আগামীর শাসকের কাছে তরুণদের প্রত্যাশা
গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেড় যুগেরও অধিক সময়ের পর পতন ঘটেছে আওয়ামী সরকারের। নতুন গড়ে ওঠা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মানুষের মাঝে সঞ্চার করেছে আশা, উদ্দীপনার। দেশের সব অন্যায়, অবিচারকে রুখে দিতে ছাত্রসমাজ আজ বদ্ধপরিকর। জনগণবান্ধব শাসক এখন সবার চাওয়া। মানুষ আশা করে দেশ ও দশের কথা ভেবে আগামীর শাসক কাজ করবেন এবং মৌলিক অধিকার থেকে দুর্নীতি সবদিকই সমান গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবেন তিনি।
আগামীর শাসকের কাছে জনগনের চাওয়া-পাওয়া ও প্রত্যাশা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীর ভাবনা ও মতামত তুলে ধরেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী মাকসুদা আক্তার-
সমাজের সংস্কার প্রয়োজন রন্ধ্রে রন্ধ্রে
মহিমা ইসলাম রিমি
বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আমি এমন একটি বাংলাদেশ চাই যেখানে কোনো ক্ষেত্রেই বৈষম্যের অস্তিত্ব থাকবে না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেপথ্যে মূল মোটিফও এটি। দেশ সংস্কারের যে সুযোগ এসেছে তা সবাইকে কাজে লাগাতে হবে আন্তরিকভাবে। ঢেলে সাজাতে হবে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রকে। প্রথমেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স হতে হবে। শিক্ষা কারিকুলাম হতে হবে বাস্তব ও জীবনমুখী। দীর্ঘ সময়ের পড়াশোনা শেষে কোনো শিক্ষার্থীকে যেন বেকার থাকতে না হয় সেজন্য প্রত্যেক নাগরিকের জন্য কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হতে হবে প্রগতিশীল ও অপরাজনীতিমুক্ত। অন্যদিকে বাজারের সিন্ডিকেট ভেঙে কৃষকদের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করে জনমনে স্বস্তি ফেরাতে হবে। ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের পাশাপাশি গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে প্রাধান্য দিতে হবে। লুণ্ঠন, ঘুষ, অর্থ পাচার, ঋণ খেলাপের রাজত্ব নির্মূল করে আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার নেতিবাচক মানসিকতা থেকে ক্ষমতাসীনদের বের হতে হবে। বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন এর স্বাধীনতা দিয়ে জনগণের সুষ্ঠু ভোটাধিকারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সব ধর্মের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি ও সদ্ভাব বজায় রাখতে হবে আমাদের নিজেদেরই। দেশ ও দেশের সম্পদ রক্ষায় প্রত্যেকের নিজ জায়গা থেকে দায়িত্বের পরিচয় দিতে হবে। তবেই শহীদদের আত্মত্যাগ বৃথা যাবে না ও জেনারেশন জেড সূচিত অভ্যুত্থান সফল হবে বলে আশা করা যায়।
সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে
সানজানা আফরিন
বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
কে জানতো জুলাইয়ে স্টুডেন্টরা যখন সরকারি চাকরিতে কোটার বিলোপ ঘটিয়ে তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য মাঠে নামবে তখন তা সরকার পতনের মতো ইতিহাসে পরিণত হবে। ৫ আগস্ট শিক্ষার্থীসহ আপামর জনসাধারণের সহযোগে এমনই অসম্ভবকে সম্ভব করে বাংলাদেশের জনগণ। লয় ঘটে টানা ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা শাসকের। গঠিত হয় নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। বাংলার মানুষ এখন স্যামুয়েল বেকেটের মতো ওয়েটিং ফর আ নিউ গোডো। যেই গোডো প্রকৃত অর্থেই হবে ‘অব দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল অ্যান্ড বাই দ্য পিপল’।
