আমার কর্পোরেট মা!
শিরোনাম দেখে অবাক লাগছে? লাগারই কথা! খুলেই বলি, আমার মা চাকরিজীবী। তাই সন্তানকে হাতের তালুতে করে বড় করা যাকে বলে সেভাবে কখনোই আমাদের বড় করতে পারেননি তিনি। কিন্তু যেটুকু সময় আমাদের দিতে পেরেছেন এবং যা শিখিয়েছেন- আমাদের বেড়ে ওঠা কিংবা জীবন পরিচালনার জন্য তা যথেষ্ট। মা আমায় শিখিয়েছেন, ‘Be the rain, but be the storm where necessary.’
মায়ের হাতেই প্রথম বর্ণ পরিচয় ও আঁকাআঁকি। অ-আ, ক-খ লেখার ও শেখার প্রাণান্ত চেষ্টা। সন্ধ্যায় সুর তুলে ‘আম পাতা জোড়া জোড়া’ কিংবা ‘ঐ দেখা যায় তালগাছ’ পড়া। মায়ের হাত ধরেই চলতো সব। তবে মা আমাদের কখনোই পরীক্ষার হলে নিয়ে যাননি, কিন্তু কী করে একা একা গিয়ে ভালো পরীক্ষা দিয়ে ফিরে আসা যায়- সেটা শিখিয়ে দিয়েছেন।
ছোটবেলায় যখন খেতে চাইতাম না‚ মা কখনোই জোর করে খাওয়ানো তো দূরে থাক- বলতোই না! তার বদলে আমার প্রিয় খাবার রান্না করে পাশের বাড়ির পিচ্চিগুলোকে ডেকে খেতে বসাতো। আর যাই কোথায়? ওদের খাওয়া দেখে আমারও রীতিমতো জিভে জল!
একটু যখন বুঝতে শিখলাম তখন আমাদের বাসা পরিবর্তন করা হলো। নতুন একটা জায়গা, নতুন পরিবেশ। মা বললেন, ‘আগে সময় নাও, তারপর বন্ধু তৈরি করো।’ এই একটি কথা আমি কেন জানি এখনো মানতে পারি না। আর তাতেই যত্সব ঝামেলায় পড়ে যাই সব ভুল মানুষের সঙ্গে মিশতে গিয়ে।
প্রাথমিকে যখন উপজেলায় ভালো অবস্থান নিয়ে বৃত্তি পেলাম- মায়ের সে কী আনন্দ! মা তখন মিষ্টি নিয়ে স্কুলে... এই প্রথম আমার স্কুলে আমার মায়ের আগমন! বৃত্তি পাওয়ার আগে যখন উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হবো- আমার ইচ্ছে ছিলো বাসা থেকে তিন কিলোমিটার দূরে আমাদের এলাকার ভালো স্কুলে ভর্তি হওয়ার। বাবা ভয় পাচ্ছিলেন; কিন্তু মা বললেন, ‘আমার মেয়ে তো- পারবে!’ অষ্টম শ্রেণিতে যখন জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা; তখন মায়ের সঙ্গে অভিমান করেই পরীক্ষাটা খারাপ হলো। মায়েরই মেয়ে তো! রাগ বা জেদটা একটু বেশিই। তারপরও বৃত্তি পেলাম!
এবার নবম শ্রেণির বিভাগ নির্বাচন! আমি ভেবেছিলাম গ্রামের স্কুল, অত ভালো পড়াশোনাও হয় না! কারণ ওই সময়টায় আমার স্কুলে সব বিষয়ের শিক্ষক ছিলেন না। সেদিন আবার মা স্কুলে গেলেন। শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে আমাকে বললেন, ‘বিজ্ঞানই নাও।’ নিলাম বিজ্ঞান! এসএসসিতেও মোটামুটি ভালো রেজাল্ট করলাম। জিপিএ ফাইভ পেলেও পদার্থবিজ্ঞানে মিস করলাম। বলতে গেলে এ পর্যন্ত মা কখনোই কোনোদিন আমাকে পড়তে বসতে বলেননি।
যখন এইচএসসি’র জন্য প্রস্তুতি... গ্রামের কলেজেই ভর্তি হলাম। কারণ আমি আবার মায়ের হাতের রান্না ছাড়া তখনো কিছু খেতে শিখিনি। তবে এখানে পেলাম অসাধারণ কয়েকজন শিক্ষকের সান্নিধ্য। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, এইবার মা আমার পড়াশোনায় খবরদারি শুরু করলেন। যা হোক, এবারও গোল্ডেন ফাইভ নিয়ে উত্তীর্ণ হলাম।
এরইমধ্যে ঘটে গেছে অনেক ঘটনা। আমরা সবসময় রোজার ঈদ নানাবাড়িতে এবং কোরবানির ঈদ দাদাবাড়িতে করতাম। আমরা জেলা শহরে যাওয়ার কয়েকমাস পরে... তখনো মুঠোফোন এতটা সহজলভ্য ছিল না। খবর এলো- আমার নানাভাই আর নেই। তখন এই প্রথম আমি আমার মাকে কাঁদতে দেখলাম!
আমার দাদা-দাদি দু’জনই শেষ বয়সটা আমাদের বাসাতেই ছিলেন। মা বলতেন, ‘আমি যদি আমার শ্বশুর-শাশুড়ির অবহেলা করি, আমিও একদিন অবহেলিত হবো।’ শত ব্যস্ততার মাঝেও মা চেষ্টা করতেন সবার খাবারটা নিজ হাতেই রান্না করতে। এ ব্যাপারে বাবা মাকে যথেষ্ট সাহায্য করতেন।
আর ছোটবেলা থেকে দেখেছি- আমাদের বাসায় সপ্তাহে অন্তত পাঁচদিন অতিথি থাকতো। যেদিন কেউ না থাকে, মা তার সহকর্মীদের আমন্ত্রণ জানায়- মাংস আর ভুনাখিচুড়ি খাওয়ার জন্য। সেটা ছিলো অমৃত সমান।
সব শিক্ষাই আমি আমার মায়ের কাছ থেকে পেয়েছি, তবে এতে বাবারও অবদান ছিলো। আমাকে মা গান শেখানোর অনেক চেষ্টা করেছেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমার দ্বারা হয়নি। টুকটাক নাচ কিন্তু শিখিয়েছেন। ছুটির দিনগুলোতে মা আমাদের নিয়ে ঘুরতে বের হতেন। কিংবা বাসার ছাদে পিকনিক করতেন।
এখন আমি অনেক বড় হয়ে গেছি! বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। নিজের মতো থাকতে শিখেছি। মায়ের হাতের রান্না ছাড়াও দিব্যি পেটপুরে খেয়ে নিই। উৎসবে নিজে নিজেই শাড়ি পরি। সাজগোছও করি। বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দে মেতে উঠি। সারাদিনে একবার দু’বার কিংবা সর্বোচ্চ তিনবার কথা বলি মায়ের সঙ্গে। কোনো ভুলের জন্য কিংবা অকারণে রাগের জন্য দুঃখিত বলতে পারলেও মুখ ফুটে একটা কথা কখনোই বলতে পারি না- ‘অনেক ভালোবাসি তোমায় মা’।
লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
এসইউ/আরআইপি