্যক্তিগত জীবনই বিপর্যস্ত হয় না বরং এই রোগ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপরও বিশাল অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে। কিডনি রোগের মারাত্মক পরিণতি, অতিরিক্ত চিকিৎসা খরচ এবং চিকিৎসা ব্যয় সাধ্যাতীত হওয়ায় সিংহভাগ রোগী প্রায় বিনা চিকিৎসায়ই মারা যায়। তবে সচেতনতা এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে কিডনি রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
মঙ্গলবার (১১ মার্চ) জাতীয় প্রেসক্লাবে কিডনি স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রতিবন্ধকতা ও উত্তরণ: প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা বলেন বক্তারা।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিশ্ব কিডনি দিবস-২০২৫ উপলক্ষে আয়োজিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে দেশের শীর্ষস্থানীয় কিডনি বিষয়ক বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কিডনি অ্যাওয়ারনেস মনিটরিং অ্যান্ড প্রিভেনশন সোসাইটি (ক্যাম্পস) এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। সহযোগী সংগঠন হিসেবে ছিল বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশন।
গোলটেবিল বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ক্যাম্পস এর প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ। মূল প্রবন্ধে তিনি বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী-কিডনি রোগ বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে একটি। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কিডনি রোগের প্রকোপ বাড়ছে। বিশেষ করে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং স্থূলতার মতো অসংক্রামক রোগের কারণে। বিশ্বব্যাপী প্রায় ৮৫ কোটি মানুষ শুধু দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্ত। এই সংখ্যা ডায়াবেটিস রোগীদের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ এবং ক্যানসার রোগীদের চেয়ে প্রায় ২০ গুণ। মৃত্যুর কারণ হিসেবে কিডনি রোগ ১৯৯০ সালে ছিল ১৯তম স্থানে, বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৭ম স্থানে। এভাবে চলতে থাকলে ২০৪০ সালে দখল করে নেবে ৫ম স্থান। আবার উন্নয়নশীল বা স্বল্পোন্নত দেশে কিডনি রোগের হার সবচেয়ে বেশি।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
তিনি বলেন, বাংলাদেশেও কিডনি রোগের প্রাদুর্ভাব উদ্বেগজনক। তথ্য মতে, প্রায় ৩ কোটি ৮০ লাখ লোক কোনো না কোনো কিডনি রোগে আক্রান্ত। এর মধ্যে প্রতি বছর প্রায় ৪০ হাজার কিডনি রোগী ডায়ালাইসিসের ওপর নির্ভরশীল হয়। শহর ও গ্রামাঞ্চলে সমানভাবে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। দারিদ্র্য, অসচেতনতা, চিকিৎসা সেবার অপ্রতুলতা এবং অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এই সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। আরও ২৪ থেকে ৩০ হাজার রোগী হঠাৎ কিডনি বিকল হয়ে সাময়িক ডায়ালাইসিস প্রয়োজন হয়। এই রোগ আমাদের দেশের জন্য একটি বড় অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা। পক্ষান্তরে সবাই যদি কিডনি রোগের ব্যাপকতা, ভয়াবহতা, পরিণতি ও কারণ সম্পর্কে সচেতন থাকে এবং স্বাস্থ্য সম্মত জীবনযাপন করে তা হলে ৬০-৭০ ভাগ ক্ষেত্রে এই মরণঘাতী কিডনি বিকল প্রতিরোধ করা সম্ভব।
অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, স্থূলতা, নেফ্রাইটিস, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ধূমপান, নিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, বংশগত কিডনি রোগ, মূত্রতন্ত্রের প্রদাহ ও পাথুরে রোগী কিডনি রোগের সাধারণ কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম উল্লেখ করে ডা. সামাদ বলেন, কিডনি বিকলের চিকিৎসা সর্বাধিক ব্যয়বহুল। ফলে চিকিৎসা করতে গিয়ে পুরো পরিবার নিঃস্ব হয়ে যায়। তাই ক্যাম্পস এর স্লোগান ‘কিডনি রোগ জীবননাশা-প্রতিরোধই বাঁচার আশা’ ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে চাই। এই রোগ প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত করে চিকিৎসার মাধ্যমে প্রতিরোধ করা যায়। এর জন্য প্রয়োজন গণসচেতনতা।
বিজ্ঞাপন
কিডনি ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন-উর-রশিদ কিডনি রোগকে নীরব দুর্যোগ আখ্যায়িত করে বলেন, এ রোগের জটিলতা ও চিকিৎসা ব্যয়ের আধিক্য বিবেচনায় প্রতিরোধকেই একমাত্র অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। পৃথিবীর অন্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশেও ডায়াবেটিস বেড়ে যাচ্ছে। ২০০৬ সালে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ছিল ৬ শতাংশ। এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ শতাংশে। ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ রোগী জানেই না সে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। কিডনি রোগের জন্য ডায়াবেটিকস অন্যতম দায়ী।