- আরও পড়ুন
- বাংলাদেশের যত ছাত্র আন্দোলন
গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ সরকারের মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। যেখানে বাংলা ট্রিবিউনের তথ্য অনুযায়ী দেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ১১ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ঋণের প্রায় ৮০ শতাংশের বেশি অর্থ পাচার হয়েছে। নদীমাতৃক দেশের পরিবর্তে বাংলাদেশ এভাবে পরিণত হয়েছে দুর্নীতিমাতৃক দেশে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে জীইয়ে থাকা দুর্নীতিকে তাই অচিরেই নিরসন করে ফুটাতে হবে সৃষ্টির নব পূর্ণিমা। প্রয়োজনে এমন হট লাইন নম্বর চালু করতে হবে যেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও তার কার্যকর সুবিধা পাওয়া যায়। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করে বৈশ্বিক মন্দা দূর করার পাশাপাশি জনমনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে হবে। সরকারি উচ্চপদস্থ সেক্টরসহ প্রতিটি সেক্টরে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। প্রকাশ্যে আনতে হবে পদকর্তাদের আয় ব্যয়ের তালিকা। শিক্ষাখাত ও স্বাস্থ্যখাতে প্রয়োজনীয় সংস্কারও এখন সময়ের দাবি। পরিশেষে নতুন সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে মূল্যবোধ। কারণ প্রতিটি মানুষ যদি নিজস্ব দায়িত্ব কর্তব্যে মূল্যবোধের মাপকাঠিটি ঠিক রাখে তবেই সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে এবং বাংলাদেশেও নামবে ভোর।
সাংবিধানিক পরিবর্তন আনতে হবে
আলী আহসান
বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পরিবর্তনশীল এই পৃথিবীতে কালের বিবর্তনে সবকিছুরই পরিবর্তন হয়। তেমনি যুগে যুগে ক্ষমতারও পরিবর্তন হয় কিংবা পতন হয়। যে কোনো ইতিহাসেই শাসকের পতন এক দীর্ঘ শোষণের ফল। বাংলাদেশেও দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা আওয়ামী শাসকদের বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে আপামর ছাত্রসমাজ। যদিও পরবর্তী সময়ে সাধারণ জনগণ যোগ দেয় এই আন্দোলনে এবং আন্দোলন একটি গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। কাজেই সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হয় এবং পনেরো বছরের শাসনের অবসান ঘটে। রাজা যায় রাজা আসে অতএব বাংলাদেশেও নতুন শাসক এসেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শাসন চলছে। বলা হচ্ছে যে, এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশকে সংস্কার করে স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে পরে নতুন সরকার গঠন করবে। ফলে নতুন সরকারকে নিয়ে জনমনে নতুন আশা জন্ম নিয়েছে। নতুন সরকারকে সাংবিধানিক পরিবর্তনের দিকে নজর দেওয়া উচিত। এর মধ্যে রয়েছে দীর্ঘদিন যাতে করে কেউ ক্ষমতা গচ্ছিত রাখতে না পারে সেজন্য একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া উচিত। এতে করে রাজনৈতিক গতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে। কারণ অতীত ইতিহাসে দেখা যায় দীর্ঘদিনের ক্ষমতাসীন দলই একসময় স্বৈরাচারী শোষকে পরিণত হয়। ফলে ক্ষমতায় মেয়াদসীমা বেঁধে দেওয়া অপরিহার্য বলে মনে করি। এছাড়াও আমরা এমন এক শাসন কাঠামো চাই যেখানে শাসনকর্তাকে সরাসরি প্রশ্ন করতে পারবো অর্থাৎ বাকস্বাধীনতা চাই এবং অবশ্যই শাসকের নানান বিষয়ে যেন আমরা ইতিবাচক ও নেতিবাচক সমালোচনা করতে পারি সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
রাষ্ট্র নির্মাণে সংস্কার প্রয়োজন সবক্ষেত্রে
শারমিন খাতুন
পালি অ্যান্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
রাষ্ট্রে যখন অন্যায় অবিচার জুলুম নির্যাতন বেড়ে যায় তখন গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে হয় নতুন রাষ্ট্রের বিনির্মাণ। সাম্প্রতিক সময়ে কোটা আন্দোলন থেকে শুরু হয়ে পতন ঘটে স্বৈরাচারী সরকারের যার ফলশ্রুতিতে গড়ে উঠে অন্তবর্তীকালীন সরকার। রক্তে রঞ্জিত স্বাধীনতার নতুন সূর্যোদয়ে তরুণ প্রজন্মের চাওয়া এমন এক রাষ্ট্রের বিনির্মাণ যেখানে থাকবে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবার মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে, বন্ধ হবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ঝড়বে না কোনো প্রাণ প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে পুলিশ কাজ করবে জনগণের জন্য, শিক্ষাব্যবস্থায় যেন মেধাবীদের মূল্যায়ন হয়। তারা যেন তাদের প্রাপ্য সম্মান পেয়ে দেশ সেবায় ব্রত হতে পারে। তাহলেই মেধা পাচার কমবে। ধীরে ধীরে মেধাবীদের দ্বারাই দেশ পরিচালিত হবে। বর্তমানে চাঁদাবাজ, বিভিন্ন সিন্ডিকেট কঠোরভাবে দমন করা প্রয়োজন। সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম যেন তাদের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকে। বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি দূর করা, আইনের দৃষ্টিতে সবাইকে সমানভাবে দেখা, সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানে লাল ফিতার দৌরাত্ম হ্রাস করে জনকল্যাণকামী শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র নির্মাণ নতুন শাসকের নিকট কাম্য সবার।
মেধাবী বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে হবে
জোহরা শিকদার
দর্শন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আগামীর শাসক বা জনপ্রতিনিধির কাছে নতুন প্রজন্মের প্রথম চাওয়া হচ্ছে জনমনে আস্থা তৈরি করা। সরকার যেন জনগণের আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গা হয়ে উঠতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থা বিরাজ করার কথা ছিল। কিন্তু অর্ধ-শত বছরের পুরো সময়টাতেই আমরা দেখেছি নানা রাজনৈতিক টানাপোড়েন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, দুর্নীতি-লুটপাট, অন্যায়-অবিচার। বাংলাদেশে জনগণের রাজনীতির চেয়ে দলীয় রাজনীতিই বেশি হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর একমাত্র লক্ষ্য ছিল ক্ষমতা ধরে রাখা, দেশটাকে দলীয়করণ করা। ক্ষমতাসীন দলগুলোর দমন নিপীড়নের স্বীকার হয়েছে বিরোধী দল ও সাধারণ জনগণ। রাজনৈতিক দলের ক্ষমতার অপব্যবহার আর অপরিসীম বলপ্রয়োগ সমাজে তৈরি করছে চরম বৈষম্য। আর সব বৈষম্যকে রুখতেই ছাত্র সমাজ এক নতুন অভ্যূদয় ঘটিয়েছে। নতুন এই অভ্যূত্থানে সমাজের সব শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণ রয়েছে। তাই সব শ্রেণি পেশার মানুষের জন্য একটি সমতা ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করাই সবার কাম্য। সবার নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা, সব অন্যায় ও অবিচারের বিনাশ সাধন করা, দুর্নীতিমুক্ত, মেধাবী বাংলাদেশ বিনির্মাণ করা শহীদদের রক্তের দাবি। শত সহস্র মানুষের ছাত্র জনতার আত্মত্যাগের মাধ্যমে আমরা যে নতুন স্বাধীনতা পেয়েছি সেটি যেন অক্ষুণ্ণ থাকে আগামীর জনপ্রতিনিধিদের কাছে আমাদের এটাই প্রত্যাশা।
- আরও পড়ুন
- ইন্টারনেট ব্যবহারে কোনো টাকা লাগে না যে দেশে
- এ বছরই পদত্যাগ করেছেন বিশ্বের যেসব শীর্ষ নেতারা
কেএসকে/জিকেএস