তিনি বলেন, আমরা বারবার বলে আসছি সারাদেশে ১৮ হাজার ৫০০ কমিউনিটি ক্লিনিক আছে। এসব ক্লিনিকে যদি ১৫০ টাকা খরচ করে উচ্চ রক্তচাপ, ইউরিন, ডায়াবেটিকস টেস্টের ব্যবস্থা করে তাহলে আমরা কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়ার আগেই প্রিভেনশন করা যাবে।
অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ রফিকুল আলম বলেন, কিডনি রোগ প্রতিরোধে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিতে হবে। এ জন্য একটি সুষ্ঠু কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। বিশেষ করে বাচ্চাদের এবং যুব সমাজের মধ্যে যাতে কিডনি রোগ প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিজ্ঞাপন
ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব গাজী আশরাফ হোসেন বলেন, বিশেষ করে বাচ্চাদের এবং যুব সমাজের মধ্যে যাতে কিডনি রোগ প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য নিয়মিত খেলাধুলা, নিয়মিত হাঁটা ও ব্যায়াম করার ব্যবস্থা নিতে হবে। কঠিনভাবে তাদের ফাস্টফুড, জাঙ্কফুড, অলসতার প্রবণতা থেকে মুক্ত করতে হবে।
বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মো নজরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে কিডনি রোগের প্রার্দুভাব বেড়েই চলছে। গত ১০ বছরে দেড় কোটি কিডনি রোগীর সংখ্যা বেড়ে এখন সাড়ে ৩ কোটি। তবে আমরা আশা রাখছি জেলা পর্যায়ে ডায়ালায়সিস সেন্টার চালু হচ্ছে। এতে সেবা সহজলভ্য হবে। কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট নিয়ে সমস্যা হচ্ছে দাতা সংকট। ট্রান্সপ্লান্টের জন্য যে আইন আছে সেটি সংশোধনের পর্যায়ে আছে। আইনটি সংশোধন হলে সংকট অনেকটা কেটে যাবে। আমাদের খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন করতে হবে। বিশেষ করে স্কুল কলেজে বাচ্চাদের ফাস্ট-ফুড খাবার গ্রহণ কমিয়ে দিতে হবে। কেননা স্থূলতার জন্য কিডনি সমস্যা বেশী হয়।
পেডিয়াট্রিক নেফ্রোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক ডা. আফরোজা বেগম বলেন, শিশুদের কিডনি রোগ অনেকাংশেই প্রতিরোধ করা সম্ভব। অপরিণত বাচ্চা জন্মগ্রহণ করতে তাকে নিয়মিত ফলোআপে রাখতে হবে। কিডনি সমস্যায় থাকা বাচ্চাদের বেশিরভাগই ইউরিনে ইনফেকশন করে। খুব দ্রুত বাচ্চাদের চিকিৎসা করলে কিডনি নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি কম থাকে।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যসচিব ডা. ফরহাদ হোসেন চৌধুরী বলেন, আমাদের মূল লক্ষ্য কিডনি রোগীদের সঠিক চিকিৎসা দেওয়া। এখন কিডনি চিকিৎসার দুটি উপায় আছে। একটি ডায়ালায়সিস এবং কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করা। দেশের ৪৪ টি জেলা সদর হাসপাতালে ডায়ালাইসিস সেন্টারের পরিকল্পনা আছে সরকারের। তবে পর্যাপ্ত চিকিৎসক, নার্স নেই। বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স প্রয়োজন। ৯৫ জন চিকিৎসক সরকারি মেডিকেল থেকে কিডনি বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করেছেন। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে কিডনি বিষয়ে ডাক্তারের সংখ্যা ৩৫০ জনের মতো। আমাদের আরও বেশি অভিজ্ঞ চিকিৎসক প্রয়োজন।
গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা অভিমত ব্যক্ত করেন যে, চিকিৎসা করে নয় বরং প্রতিরোধ করেই এ রোগের প্রাদুর্ভাব প্রশমন করতে হবে। আর এ জন্য সচেতনতাই একমাত্র উপায়। কিডনি রোগ প্রতিরোধে গণসচেতনতা বৃদ্ধি করতে ক্যাম্পস এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার প্রশংসা করেন এবং বিত্তবানদের এমন মহৎ কাজে সহযোগিতা আহ্বান জানান।
এছাড়াও গোলটেবিল বৈঠকে দেশের সরকারি পর্যায়ের নীতি নির্ধারক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, শিল্পী, শিক্ষাবিদসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
বিজ্ঞাপন
এনএস/এমআইএইচএস/জিকেএস
বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ - স্বাস্থ্য
- ১ নবজাতকের গোড়ালির রক্ত পরীক্ষায় নির্ণয় করা যেতে পারে ভবিষ্যৎ রোগ
- ২ সরকারি হাসপাতালগুলোতে ২৪ ঘণ্টা ল্যাব খোলা রাখা উচিত: জয়নাল আবেদিন
- ৩ বিএমইউ সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট চালু
- ৪ চমেক হাসপাতালের জন্য নতুন এনজিওগ্রাম মেশিন কেনা হচ্ছে
- ৫ ‘ওষুধের কাঁচামাল আমদানিনির্ভর হওয়ায় দাম কমানো চ্যালেঞ্জিং’